গ্রীষ্মের দাবদাহে রিকশাওয়ালা রফিকুল ইসলামের গলা শুকিয়ে কাঠ। কিন্তু যাত্রী ঠিকঠাক পৌঁছে দিতে হবে—এই ভাবনায় এক গ্লাস পানির জন্য দোকানে থামা হলো না। দুপুর গড়িয়ে বিকেল, হঠাৎ প্রচণ্ড মাথাঘোরা আর বমিভাব। পড়ে গেলেন রাস্তার ধারে। আশেপাশের মানুষ ছুটে এলে ধরা পড়ল—পর্যাপ্ত পানি না খাওয়াই এই অবসাদের মূল কারণ। রফিকুলের এই ঘটনা বিচ্ছিন্ন নয়। ঢাকার এক বেসরকারি ক্লিনিকে চিকিৎসক ডা. তাহমিনা হক বললেন, “প্রতিদিনই আমরা দেখি অফিসের মানুষ, বাইরের শ্রমিক, এমনকি স্কুলের বাচ্চারাও ডিহাইড্রেশনে ভুগছে। অনেকেই বুঝতেই পারেন না, সামান্য পানি কম খাওয়ার ফল এতটা মারাত্মক হতে পারে!”
💧 আমাদের শরীরের প্রায় ৬০% জুড়েই পানি। এই জীবনরসের সামান্য ঘাটতিই ধীরে ধীরে ভেঙে দিতে পারে দেহযন্ত্রের সুচারু কার্যক্রম। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)-র মতে, দৈনিক পর্যাপ্ত পানি পান না করার কারণে সৃষ্ট ডিহাইড্রেশন বিশ্বব্যাপী প্রতিরোধযোগ্য অসুস্থতা ও উৎপাদনশীলতা হ্রাসের একটি বড় কারণ। বাংলাদেশে, বিশেষ করে গ্রীষ্মকালে ও দ্রুত নগরায়নের চাপে, এই সমস্যা ক্রমাগত বাড়ছে। পানি কম খেলে শুধু তেষ্টা পায় না, শরীর ভেতর থেকে দেয় একের পর এক সতর্কবার্তা—যেগুলো অবহেলা করলে জীবন সংশয় পর্যন্ত হতে পারে।
দৈনিক কতটা পানি পান করা উচিত? একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের জন্য আদর্শ পরিমাণ
“পানি কম খেলে কী সমস্যা হয়?”—এই প্রশ্নের উত্তর জানতে গেলে প্রথমেই বুঝতে হবে শরীরের চাহিদা কতটা। জাতীয় পুষ্টি ইনস্টিটিউট (Bangladesh), ঢাকা এর নির্দেশনা অনুসারে, একজন সুস্থ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের দৈনিক ৮-১০ গ্লাস (প্রায় ২-২.৫ লিটার) পানি পান করা আবশ্যক। তবে এটা এক-size-fits-all নয়!
- বয়স, লিঙ্গ ও শারীরিক গঠন: শিশু, কিশোর, প্রাপ্তবয়স্ক ও বয়স্ক—সবার চাহিদা আলাদা। পুরুষদের সাধারণত নারীদের চেয়ে সামান্য বেশি পানি প্রয়োজন (প্রায় ৩.৭ লিটার বনাম ২.৭ লিটার – Institute of Medicine, USA)।
- শারীরিক পরিশ্রম: রিকশাচালক, কৃষক, অ্যাথলেট বা যারা ভারী কাজ করেন, তাদের ঘামের মাধ্যমে পানি ও ইলেক্ট্রোলাইট হারানোর পরিমাণ বেশি। তাদের দৈনিক ৩-৪ লিটার পর্যন্তও প্রয়োজন হতে পারে।
- আবহাওয়া ও পরিবেশ: বাংলাদেশের গ্রীষ্মকাল (এপ্রিল-সেপ্টেম্বর) যখন তাপমাত্রা ৩৫°C ছাড়ায়, ঘাম বেড়ে যায়। তখন পানি গ্রহণের পরিমাণও বাড়াতে হবে অন্তত ২০-৩০%। ঢাকা বা চট্টগ্রামের মতো দূষিত শহরে শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে আর্দ্রতা হারানোর মাত্রাও বেশি।
- স্বাস্থ্যগত অবস্থা: জ্বর, ডায়রিয়া, বমি হলে শরীর দ্রুত পানি হারায়। গর্ভবতী ও স্তন্যদানকারী মায়েদেরও অতিরিক্ত তরল প্রয়োজন (প্রায় ৩ লিটার)।
- খাদ্যাভ্যাস: তরমুজ, শসা, ডাবের পানি, স্যুপ, দুধ—এসব খাবার থেকেও শরীর কিছু পানি পায়। তবে কফি বা চায়ের মূত্রবর্ধক প্রভাব কিছুটা পানি বের করে দিতে পারে।
📌 বিশেষজ্ঞের পরামর্শ: বারডেম জেনারেল হাসপাতালের পুষ্টিবিদ ডা. ফারহানা আক্তারের মতে, “শুধু তৃষ্ণা পেলেই পানি খাবেন না। তৃষ্ণা ডিহাইড্রেশনের প্রাথমিক সিগনাল, মানে তখনই শরীরে পানির ঘাটতি শুরু হয়েছে। তাই সচেতনভাবে সময় ধরে পানি পান করুন। প্রস্রাবের রং পরিষ্কার বা হালকা হলুদ রাখাই লক্ষ্য। গাঢ় হলুদ প্রস্রাবই ডিহাইড্রেশনের বড় ইঙ্গিত।”
পানি কম খাওয়ার লক্ষণ: শরীর কখন SOS সংকেত দেয়?
শরীর অসাধারণ এক যন্ত্র। পানি কম পেলে তাৎক্ষণিকভাবে তা জানান দেয় নানা লক্ষণে। ডিহাইড্রেশন একদিনে তৈরি হয় না; ধাপে ধাপে বাড়ে। জেনে নিন কোন সিগনালগুলো কখনই উপেক্ষা করা উচিত নয়:
প্রাথমিক লক্ষণ (হালকা ডিহাইড্রেশন – ১-২% পানি কমে গেলে):
- অবিরাম তৃষ্ণা: শরীরের সবচেয়ে সরাসরি বার্তা।
- মুখ শুকিয়ে যাওয়া ও লালার ঘাটতি: খাবার গিলতে কষ্ট হওয়া।
- ক্লান্তি ও দুর্বলতা: সামান্য কাজেই হাঁপিয়ে ওঠা, ঘুম ঘুম ভাব।
- মাথাব্যথা: মস্তিষ্কের টিস্যু সামান্য সঙ্কুচিত হওয়ায় এই ব্যথা হয় (The Journal of Headache and Pain-এ প্রকাশিত গবেষণা)।
- প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যাওয়া ও রং গাঢ় হওয়া: কিডনি কম পানি পেলে প্রস্রাব ঘন করে, ফলে রং গাঢ় হলুদ বা অ্যাম্বার হয়।
মাঝারি লক্ষণ (৩-৫% পানি কমে গেলে – জরুরি সতর্কতা):
- মাথাঘোরা বা ভার্টিগো: রক্তচাপ কমে যাওয়ায় মস্তিষ্কে রক্তপ্রবাহ হ্রাস পায়।
- ঘোলাটে চিন্তাভাবনা ও মনোযোগহীনতা: গবেষণায় প্রমাণিত, ডিহাইড্রেশন কগনিটিভ ফাংশন ২০% পর্যন্ত কমাতে পারে (British Journal of Nutrition)।
- হৃদস্পন্দন বেড়ে যাওয়া: শরীরে রক্তের পরিমাণ কমে গিয়ে হৃদপিণ্ডকে বেশি পাম্প করতে হয়।
- পেশিতে টান বা ক্র্যাম্প: ইলেক্ট্রোলাইট (সোডিয়াম, পটাশিয়াম) ভারসাম্যহীনতার কারণে।
- চোখ ডুবে যাওয়া ও ত্বক এলাস্টিসিটি হারানো: ত্বক চিমটি দিয়ে ছেড়ে দিলে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে সময় লাগে (ত্বকের টার্গর কমে যায়)।
গুরুতর লক্ষণ (৬% বা তার বেশি পানি কমে গেলে – জীবনঘাতী):
- অতিরিক্ত দুর্বলতা বা প্রায় অচেতন অবস্থা।
- শ্বাসকষ্ট বা দ্রুত-গভীর শ্বাসপ্রশ্বাস।
- খিঁচুনি।
- প্রস্রাব একেবারেই বন্ধ হয়ে যাওয়া।
- রক্তচাপ অত্যধিক কমে যাওয়া (Shock)।
- শরীরের তাপমাত্রা অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়া (হিটস্ট্রোক)।
📊 ডেটা স্পট: বাংলাদেশে ডায়রিয়াজনিত ডিহাইড্রেশনে বছরে প্রায় ১ লক্ষ ২০ হাজার শিশুর মৃত্যু হয় (UNICEF Bangladesh রিপোর্ট, সর্বশেষ হালনাগাদ)। প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালের জরিপে দেখা গেছে, গ্রীষ্মকালে ভর্তি রোগীদের ৩০%-এর বেশি কোনো না কোনো ডিহাইড্রেশন লক্ষণে ভুগছিলেন।
পানি কম খেলে শরীরের কোন কোন অঙ্গের ক্ষতি হয়? ভয়াবহ দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব
ডিহাইড্রেশন শুধু তৃষ্ণা বা ক্লান্তির ব্যাপার নয়। এটি ধীরে ধীরে শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কার্যকারিতাকে ধ্বংস করে দেয়। পানি কম খেলে কী সমস্যা হয় তার তালিকা দেখলে আপনি আজই একটি গ্লাস পানি খেতে বাধ্য হবেন!
১. মস্তিষ্কের ওপর মারাত্মক আঘাত
- পানির অভাবে মস্তিষ্কের কোষগুলি সাময়িকভাবে সঙ্কুচিত হয়। এর ফলেই হয় মাথাব্যথা, মাইগ্রেনের ব্যথা বাড়ে, মনোযোগ কমে, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা হ্রাস পায়, মুড সুইং হয়।
- দীর্ঘদিন ডিহাইড্রেশনে ভুগলে স্মৃতিশক্তি দুর্বল হওয়া, কাজের দক্ষতা কমে যাওয়া এমনকি হতাশা বা অ্যাংজাইটির ঝুঁকিও বাড়ে (American Journal of Clinical Nutrition)।
২. কিডনি: নীরব ঘাতকের জন্মভূমি
- কিডনি আমাদের রক্ত ফিল্টার করে বর্জ্য পদার্থ প্রস্রাবের মাধ্যমে বের করে। পানি কম পেলে কিডনির ওপর চাপ পড়ে, ফিল্টারিং সিস্টেম দুর্বল হয়।
- এর ফলে তৈরি হয় কিডনি স্টোন (পাথর)। বাংলাদেশে কিডনি রোগের অন্যতম প্রধান কারণই হলো পর্যাপ্ত পানি না খাওয়া (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের নেফ্রোলজি বিভাগের তথ্য)।
- দীর্ঘস্থায়ী ডিহাইড্রেশন ক্রনিক কিডনি ডিজিজ (CKD)-এর দিকে নিয়ে যেতে পারে, যা শেষ পর্যন্ত ডায়ালিসিস বা কিডনি ট্রান্সপ্লান্টের প্রয়োজন তৈরি করে।
৩. হৃদযন্ত্রের ওপর চাপ
- পানির অভাবে রক্তের পরিমাণ কমে যায়, রক্ত ঘন হয়ে যায়। ফলে হৃদপিণ্ডকে একই কাজ করতে বেশি জোরে পাম্প করতে হয়, রক্তচাপ বাড়তে পারে।
- ঘন রক্ত জমাট বাঁধার প্রবণতা বাড়ায়, যা হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে (European Heart Journal)।
৪. পাচনতন্ত্রের বিপর্যয়
- পানি খাদ্য হজমে, পুষ্টি শোষণে এবং মল নরম রাখতে সাহায্য করে। পানি কম পেলে কোষ্ঠকাঠিন্য হয়, পাইলসের সমস্যা বাড়ে।
- পাকস্থলীতে অ্যাসিডের ঘনত্ব বাড়তে পারে, ফলে অ্যাসিডিটি, বদহজম, গ্যাস্ট্রাইটিস-এর মতো সমস্যা দেখা দেয়।
- দীর্ঘমেয়াদে এটি বড় আন্ত্রিক রোগের (যেমন আইবিএস) কারণও হতে পারে।
৫. ত্বক ও চুলের অকালবার্ধক্য
- ত্বক হলো শরীরের সবচেয়ে বড় অঙ্গ। পানি কম খেলে ত্বক শুষ্ক, রুক্ষ, নিষ্প্রাণ হয়ে যায়, বলিরেখা ও ফাইন লাইনস আগেই দেখা দেয়।
- ত্বকের ইলাস্টিসিটি কমে যায়, ব্রণ বা একজিমার মতো সমস্যা বাড়তে পারে।
- চুল ভেঙে যায়, রুক্ষ হয়, চুল পড়া বাড়ে। খুশকির সমস্যা দেখা দেয়।
৬. জয়েন্ট ও পেশির ব্যথা
- জয়েন্টের কার্টিলেজ ও পেশির টিস্যুর সেলগুলির প্রায় ৮০% পানি। ডিহাইড্রেশনে এই টিস্যু শুকিয়ে যায়, ঘর্ষণ বাড়ে। ফলে জয়েন্টে ব্যথা, পেশিতে টান (ক্র্যাম্প), বিশেষ করে ব্যায়ামের সময় বা রাতে ব্যথা বেড়ে যায়।
- পেশির কর্মক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পায়, ক্লান্তি আসে দ্রুত (Journal of Athletic Training)।
৭. রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়া
- লিম্ফ নামক তরল, যা রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে, তার মূল উপাদানই পানি। পানি কম পেলে লিম্ফের প্রবাহ ধীর হয়, টক্সিন দেহ থেকে ঠিকমত বের হতে পারে না।
- ফলে শরীর সংক্রমণের (সর্দি-কাশি, ফ্লু, ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন) বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারে না সহজে।
কে বেশি ঝুঁকিতে? ডিহাইড্রেশনের হাই-রিস্ক গ্রুপ
পানি কম খাওয়ার সমস্যা সবার জন্য ক্ষতিকর, কিন্তু কিছু গোষ্ঠীর জন্য তা বিশেষভাবে বিপজ্জনক:
- শিশুরা (বিশেষ করে ৫ বছরের নিচে): তাদের শরীরে পানির অনুপাত বেশি, দ্রুত পানি হারায় (ডায়রিয়া, জ্বর, গরমে খেলাধুলা), নিজে থেকে পানি চাইতে জানে না। বাংলাদেশে ডায়রিয়াজনিত ডিহাইড্রেশন শিশুমৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ (ইউনিসেফ)।
- বয়স্ক ব্যক্তিরা (৬৫+): বয়সের সাথে সাথে তৃষ্ণার অনুভূতি কমে যায়, কিডনির পানি ধরে রাখার ক্ষমতা হ্রাস পায়, অনেকেরই চলাফেরার অসুবিধা থাকে পানি আনতে। ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপের ওষুধও ডিহাইড্রেশন বাড়াতে পারে।
- গর্ভবতী ও স্তন্যদানকারী মায়েরা: গর্ভস্থ শিশুর বৃদ্ধি, অ্যামনিওটিক ফ্লুইড এবং বুকের দুধ তৈরির জন্য অতিরিক্ত তরল প্রয়োজন। ডিহাইড্রেশন প্রিম্যাচিউর লেবার বা দুধের পরিমাণ কমে যাওয়ার ঝুঁকি বাড়ায়।
- ক্রনিক অসুস্থ ব্যক্তিরা (ডায়াবেটিস, কিডনি রোগ, হৃদরোগ): এই রোগগুলো নিজেরাই ডিহাইড্রেশনের ঝুঁকি বাড়ায়, আবার ডিহাইড্রেশন এই রোগগুলোর অবস্থা আরও খারাপ করে।
- যারা প্রচুর শারীরিক পরিশ্রম করেন বা খেলোয়াড়: প্রচুর ঘামের মাধ্যমে পানি ও ইলেক্ট্রোলাইট হারান।
- উচ্চ তাপমাত্রা বা আর্দ্র পরিবেশে কাজ করা মানুষ (কৃষক, নির্মাণ শ্রমিক, রিকশাচালক): অতিরিক্ত ঘাম হয়।
- যারা কিছু নির্দিষ্ট ওষুধ খান (ডাইইউরেটিকস, কিছু ব্লাড প্রেশার ওষুধ, অ্যান্টিহিস্টামিন, ল্যাক্সেটিভ): এই ওষুধগুলো প্রস্রাব বা মলের মাধ্যমে পানি বের করে দেয়।
পানি কম খাওয়া থেকে বাঁচার উপায়: প্রতিদিনের সহজ অভ্যাস
“পানি কম খেলে কী সমস্যা হয়” তা জানার পর এখন জেনে নিন কীভাবে সহজেই ডিহাইড্রেশন এড়িয়ে সুস্থ থাকবেন:
- রুটিন তৈরি করুন, তৃষ্ণার অপেক্ষা করবেন না: সকালে উঠে ১-২ গ্লাস পানি, প্রতিবার খাবারের আগে ও পরে ১ গ্লাস, ঘুমানোর আগে ১ গ্লাস—এভাবে ভাগ করে নিন। অ্যালার্ম বা রিমাইন্ডার অ্যাপ ব্যবহার করুন।
- পানি সবসময় কাছে রাখুন: ডেস্কে, ব্যাগে, বিছানার পাশে পানির বোতল রাখুন। দেখলেই খাওয়ার অভ্যাস তৈরি হবে।
- পানীয়ের বদল: শুধু পানি খেতে কষ্ট হলে ডাবের পানি, লেবুপানি, বাসায় বানানো ফলের রস (চিনি ছাড়া), স্যুপ, দই, তরমুজ, শসা, টমেটোর মতো পানিসমৃদ্ধ ফল-সবজি খান।
- বাইরে বের হলে প্রস্তুতি নিন: বিশেষ করে গরমের দিনে বা দীর্ঘ ভ্রমণে পর্যাপ্ত পানি (ও সম্ভব হলে ORS) সঙ্গে নিন।
- অ্যালকোহল ও ক্যাফেইন সীমিত করুন: এগুলো মূত্রবর্ধক। খেলে অতিরিক্ত পানি পান করুন।
- প্রস্রাবের রং মনিটর করুন: লক্ষ্য রাখুন যেন প্রস্রাবের রং হালকা হলুদ বা স্বচ্ছ থাকে। গাঢ় হলুদ মানেই পানির ঘাটতি!
- বিশেষ পরিস্থিতিতে সতর্কতা: জ্বর, ডায়রিয়া, বমি হলে ORS (ওরাল রিহাইড্রেশন স্যালাইন) ব্যবহার করুন। প্রচুর ঘাম হলে (খেলাধুলা, গরমে কাজ) শুধু পানি নয়, ইলেক্ট্রোলাইট রিচ পানীয় (ডাবের পানি, ORS, হোমমেড লেবুনুনক) খান।
- বাচ্চা ও বয়স্কদের বিশেষ যত্ন: তাদের নিয়মিত পানি খাওয়ানোর কথা মনে করিয়ে দিন বা নিজে খাইয়ে দিন। তাদের তৃষ্ণা কম অনুভূত হয়।
📢 বিশেষজ্ঞের পরামর্শ: ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ বললেন, “বাংলাদেশের মতো গরম ও আর্দ্র দেশে ডিহাইড্রেশন খুব সাধারণ, কিন্তু অত্যন্ত বিপজ্জনক একটি সমস্যা। বিশেষ করে বয়স্ক মা-বাবা, ছোট্ট বাচ্চা এবং যারা বাইরে কাজ করেন—তাদের দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। সচেতনতা ও ছোট্ট কিছু অভ্যাসই পারে ডিহাইড্রেশনজনিত ভয়াবহ স্বাস্থ্যঝুঁকি থেকে আমাদের রক্ষা করতে।”
জেনে রাখুন (FAQs):
প্রশ্ন: গর্ভবতী অবস্থায় পানি কম খেলে কী সমস্যা হয়?
উত্তর: গর্ভাবস্থায় পানি কম খাওয়া অত্যন্ত বিপজ্জনক। এর ফলে অ্যামনিওটিক ফ্লুইড কমে যেতে পারে, যা ভ্রূণের বিকাশে বাধা দেয়। প্রিম্যাচিউর লেবার, জন্মগত ত্রুটি, মায়ের ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন (UTI), কোষ্ঠকাঠিন্য ও ক্লান্তির ঝুঁকি বেড়ে যায়। গর্ভবতী মায়েদের দৈনিক ৩ লিটার (প্রায় ১২-১৩ গ্লাস) তরল খাওয়া আবশ্যক।প্রশ্ন: বাচ্চারা দৈনিক কতটা পানি খাবে?
উত্তর: বাচ্চার বয়স ও ওজনের ওপর চাহিদা নির্ভর করে। সাধারণ নিয়ম:- ১-৩ বছর: প্রায় ৪-৫ কাপ (১ লিটার)
- ৪-৮ বছর: প্রায় ৫-৬ কাপ (১.২ লিটার)
- ৯-১৩ বছর (মেয়ে): প্রায় ৭-৮ কাপ (১.৬ লিটার), (ছেলে): প্রায় ৮-১০ কাপ (২ লিটার)
- ১৪-১৮ বছর (মেয়ে): ৮-১০ কাপ (২ লিটার), (ছেলে): ১১-১৩ কাপ (২.৫-৩ লিটার)।
গরম, জ্বর, ডায়রিয়া বা খেলাধুলা করলে পরিমাণ বাড়বে।
প্রশ্ন: বেশি বয়সে পানি কম খাওয়ার ঝুঁকি কী?
উত্তর: বয়স্কদের তৃষ্ণার অনুভূতি কমে যায়, কিডনির পানি ধরে রাখার ক্ষমতা হ্রাস পায়। ডিহাইড্রেশন দ্রুত ঘটে এবং মারাত্মক আকার নিতে পারে। এটি কোষ্ঠকাঠিন্য, প্রস্রাবে ইনফেকশন, মাথাঘোরা থেকে পড়ে যাওয়া, খিঁচুনি, কিডনি ফেইলিউর এমনকি স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়। তাদেরকে নিয়মিত পানি খাওয়াতে হবে।প্রশ্ন: কিডনির রোগী (CKD) কি বেশি পানি খাবেন?
উত্তর: না। কিডনি রোগের ধাপ (স্টেজ) এবং ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী পানি গ্রহণ করতে হবে। কিছু ক্ষেত্রে (ডায়ালিসিস রোগী বা অ্যাডভান্সড CKD) পানি সীমিত করতে হয় ফ্লুইড ওভারলোড রোধে। আবার কিছু ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত পানি প্রয়োজন কিডনিকে সাপোর্ট দিতে। তাই নিজে সিদ্ধান্ত নেবেন না, নেফ্রোলজিস্টের নির্দেশ মেনে চলুন।- প্রশ্ন: চা-কফি খেলে কি শরীরে পানির ঘাটতি হয়?
উত্তর: চা-কফিতে থাকা ক্যাফেইন মৃদু মূত্রবর্ধক, অর্থাৎ সামান্য বেশি প্রস্রাব হতে পারে। তবে, মাঝারি পরিমাণে (দিনে ৩-৪ কাপ) পান করলে তা সামগ্রিক তরল ভারসাম্যে বড় ধরনের ঘাটতি তৈরি করে না। তবে, চা-কফিকে পানির বিকল্প ভাবা উচিত নয়। প্রতিটি কাপ চা/কফির পাশাপাশি এক গ্লাস বিশুদ্ধ পানি পান করা ভালো অভ্যাস। অতিরিক্ত ক্যাফেইন ক্ষতিকর।
মনে রাখবেন, পানি শুধু তৃষ্ণা মেটানোর মাধ্যম নয়, এটিই আপনার শরীরের প্রতিটি সেলকে সচল রাখার মূল জ্বালানি। পানি কম খেলে যে সমস্যা হয়—কিডনি, হার্ট, মস্তিষ্কের ক্ষতি থেকে শুরু করে ত্বকের অকালবার্ধক্য—তা শুধু আজকের অস্বস্তি নয়, ভবিষ্যতের সুস্থ জীবনের ওপর একের পর এক আঘাত। ঢাকার কনকনে রোদে, সিলেটের বর্ষণধারায়, খুলনার লবণাক্ততায়—বাংলাদেশের প্রতিটি প্রান্তে পানির চাহিদা সমান গুরুত্বপূর্ণ। আপনার ডেস্কে রাখা সেই পানির বোতল, আপনার শিশুকে খাওয়ানো এক চুমুক পানি, বাবা-মায়ের জন্য গ্লাসভর্তি তৃষ্ণার জল—এগুলোই পারে প্রতিরোধ করতে ডিহাইড্রেশনের ভয়াবহ সব পরিণতি। তাই আজ থেকেই সচেতন হোন। নিয়ম করে পানি পান করুন। নিজে সুস্থ থাকুন, পরিবারকে সুস্থ রাখুন। আপনার শরীরের এই মৌলিক চাহিদাটি পূরণের দায়িত্ব আপনারই।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।