জুমবাংলা ডেস্ক: মিশরের পিরামিডের কথা কে শুনেনি! ছোট-বড় মিলিয়ে মিশরে প্রায় ১৩৮টি পিরামিড রয়েছে। সবচেয়ে বড় এবং আকর্ষণীয় হচ্ছে গিজার পিরামিড। এটি খুফুর পিরামিড হিসেবেও পরিচিত। এগুলোর অধিকাংশই বানানো হয়েছিল প্রাচীন ও মধ্যকালীন ফারাওদের রাজত্বকালে তাদের ও তাদের স্ত্রীদের সমাধিসৌধ হিসেবে।
খ্রিষ্টপূর্ব প্রায় ২৫০০ হাজার বছর আগে এই পিরামিডের সৃষ্টি বলে ধারণা করা হয়। সবচেয়ে বড় খুফুর পিরামিডের উচ্চতা প্রায় ৪৮১ ফুট। এটি ৭৫৫ বর্গফুট জমির ওপর অবস্থিত। কিন্তু এখনো রহস্য, সেই পিরামিড তৈরি করেছিলেন কারা? এই নিয়ে একাধিক মত রয়েছে।
২০১০ সালে সেই পিরামিড প্রস্তুতকারী কর্মীদের সমাধি উদ্ধার করা হয়েছিল। তার পরেই পিরামিড নিয়ে অনেক তথ্য প্রকাশ্যে আসে। ভেঙে যায় প্রাচীন কিছু ধারণা। পিরামিড প্রস্ততকারীরা কি ক্রীতদাস ছিল? এই নিয়ে ভুল ধারণাও ভেঙেছে। জাহি হাওয়াসের নেতৃত্বাধীন প্রত্নতত্ত্ববিদদের একটি দল গিজায় একাধিক সমাধি উদ্ধার করেন। তারা জানায়, ওই সমাধিগুলি পিরামিড প্রস্তুতকারী কর্মীদের। খুফু এবং খাফরের সমাধিগুলো তৈরি করেছিলেন এই কর্মীরা।
১৯৯০ সালে একাধিক সমাধি আবিষ্কার করেছিলেন প্রত্নতত্ত্ববিদেরা। সেগুলো খ্রিস্টের জন্মের ২ হাজার ৬৪৯ থেকে ২ হাজার ৩৭৪ বছর আগের। চতুর্থ এবং পঞ্চম শাসনকারী বংশের আমলে সে সব তৈরি হয়েছিল। সেই সমাধির মতোই বেশ কিছু সমাধির হদিস পান জাহি।
বছরের পর বছর ধরে তৈরি হয়েছিল পিরামিড। তৈরি করেছিলেন হাজার হাজার শ্রমিক। ইতিহাসবিদদের মতে, কর্মীদের কেন্দ্র করে গিজার পাশেই গড়ে উঠেছিল নতুন নগরসভ্যতা। তৈরি হয়েছিল বাড়ি, বেকারি, প্রেক্ষাগৃহ। সবই কর্মীদের জন্য। যে কর্মীরা পিরামিড তৈরি করতেন, তাদের সমাধিস্থলও তৈরি করা হয়েছিল। সেই সমাধিস্থল ছিল সম্রাটের পিরামিডের ঠিক পাশে। প্রত্নতত্ত্ববিদ জাহির মতে, এই সমাধি আবিষ্কারের পর একটি বিষয় স্পষ্ট হল যে, পিরামিড প্রস্তুতকারীরা ক্রীতদাস ছিলেন না।
ইতিহাসবিদদের একাংশ মনে করেন, ক্রীতদাসদের দিয়ে মিশরের সম্রাট এই পিরামিড তৈরি করাতেন। এর মধ্যে অন্যতম ইতিহাসবিদ হেরোডোটাস। তিনি দাবি করেছিলেন, ‘ক্রীতদাসদের দিয়ে তৈরি করানো হয়েছিল পিরামিড। তার পর অনেকেই সেই মত পোষণ করেছিলেন।’ কিছু কিছু মিশর বিশেষজ্ঞের আবার দাবি ছিল, ইহুদি দাসদের দিয়ে এই পিরামিড তৈরি করা হয়। অনেকে মনে করেন, ‘ওল্ড টেস্টামেন্ট বুক অফ এক্সোডাস’ থেকেই এই ধারণার জন্ম। বেশ কিছু হলিউড ছবিতেও এই বিষয়টি দেখানো হয়েছিল।
কিন্তু জেরুজালেমের এক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ববিদ আমিহাই মাজার এই দাবি মানতে চাননি। তিনি জানিয়েছেন মিশরে যখন পিরামিড তৈরি হয়েছিল, তখন ইহুদিদের কোনো অস্তিত্বই ছিল না। পিরামিড প্রস্তুতকারী শ্রমিকরা ক্রীতদাস ছিলেন, এই ধারণাই ভেঙে যায় ওই কর্মীদের সমাধির হদিসের পর। জাহি বলেন, ‘রাজার পিরামিডের পাশেই কর্মীদের পিরামিড। এর থেকেই স্পষ্ট যে, ক্রীতদাসেরা এই পিরামিড তৈরি করেননি। কর্মীরা ক্রীতদাস হলে সম্রাটের পাশে তাদের সমাধি হত না।’
জাহি দাবি করেছেন, পিরামিড প্রস্তুতকারীরা ছিলেন বেতনভুক্ত শ্রমিক। পিরামিড প্রস্তুত করার বদলে তাদের টাকা দেওয়া হতো। দিতেন সে দেশের সম্রাট। সম্রাটের সমাধির পাশে ওই কর্মীদের যে সমাধি মিলেছিল, তার মধ্যে একটি ছিল ইদু নামে এক ব্যক্তির। তিনিও পিরামিড তৈরি করেছিলেন বলে মত প্রত্নতত্ত্ববিদদের।
ইদুর সমাধি আয়তাকার। মাটির ইটের তৈরি। তার উপর ঢালাই করা ছিল। সমাধির মধ্যে অনেক কুঠুরি ছিল। সেই কুঠুরিগুলো সাদা চুনাপাথরে তৈরি। খননকারী দলের মাথায় ছিলেন আদেল ওকাশা। তিনি বলেন, প্রত্যেক সমাধির মাথা ভল্টের মতো। মেমফিসদের ধর্মীয় বিশ্বাস মেনেই তৈরি এই সমাধি। এর আকৃতি দেখেই প্রত্নতত্ত্ববিদদের ধারণা, এগুলো মিশরের চতুর্থ শাসক বংশের আমলে তৈরি। মিশরের গ্রাম দাহশুরের স্নেফরুর পিরামিডের পাশেও এই একই ধরনের সমাধি দেখা গেছে।
ইদুর সমাধির পশ্চিমে রয়েছে আরো কিছু সমাধি। ভেতর রয়েছে কফিনও। ইদুর সমাধির দক্ষিণে রয়েছে মাটির ইটের তৈরি একটি সমাধি। তার ভেতরে রয়েছে একাধিক কুঠুরি। ওই প্রত্যেকটির মধ্যে রয়েছে একটি করে কঙ্কাল। পাশে মাটির তৈরি কোনো পাত্রের ভাঙা অংশ। সমাধির মধ্যে কোনো সোনা, রত্ন বা দামি জিনিস ছিল না। ফলে এত হাজার বছর ধরে সেগুলিতে ডাকাতি হয়নি। সমাধির মধ্যে কঙ্কাল মিলেছে। মমি নয়। অর্থাৎ, শ্রমিকদের দেহ মমি করে রাখা হতো না।
সমাধিতে কঙ্কালের মাথা ছিল পশ্চিমে, পা পূর্ব দিকে। প্রাচীন মিশরীয় ধর্মমতে এ ভাবেই দেহ রাখা হত। পাশে রাখা থাকত বেশ কিছু বয়াম, যাতে খাবার রাখা থাকত। মিশরীয়রা মনে করতেন, মৃত্যুর পর সে সব খেতেন মৃতেরা। শ্রমিকদের সমাধিতে কিছু মাটির পাত্রের ভগ্নাংশ মিলেছে।
পিরামিড প্রস্তুতকারী কর্মীদের সমাধির হদিস মেলার পর সেই নিয়ে গবেষণা শুরু হয়েছে। ওই কর্মীদের জীবনযাপন কেমন ছিল, আর্থিক অবস্থা কেমন ছিল, সে সব খতিয়ে দেখতে শুরু করেন ইতিহাসবিদরা। তারা জানান, মিশরের বদ্বীপ এবং উত্তরভাগের বাসিন্দারা রোজ এই শ্রমিকদের জন্য খাবার পাঠাতেন।
গবেষকদের মতে, পিরামিড তৈরি করা শ্রমিকদের খাওয়ার জন্য প্রতিদিন ২১টি মহিষ এবং ২৩টি ভেড়া পাঠানো হত। পাঠাতেন মিশরের বদ্বীপ এবং উত্তরভাগের বাসিন্দারা। মনে করা হত, বছরের পর বছর প্রায় নিয়মিত এই খাবার পাঠানো হত।
গবেষকদের মতে, পুষ্টিগুণসম্পন্ন খাবারই পাঠানো হত শ্রমিকদের। যাতে তারা ভাল ভাবে কাজ করতে পারেন। স্থানীয়রা জানতেন, দুর্বলদের পক্ষে ওই বিপুল কাজ করা সম্ভব নয়। জাহির মতে, তিন মাসের শিফট ভাগ করা থাকত শ্রমিকদের জন্য। তিন মাস কাজ করে ছুটি নিতেন। যদিও ওই শ্রমিকেরা রোজ কী খেতেন, সেই বিষয়ে এখনও গবেষণা চলছে। ওই পশুদের দুধ না কি মাংস খেতেন, সঙ্গে কোনো শস্য খেতেন কি না, তা এখনও জানা যায়নি। সঙ্গে শস্য খেলে তা আসত কী ভাবে? উঠছে প্রশ্ন।
অনেক কঙ্কালের মধ্যে আর্থারাইটিসের লক্ষণ দেখা যায়। অর্থাৎ জীবৎকালে সেই ব্যক্তির বাত ছিল। মনে করা হয়, অতিরিক্ত খাটুনির কারণেই এ রকম হত। শরীরে আরও রোগের চিহ্নও মিলেছে।
প্রত্নতত্ত্ববিদ জাহির মতে, যে সব বাসিন্দারা এই শ্রমিকদের জন্য খাবার পাঠাতেন, তাদেরকে কর দিতে হত না। জাতীয় প্রকল্পে সাহায্য করার কারণে তাদের কর মওকুফ করা হত।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।