তানভীর হোসেন : পঞ্চাশের দশকের শেষদিকে চীন দেশে চড়ুই পাখির খুব উৎপাত শুরু হয়েছিল। ঝাঁকে ঝাঁকে চড়ুই পাখির দল উড়ে এসে কৃষকের জমির পাকা ধান খেয়ে নিত। সে সময় চড়ুই পাখির অত্যাচারে চীন দেশে ধানের উৎপাদন বেশ কমে গিয়েছিল। এতে সরকারের টনক নড়ল।
এটা ১৯৫৮ সালের কথা। তখন চীনের কমিউনিস্ট পার্টির চেয়ারম্যান ছিলেন মাও সেতুং। তিনি ছিলেন চীনের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। চড়ুই পাখির অত্যাচারের কথা শুনে চেয়ারম্যান মাও সিদ্ধান্ত নিলেন, ধানের উৎপাদন বাড়াতে চীন দেশকে চড়ুই পাখিমুক্ত করতে হবে।
তিনি এ ব্যাপারে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য নির্দেশ দিলেন।
কথায় বলে- কর্তার ইচ্ছায় কর্ম। দলে দলে আবালবৃদ্ধবনিতা বেরিয়ে পড়ল চড়ুই পাখি নিধন অভিযানে। দেখামাত্র চড়ুই পাখি হত্যা করা শুরু হলো।
চড়ুই পাখির বাসা, ডিম, ছানা সব ধ্বংস করা শুরু হলো। স্কুলের বাচ্চাদের হাতে গুলতি দেওয়া হলো চড়ুই পাখি মারার জন্য। কে কয়টি চড়ুই পাখি মারতে পারে রীতিমতো তার প্রতিযোগিতা শুরু হলো।
একদল অতিউৎসাহী মানুষ নেমে পড়ল ড্রাম নিয়ে। যেখানেই চড়ুই পাখি, সেখানেই ড্রাম বাজানো শুরু হলো।
ড্রামের বিকট শব্দে চড়ুই পাখিরা ভয় পেয়ে আকাশে ওড়াউড়ি শুরু করল। কিন্তু ড্রাম আর থামে না। ড্রামের শব্দে চড়ুই পাখিরা নিচে নামার সাহস পেল না। অনেক পাখি উড়তে উড়তেই ক্লান্ত হয়ে টুপ করে মাটিতে পড়ে গেল। এ ছাড়া ফাঁদ পেতে, বিষ দিয়ে বিভিন্ন কায়দায় চড়ুই পাখি মারার দক্ষযজ্ঞ শুরু হলো। সেই সময় এক দিনেই সাংহাই শহরে প্রায় দুই লাখ চড়ুই পাখি মারার রেকর্ড রয়েছে। এভাবে মোটামুটি এক বছরের মধ্যেই চীন দেশে চড়ুই পাখির বংশ মোটামুটি ধ্বংস হয়ে গেল। চেয়ারম্যান মাওয়ের নেতৃত্বে চীন দেশের জনগণ চড়ুই পাখির বিরুদ্ধে এক বিশাল বিজয় অর্জন করল।
কিন্তু পরের বছর, ধান লাগানোর পর নতুন এক বিপত্তি শুরু হলো। দেখা গেল, ধান গাছে বিভিন্ন ধরনের ক্ষতিকর পোকার আক্রমণ অসম্ভব বেড়ে গেছে। কীটনাশক দিয়েও পোকামাকড় দমন করা সম্ভব হচ্ছে না। ধানের উৎপাদন আরো অনেক কমে গেল। মারাত্মক সমস্যা হলো এর পরের বছর। পঙ্গপালের ভয়াবহ আক্রমণে লাখ লাখ একর জমির ধান সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেল। এর ফলে চীন দেশে মহাদুর্ভিক্ষ দেখা গেল। ইতিহাসবিদদের ধারণা, সে সময় চীন দেশে দুর্ভিক্ষে দেড় কোটির বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। তবে প্রকৃত সংখ্যা এর বেশিও হতে পারে।
তখন বোঝা গেল, চড়ুই পাখি নিধন করার ফলেই এই ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে।
চড়ুই পাখি শুধু জমির পাকা ধানই খেত না, সেই সঙ্গে ধানের ক্ষতিকর পোকামাকড়ও খেয়ে নিত। এর ফলে পোকামাকড়ের সংখ্যা খুব বেশি বাড়ত না। কিন্তু চড়ুই পাখি না থাকায়, দুই বছরের মধ্যেই পোকামাকড়ের বংশ অত্যন্ত দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে চড়ুই পাখির সমস্যার চেয়ে পোকামাকড়ের উপদ্রব অনেক বেশি মাত্রার ক্ষতি করেছে। চড়ুই পাখি আর কটা ধানই খেত, এখন পঙ্গপাল এসে সব সাবাড় করে দিয়েছে। চেয়ারম্যান মাও তখন তাঁর ভুল বুঝতে পারলেন। তিনি চড়ুই পাখি হত্যা করার আদেশ প্রত্যাহার করে নিলেন। কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে।
এটাই হলো প্রকৃতির প্রতিশোধ। প্রকৃতিতে জীবজগতের ভেতর নানা রকম ভারসাম্য থাকে। হাজার হাজার বছর ধরে প্রকৃতি আপন নিয়মেই এসব ভারসাম্য টিকিয়ে রেখেছে। এটা মানুষের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হলে, প্রকৃতি তার রুদ্ররোষ নিয়ে আমাদের সামনে এসে হাজির হয়।
মানুষ নির্বিচারে আজ বন উজাড় করছে, জমিতে যথেচ্ছ কীটনাশক ব্যবহার করছে, শিল্প বর্জ্য দিয়ে নদীর পানি দূষণ করছে, যত্রতত্র প্লাস্টিকের বোতল ফেলছে। মাইক্রোপ্লাস্টিক কণায় দূষিত হচ্ছে প্রাকৃতিক পরিবেশ। মানুষ বায়ুমণ্ডলে ছড়াচ্ছে ক্ষতিকর গ্রিন হাউস গ্যাস। এর ফলে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা ক্রমেই বাড়ছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের মাত্রাও দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। প্রকৃতি দয়াশীল, কিন্তু ক্ষমাশীল নয়। প্রকৃতির রুদ্ররোষ বড়ই ভয়াবহ। এ কথা যেন আমরা ভুলে না যাই।
লেখক : সাবেক ঊর্ধ্বতন পরীক্ষক, প্লান্ট ব্রিডার রাইটস, অস্ট্রেলিয়া
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।