পানি নিজে জ্বলে না, সে ধ্রুব সত্য। কিন্তু মজার ব্যাপারটি হলো এই পানি দুটি উপাদান নিয়ে গঠিত, যার একটি অনায়াসে জ্বলে, আর অন্যটি জ্বলতে চমৎকার সাহায্য করে। ওগুলোর নাম হচ্ছে হাইড্রোজেন আর অক্সিজেন। তবে এখানেই সব কথা শেষ নয়। স্বাভাবিক হাইড্রোজেনের মধ্যে কখনও কখনও সাধারণ অণুর চেয়ে দ্বিগুণ ভারী অণু উপস্থিত থাকে। এরূপ হাইড্রোজেনকে বলে হয় ভারী হাইড্রোজেন বা ডিউটেরিয়াম। শক্তির প্রাচুর্য নিয়ে মানুষের সব আশা-আকাঙ্ক্ষা তার সঙ্গেই জড়িত।
বহুকাল আগে থেকেই জানা আছে যে ভারী হাইড্রোজেনের দুটি পরমাণু একসঙ্গে যুক্ত করলে নতুন একটি উপাদান, হিলিয়ামের নিউক্লিয়াস মিলবে এবং অনেক শক্তি নিঃসৃত হবে। এক কিলোগ্রাম ডিউটেরিয়াম যে পরিমাণ শক্তি দেয়, ঠিক সেই পরিমাণ শক্তি দিতে পারে ১ কোটি ৪০ লাখ কেজি কয়লা। অবশ্য তার জন্য যদি কয়লা জ্বালানো যায়।
আর তুমি জানো, সাগর-মহাসাগরে কী পরিমাণ ডিউটেরিয়াম আছে? বিপুল পরিমাণ, তা দিয়ে মানবজাতির ৫ হাজার কোটি বছর চলবে। তবে দুটি নিউক্লিয়াস একসঙ্গে যুক্ত করা খুব কঠিন কাজ। এজন্য ডিউটেরিয়ামকে সূর্যের তাপমাত্রা—২০ কোটি ডিগ্রি পর্যন্ত উত্তপ্ত করা প্রয়োজন! আর একমাত্র এরূপ উত্তাপের মধ্যেই ডিউটেরিয়ামের নিউক্লিয়াসগুলো একত্রে মিলিত হবে ও তাদের মধ্যে লুকায়িত শক্তি দান করবে।
কিন্তু এরূপ নারকীয় উত্তাপে প্রকৃতির সবকিছু বাষ্পীভূত হয়ে যায়, পরিণত হয় গ্যাসে—প্লাজমায়। তাহলে যে যন্ত্রটিতে ডিউটেরিয়াম গরম করা হবে তা-ও গ্যাস হয়ে যাবে? অবশ্যই। তার মানে, কিছুই করা যাবে না? সুখের বিষয় যে, আসলে তা কিন্তু ততটা নৈরাশাজনক নয়।
ব্যাপারটি এই যে, প্লাজমা হচ্ছে পদার্থের কণিকা আর টুকরোর মিশ্রণ। ইলেকট্রন, নিউট্রন, নিউক্লিয়ার টুকরো এবং পরমাণুর আস্ত আস্ত নিউক্লিয়াস। এর সবগুলোই বৈদ্যুতিক চার্জযুক্ত। বিজ্ঞানীরা এই সুযোগটাই নিলেন। তাঁরা প্লাজমাকে চুম্বক ক্ষেত্রে (ম্যাগনেটিক ফিল্ডে) ধরে রাখার সিদ্ধান্ত নিলেন।
চুম্বক ক্ষেত্র কী? সঙ্গে সঙ্গে এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়। তবে চেষ্টা করা যাক। তুমি নিশ্চয়ই চুম্বক দেখেছ। ধাতুর এই টুকরোটি লোহার সবকিছু (পেরেক, পিন, ক্লিপ) নিজের দিকে টানে। নিজেও লোহার সঙ্গে আটকে থাকে। চুম্বকের চারপাশে শক্তিরেখা আছে সবসময়, তা লৌহচূর্ণ থাকুক আর নাই বা থাকুক। চূর্ণগুলো স্রেফ অদৃশ্য রেখাগুলোই ডেভেলপ করে ফোটোর কাগজে ডেভেলপার যেমন ছবি ডেভেলপ করে তা অনেকটা তারই মতো।
শক্তিরেখার এই জালটিই চার্জযুক্ত প্রতিটি কণাকে নির্দিষ্ট পথে চলতে বাধ্য করে। তাকে যেদিকে ইচ্ছা সেদিকে উড়তে দেয় না। চুম্বকমুষ্টি বিভিন্ন দিকে উড়ন্ত প্লাজমা চেপে সরু ফিতার মতো করে রাখে। ফিতা ও যন্ত্রের দেয়ালের মাঝে শূন্যতা দেখা দেয়। এতে দেয়ালগুলো আস্ত ও অক্ষত থেকে যায়।
চুম্বকের চাপ (ম্যাগনেটিক প্রেসার) আরও একটি ভালো কাজ করে। নিউক্লিয়সগুলো যাতে একত্রে মিলিত হতে শুরু করে তার জন্য ওগুলোকে সংখ্যায় অনেক হতে হবে। তাহলেই নিউক্লিয়াসগুলো সহজে পরস্পরকে খুঁজে পেতে পারে। চুম্বক ক্ষেত্র নিউক্লিয়াসগুলোকে একটি স্তূপে জড় করে, আগে হোক পরে হোক তারা পরস্পরের সঙ্গে ধাক্কা খায়, একত্রে মিলিত হয় এবং শক্তি নিঃসৃত করে।
প্লাজমাকে বশীভূত করা খুবই কঠিন কাজ। চুম্বক জালে তা নিরবচ্ছিন্নভাবে ছিদ্র খুঁজে বেড়ায়, ছিদ্র যত করেই হোক না কেন তাতে কিছু এসে যায় না। যেই কোনো ছিদ্র খুঁজে পায়, অমনি তা প্রবল বেগে বাইরের দিকে হটতে থাকে। ডিউটেরিয়ামের নিউক্লিয়াসগুলো—আর এগুলোর জন্যই বোনা হয় চুম্বক জালটি—তখন বিভিন্ন দিকে উড়ে যায় এবং আবার সবকিছু আরম্ভ করতে হয় একেবারে শুরু থেকে।
সেই অন্য বিজ্ঞানীরা নিউক্লিয়াস থেকে শক্তি পাওয়ার অন্যান্য উপায়ও খুঁয়েছেন। যেমন সোভিয়েত পদার্থবিদ আকাদেমিশিয়ান নিকোলাই বাসোড অনুসৃত উপায়টির বিষয়ে বলা যাক। ভারী পানির ছোট্ট একটা ফোঁটা, যা ডিউটেরিয়ামের পরমাণু দ্বারা সম্পৃক্ত, ঠান্ডায় জমানো হয়।
ফলে সেটি পিনের অগ্রভাগের সমান আয়তনের ক্ষুদ্র এক টুকরো বরফের আকার ধারণ করে। গুটিকাটির ওপর ছাড়া হয় লেজার রশ্মি। লেজার—এ হচ্ছে ক্রিস্ট্যাল বা গ্যাসযুক্ত পাইপ, যা বিপুল শক্তিসম্পন্ন আলোকরশ্মি দিয়ে ‘গুলিবর্ষণ করে’।
রশ্মির আঘাতে গুটিকাটি অত্যধিক মাত্রায় উত্তপ্ত হয়ে উঠে। তার মধ্যে অবস্থিত ডিউটেরিয়াম নিউক্লিয়াসগুলো একত্রে মিলিত হতে এবং শক্তি নিঃসৃত করতে শুরু করে। ছোট্ট একটি বিস্ফোরণ ঘটে। রশ্মির তলায় নিয়ে আসা হয় নতুন একটা নিশানা (অর্থাৎ গুটিকা), তারপর আরও একটা।
ফলে একটির পর একটি বিস্ফোরণ ঘটতেই থাকে। প্রতিটি বিস্ফোরণ আলাদাভাবে দেয় অল্প শক্তি, তবে সবগুলো একসঙ্গে দেয় অনেক। বিজ্ঞানীরা হিসাব করে দেখেছেন যে যথেষ্ট পরিমাণ শক্তি পেতে হলে প্রতি সেকেন্ডে কমপক্ষেও পারমাণবিক জ্বালানিযুক্ত কুড়িটা গুটিকা ‘বিস্ফোরণ করা’ প্রয়োজন।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।