সালমান পারভেজ সবুজ: প্রত্যেক অর্থ-বছরের জন্য সরকারের অনুমিত আয় ও ব্যয় সম্বলিত বিবরণই বাজেট। প্রতিটি বাজেটের প্রাক্কালে প্রত্যাশার পারদ চড়তে থাকে স্বপ্নের সর্বোচ্চ চূড়ায়। তবে এবার ২০২২-২৩ অর্থ-বছরে বাজেটে প্রত্যাশার মাত্রা ছিল গতানুগতিক বাজেট থেকে ভিন্ন মাত্রার।
কোভিড পরবর্তীতে বিশ্ব অর্থনীতি যখন কোমর সোজা দাঁড়াতে প্রস্তুতি নিচ্ছে তখনই আঘাত হানলো কিয়েভ সংকট। জ্বালানি মূল্য যেন মরার উপরে খাঁড়ার ঘা হয়ে আসলো। কোভিডের অভিঘাত থেকে কিয়েভ সংকটে বিশ্বকে বহুমাত্রিক সমস্যার সম্মুখীন হতে হলো। ক্রেমলিন বিশ্ব জ্বালানী তেলের বাজারে দ্বিতীয় বৃহৎ এবং গ্যাসের শীর্ষ রপ্তানীকারক, আবার বিশ্বে গম রপ্তানীর প্রায় ২৯ শতাংশ, ভুট্টার ১৯ শতাংশ এবং সূর্য মুখী তেলের ৮০ শতাংশ ক্রেমলিন ও কিয়েভ থেকে আসে। খাদ্য সরবরাহের ব্যাহত হওয়া ও সৃষ্ট জ্বালানী সংকট যা মুদ্রাস্ফীতি কে ত্বরান্বিত করছে ত্বড়িৎ গতিতে।জ্বালানীর উচ্চমূল্য আমাদনী নির্ভর অর্থনীতিতে ডলারের উপরে অপ্রত্যাশিত চাপ সৃষ্টি করেছে যা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে টুটি চেপে বসে আছে।
কেননা সমপরিমাণ আমদানির জন্য অতিরিক্ত ডলার পরিশোধ করতে হচ্ছে। মুদ্রা বাজারে বিরজমান অস্থিরতার সামগ্রীক প্রভাবে জনজীবনে মুদ্রাস্ফীতি নামক এক ভয়ংকার মাফিয়া ভর করে আছে। আর বিশ্বব্যাপী জনসাধারণ তার থেকে পালিয়ে বাঁচার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। কোভিডের অভিঘাত, কিয়েভ সংকট এবং চীনের জিরো কোভিড পলিসি এই তিন দানব যেখানে একত্র হয়ে বিশ্ব সাপ্লাই চেইনকে (সরবরাহ ব্যবস্থা) খড়ের কুড়োর মতো তছনছ করে দিয়ে মুদ্রাস্ফীতির আগুনে পুড়িয়ে সমগ্র বিশ্বকে গিলে গিলে খাচ্ছে, সেখানে এবারের বাজেটে প্রত্যাশার মাত্রাটা ভিন্ন হওয়াটাই ছিল স্বাভাবিক।
প্রতি বছরই বাজেটের আকার বড় হচ্ছে, এবারেও তার ব্যাতিক্রম হয়নি। ২০২২-২৩ অর্থ বছরে বাজেটের আকার ৬ লক্ষ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকা, যার আয় ৪ লক্ষ ৩৬ হাজার ২৭১ কোটি টাকা এবং ঘাটতি ২ লক্ষ ৪১ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা, যার মধ্যে ব্যাংক ঋণ থেকে ঘাটতি মেটানো হবে ১ লক্ষ ০৬ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা যা গত অর্থবছরের ব্যাংক ঋণের প্রায় ৩২৫ শতাংশ । আবার সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে নেওয়া হবে ৩৫,০০০ কোটি টাকা। এতে করে বেসরকারী খাতে ঋণ সরবরাহ ব্যাপক ভাবে হ্রাস পাবে। যার ফলে বেসরকারী খাতের উৎপাদন-আয় কমাবে, বিনিয়োগ হ্রাস পাবে, কর্মসংস্থান হ্রাস পাবে, ব্যক্তিক আয়-ব্যয়-সঞ্চয় হ্রাস পাবে, যা সামগ্রীক অর্থনীতিকে ধারাবাহিক ভাবে সংকুচিত করবে।
ইতোমধ্যে কিয়েভ সংকটের প্রভাবে ডলারের চাহিদা মেটাতে ৫৪,০০০ কোটি টাকা কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজার থেকে ডলার সরবরাহ করে উঠিয়ে নিতে হয়েছে, এটা এখনও অব্যাহত আছে। রেপো রেট ৪ দশমিক ৭৫ থেকে ৫ শতাংশ করা হয়েছে। সব মিলিয়ে বেসরকারী বিনিয়োগ সংকোচিত হবার সকল পথই সম্প্রসারিত হয়ে গেছে। ব্যাংগুলো তারল্য সংকটে রয়েছে তার প্রমাণ পাওয়া যায় কল মানি রেট গত দু’বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ হয়েছে। জুন মাসের মাঝামাঝিতে ওভার নাইটে (০১-দিন) ৫.৫০% এবং শর্ট নোটিশে (০৭-দিন) এ ৬.৫% হয়েছে। বেসরকারী খাতের দুটি অংশ প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক উভয় খাতই দেশের মোট কর্মসংস্থানের ৮০ শতাংশ নিশ্চিত করে যা বিদ্যমান কর্মসংস্থান ধরে রাখতে এবং নতুন কর্মসংস্থান তৈরিতে হুমকির মুখে পড়ছে। শুধু মাত্র উচ্চবিত্ত ছাড়া ঝুকিতে কিন্তু সেই প্রান্তিক শ্রেণী, নিন্মবিত্ত, নিন্মমধ্যবিত্ত থেকে মধ্যবিত্ত সকলেই।
সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে, পাবলিকলি ট্রেডেট, নন-ট্রেডেড এবং ব্যাক্তিক কোম্পানীর ক্ষেত্রে কর বিদ্যমান করহার ২২, ৩০ এবং ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে যথাক্রমে ২০, ২৭ দশমিক ৫০ এবং ২২ দশমিক ৫০ শতাংশ করা হয়েছে। লক্ষ্য নাকি বিনিয়োগ বাড়িয়ে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা, বস্তুতঃ এর অন্তরালে জনগণের হাতে কর্মসংস্থানের মোয়া দিয়ে বণিক শ্রেণীকে এবং উচ্চবিত্ত শ্রেণীকে করের ভার কমিয়ে দেওয়া হয়েছে।
বিপরীতে করমুক্ত আয়সীমা না বাডিয়ে, আগের ৩.০০ লাখে রেখে নিন্ম-মধ্যবিত্ত থেকে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিশাল জনগোষ্টির সাথে প্রবঞ্চনার খেলা হলো। গ্যাসের দাম বাড়ানো হলো, শিশু খাদ্য ও পণ্য, নিত্য-পণ্যের দাম দিনে দিনে বেড়ে চলেছে, জ্বালানি-বিদ্যুতের দামও বাড়ানো হবে বলে শোনা যাচ্ছে। দেশের বৃহৎ জনগোষ্টির কথা বিবেচনায় নিয়ে এবারের বাজেটে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে এটাই সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা ছিল।
এবারের বাজেটে অনানুষ্ঠানিক খাতকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হবে বলে বিশ্লেষকগণ আশা করেছিলেন, কেননা এ অনানুষ্ঠানিক খাতে দেশের কর্মসংস্থানের প্রায় ৮৫ শতাংশই নিশ্চিত করে।কৃষি ও অকৃষি উভয় অনানুষ্ঠানিক খাতেই মুলধন এবং বিনিয়োগের প্রয়োজন আছে। কিন্তু এবার রাজস্ব আর বাড়ানোর জন্য ৫.০০ লক্ষ টাকার উপরে ঋণ নিতে আয়কর রিটার্ন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে, যা এ খাতের মুলধন ও বিনিয়োগ সরবরাহে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে যা কর্মসংস্থানের জন্য মোটেই শুভকর নয় । উপরুন্ত সুদের হার ৬ শতাংশ ও ৯ শতাংশই থাকছে। তার উপরে কর্পোরেট আমানতের উপর প্রাপ্ত সুদের উপর বিদ্যমান কর হার ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২০ শতাংশ করা হয়েছে।
সরকারি তথ্য মতে, মে মাসে দেশে মুদ্রাস্ফীতির হার ৭.৪২ শতাংশ হলেও বিশ্লেষকদের মতে বাজারে মুদ্রাস্ফীতির হার প্রকৃত পক্ষে ১৫ শতাংশের উপরেই রয়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটে মুদ্রাস্ফীতির হার ৫.৬০ শতাংশ প্রাক্কলন করা হয়েছে যা নিছক স্বপ্ন ছাড়া কিছুই নয়। বাজার অর্থনীতিতে নির্ধারিত সুধের হার ৬ শতাংশ ও ৯ শতাংশ এর হিমায়িত একটি ঋণাত্মক প্রভাব তো থাকছেই। সার্বিক প্রভাবে ছোট ছোট ডিপোজিটরদের আয় কমিয়ে ভোগকেও কমাতে বাধ্য করবে। এতে চাহিদাও হ্রাস পাবে এবং বাজার কে সংকুচিত করতে পারে। অন্যদিকে আবার ঋনের সুদের হার ৯ শতাংশ থাকায় ব্যাংক গুলো ঋণ প্রদানে নিরুৎসাহিত হবে। এতে করে মধ্যবিত্ত ও নিন্ম মধ্যবিত্তের ঘাড়েই কোপটা (চাপ) পড়লো। অরেকটি রসালো খোরাক হচ্ছে, ৭ শতাংশ কর দিয়ে পাচার করা অর্থ ফেরত আনার যে পথ তৈরী করে দেওয়া হয়েছে।
অর্থনীতিবিদ ড. মইনুল ইসলাম একটি জাতীয় দৈনিককে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘বাজেটে অর্থ পাচার কার্যত উৎসাহিত করা হয়েছে।’
একুশে পদকপ্রাপ্ত এ অর্থনীতিবিদআরো বলেছেন, ‘এ বাজেটে উচ্চবিত্ত বা ধনাট্য ব্যাক্তিদের বিনিয়োগের নামে সুবিধা দেওয়া হয়েছে। কর্পোরেট কর হার কমিয়ে এ সুবিধা দেওয়া হয়েছ।’
নগদে ফলাফল; সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এসএনবি ‘সুইস ন্যাশনাল ব্যাংক’ নামে প্রকাশিত বার্ষিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের নামে জমা টাকার পরিমাণ ৫৫ শতাংশ বেড়েছে।
এবার বাজেটে বিশ্লেষকদের মাথা ব্যাথার কারণ বিশ্বব্যাপী মুদ্রাস্ফীতি, কেননা এবারের মুদ্রাস্ফীতি বহুলাংশেই আমদানীকৃত। আমদানীকৃত এ মুদ্রাস্ফীতি বিশ্বের বাঘা বাঘা অর্থনীতিবিদ, বিশ্লেষক তথা নীতি নির্ধারকদের মাথা ব্যাথার অন্যতম কারণ।
জুনের দ্বিতীয় সপ্তাহে Bloomberg Economics এর প্রাক্কলনে দেখা গেছে, চলতি বছরে মার্কিনীদের একই পরিমাণ ভোগের জন্য অতিরিক্ত ৫২০০ ডলার ব্যায় করতে হতে পারে, Bloomberg এর এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলমার যুদ্ধের কারণে বছরের শেষ নাগাদ অপরিশোধিত তেলের দাম ১৮০ ডলার পর্যন্ত বাড়তে পারে বলে আশাংঙ্খা প্রকাশ করেছেন (তাং-১৪.০৬.২০২২)।
আরেকটি বৈশ্বিক মন্দার শঙ্কায় যখন গোটা বিশ্ব শংঙ্কিত, যার নমুনা Davos এ ২৩.০৫.২০২২ তারিখে World Economic Forum এর বৈঠকে বিশ্লেষকদের “Inflation, Stagnation and Globalization” নিয়ে আলোচনায় দেখা যায়। এহেন বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে এবারের বাজেটটা হওয়ার দরকার ছিল নিয়ন্ত্রিত ডিফেন্সিভ। দরকার ছিল প্রান্তিক শ্রেণী থেকে মধ্যবিত্ত শ্রেণী পর্যন্ত গণমানুষেকে উদ্ভুদ্ধ বৈশ্বিক সংকটের প্রভাব থেকে রক্ষার্থে।
সমাজে এক শ্রেণীর লোক আছে যারা, সকালের খাবারটা কিভাবে পার করবে তা নিয়ে চিন্তায় থাকে, দুপুরের টা দুপুরে দেখা যাবে। আরেক শ্রেণীর লোক আছে, যারা আজকের দিনটা কিভাবে পার করবে সে চিন্তা করে, একই ভাবে সপ্তাহ ও মাস পার করা নিয়েও ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণী চিন্তিত থাকে। এরা সকলে মিলে মোট জনসংখ্যার সিংহ ভাগ অর্থাৎ ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ তো হবেই।
“আমার উন্নয়ন কই” অধ্যাপক ‘আলী রীয়াজ’ স্যারের শহর বানুর মতো এমন প্রশ্ন তুলে শহর বানুরা হয়ত রণে ভঙ্গ দিবে, তারা কোন সময় তাদের মাথা পিছু আয়, বাজেট বরাদ্ধ, প্রবৃদ্ধির ভাগ চাইবে না, চাইতেও পারবে না, তবে রাষ্টের উপর তাদেরও অধিকার আছে, তাদের অধিকার যেন অধিমাত্রায় শ্রাদ্ধে না যায় সে দিকেও রাষ্টের দৃষ্টিপাত করা উচিত। এবার বাজেটের যে সমস্ত দ্রব্য-সামগ্রীর উপরে শুল্ক বাড়ানো হয়েছে তালিকা, করমুক্ত আয়সীমা অপরিবর্তিত রাখা, করে রেয়াত যোগ্য বিনিয়োগসীমা কমানো সহ অন্যান্য প্যারামিটার গুলো দেখলেই এটা স্পষ্ট যে, এবারের বাজেট যেন বর্ণাট্যে প্রসারিত ঐ উচ্চ বিত্তদের জন্যই। এজন্য হয়তো বড় আক্ষেপে কার্ল মার্কস “মধ্যবিত্ত শ্রেণী”কে অবয়বহীন বলে সজ্ঞায়িত করে গেছেন।
‘সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী’ আমাদের মহান সংবিধানের ২৭ নং অনুচ্ছেদ এ এমন অধিকার থাকলেও কি হবে, আইন প্রণেতা একটু আধটু আইনের ব্যাত্যয় ঘটাতেই পারেন! দুর্নীতি দমন কমিশন আইন ২০০৪ এর ধারা ২৭(১) এবং ২৭(২) বা মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ২০১২ এ যত ধারাই থাকুক না কেন, কিবা যায় আসে, গোয়ালে তো নয়,কাজীর গরু কাগজেই হাসে। তাই তো আজ কালো টাকা-সাদা টাকা, পাচারে টাকা-আচারে টাকা, টাকায় টাকা।
ভারতীয় উপমহাদেশে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর শাসনের অবসানের পরে ১৮৫৮ সালে ‘‘ভারত শাসন আইন’’ পাশের মধ্য দিয়ে শুরু হয় বৃটিশদের প্রত্যক্ষ শাসনব্যবস্থা। বৃটিশ ‘গভর্নর জেনারেল ও ভাইসরয়’কে পরামার্শ দেওয়ার জন্য প্রতিষ্ঠা করা হয় ‘ইন্ডিয়ান কাউন্সিল’। যার অর্থনৈতিক উপদেষ্টা জেমস উইলসন ১৮৬০ সালের ৭ই এপ্রিল উপমহাদেশের প্রথম বাজেট পেশ করেন। ফরাসিদের বুজেট বৃটেনে এসে বাজেট হয়েছে। জেমস উইলসন থেকে আ.হ.ম মোস্তাফা কামাল। মাঝখানে সুদীর্ঘ পরিক্রমায় বাংলাদেশে এসে আজ বাজেট যেন বাংলা জেট হয়েছে, যে জেট শুধু মাত্র ধনিক-বণিকদের চড়ার জন্য। রাষ্ট্রই যেন বছরের পর বছর ধরে সে ব্যবস্থাই করছে। তাই অনায়াসেই চলে আসে, পর্বতসম বাজেটেও প্রাপ্তি কী
তবে মূষিক প্রসব!
লেখক: ব্যাংকার
ইমেইল: [email protected]
প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।