১৮৮৪ সালের নভেম্বর মাস। যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদপত্র নিউইয়র্ক টাইমস-এ ধারাবাহিকভাবে ছাপা হচ্ছিল দারুণ এক প্রতিবেদন। সুইস ‘জ্যোতির্বিদ’ লুই ভিলমার আর্ন্ডট (Louis Vilmar Arndt) দাবি করেন, ঘনকাকৃতির একটি গ্রহ আবিষ্কার করেছেন তিনি। বেশি দূরে নয়, গ্রহটির কক্ষপথ নেপচুনের পরেই। ১০০ বছরও পার হলো না, এমন আরেকটি আবিষ্কার সামনে এল। এবারে শুধু দাবি করেই ক্ষান্ত হলেন না আবিষ্কারক। আঁকলেন গ্রহের মানচিত্র ও সেখানকার বাসিন্দাদের প্রতিরূপ।
এরপর পেরিয়ে গেছে বহুদিন। এখন পর্যন্ত নেপচুনের বাইরে কোনো ঘনকাকৃতির গ্রহ খুঁজে পাওয়া যায়নি। শুধু তাই নয়, অত্যাধুনিক সব যন্ত্র ব্যবহার করেও বিজ্ঞানীরা ঘনকাকৃতির কোনো গ্রহ খুঁজে পাননি। সৌরজগতের প্রায় সব গ্রহের পাশ দিয়ে উড়ে গেছে মানুষের তৈরি ছোট-বড় একাধিক নভোযান। গ্রহগুলোর চাঁদও পর্যবেক্ষণ করেছেন বিজ্ঞানীরা। সব গোলাকার। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন?
এর উত্তর জানতে সময়ের পেছনে যেতে হবে আমাদের। প্রায় সাড়ে ৪ কোটি বছর আগে। নীহারিকা নামের ধুলো ও গ্যাসের বিশাল মেঘ থেকে সবে তৈরি হচ্ছে উত্তপ্ত একটি নক্ষত্র—সূর্য। এই নক্ষত্রের প্রবল মহাকর্ষ শক্তি আশপাশের সব ধূলিকণা টেনে নিয়েছে নিজের মধ্যে। নক্ষত্র থেকে অপেক্ষাকৃত দূরের মেঘগুলো; যেগুলো সরাসরি নক্ষত্রে পড়ে যায়নি, সেগুলো পরিণত হয়েছে ধূলিমেঘের এক ঘূর্ণমান বলয়ে। এখানে নক্ষত্রের মহাকর্ষ শক্তি এত বেশি নয় যে টেনে নিজের মধ্যে নিয়ে যাবে। আবার শূন্যও নয় যে হারিয়ে যাবে দূর মহাকাশে। ভারসাম্যপূর্ণ এ বলয় তাই ঘুরতে থাকে নক্ষত্রের চারপাশে।
কিছুকাল পরেই এই ঘূর্ণমান ধূলি ও গ্যাসমেঘের বিভিন্ন অংশ বড় বড় স্তূপ আকারে জড় হতে লাগল। এসব স্তূপ যত বড় হচ্ছিল, তত শক্তিশালী হচ্ছিল তাদের মহাকর্ষ বিন্দু। আবার মহাকর্ষ বিন্দু শক্তিশালী হওয়ার কারণে চারপাশে আরও ধূলিকণা যোগ হচ্ছিল স্তূপগুলোতে। এ এক দারুণ চক্র। এভাবে তৈরি হলো গ্রহ। মহাকর্ষ বিন্দুর চারপাশে ধূলিকণা যোগ হচ্ছিল সমআকর্ষণে। সূর্যের আকর্ষণে যে ঘূর্ণন, তা তো ছিলই।
দুইয়ে মিলে এসব স্তূপ হতে লাগল সুষম গোলক আকৃতির। রুটি বানানোর সময় আমরা আটার দলা এভাবে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে গোলাকার বানাই। যাহোক, পরে গ্রহের আকারে কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে নানা কারণে। সে অন্য আলোচনা। অল্প কথায়, গ্রহ গোলাকার হওয়ার কারণ এটাই। একদম এক বাক্যে যদি বলি, গোলাকার যেকোনো বস্তুর সবটাজুড়ে মহাকর্ষ বল সুষমভাবে কাজ করে। সে জন্যই গ্রহগুলো গোলাকার।
পৃথিবী গোলাকার হওয়ার কারণে এর পৃষ্ঠের সবখানেই অভিকর্ষ বলের মান প্রায় সমান। এ জন্য গোলকের ভরকেন্দ্র থাকে একদম কেন্দ্রে। আর কেন্দ্র থেকে যেকোনো দিকে গোলক পৃষ্ঠের দূরত্ব সমান। ফলে আপনি পৃথিবীর যেখানেই থাকুন না কেন, সমতল ভূমিতে পৃথিবীর কেন্দ্র বরাবর খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারেন।
কিন্তু পৃথিবীর অভিকর্ষ বল পৃষ্ঠের সবজায়গায় সমান না হলে কী হতো? এ কথা বলছি, কারণ ঘনকের ভরকেন্দ্র থেকে এর পৃষ্ঠের সবদিকের দূরত্ব সমান নয়। ঘনকের ভরকেন্দ্র থেকে এর কোনো পৃষ্ঠতলের মধ্যবিন্দুর দূরত্ব সবচেয়ে কম। পৃষ্ঠতলের মধ্য বিন্দু থেকে যত সরে আসা যায়, ততই ভরকেন্দ্রের সঙ্গে দূরত্ব বাড়তে থাকে। কর্ণে গিয়ে দূরত্ব হয় সর্বোচ্চ। ভরকেন্দ্র থেকে পৃষ্ঠের দূরত্বের সঙ্গে কোনো গ্রহের মহাকর্ষের নিবিড় সম্পর্ক আছে। পৃষ্ঠের দূরত্ব যত বাড়বে, তত কমবে গ্রহের মহাকর্ষ বলের মান। টান বাড়বে কেন্দ্রের দিকে।
আমরা এখন পৃথিবীকে একটি ঘনক আকৃতির গ্রহ হিসেবে কল্পনা করছি। পৃথিবী ঘনকের মতো হলে আসলে কী হতো, তাই জানার চেষ্টা করছি বিজ্ঞান ব্যবহার করে। বাস্তবে কোনো গ্রহের ঘনকাকৃতি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। অন্তত বিজ্ঞান এখন পর্যন্ত আমাদের সেটাই বলে। কিন্তু তাই বলে কল্পনা করতে তো দোষ নেই।
নতুন এই পৃথিবীতে বসবাস করতে হলে প্রথমে আপনাকে ঘনকের যেকোনো এক পৃষ্ঠে থাকতে হবে। পৃথিবীটা দেখতে এখন রুবিকস কিউবের মতো। রুবিকস কিউবে যেমন ছয়টি সমতল পৃষ্ঠ আছে, এখানেও তাই।
ধরা যাক, আপনি একটি পৃষ্ঠে আছেন। সমস্যা হলো, আপনি চাইলেই পৃষ্ঠের যেকোনো জায়গায় থাকতে পারবেন না। কারণটা একটু আগেই বলেছি। মহাকর্ষ বলের অসম বন্টন। ঘনকের প্রতিটি পৃষ্ঠের কেন্দ্রে মহাকর্ষ বল হবে সমান। কেন্দ্র থেকে যত প্রান্তের দিকে যাবেন, তত বেশি টান অনুভব করবেন কেন্দ্রের দিকে। মনে হবে যেন খাড়া পাহাড় বেয়ে উঠছেন। সেই সঙ্গে পাতলা হতে থাকবে প্রান্তের দিককার বায়ুমণ্ডল।
একদম প্রান্তে কোনো বায়ুমণ্ডল থাকবে না বললেই চলে। বায়ুমণ্ডলের তারতম্যের কারণে কেন্দ্র থেকে প্রান্তের দিককার অঞ্চল হতে থাকবে আরও রুক্ষ ও মরুময়। সেই পরিবেশে জীবন ধারণ করা হবে কঠিন। একবারে প্রান্তে, অর্থাৎ ঘনকাকার পৃথিবীর কর্ণগুলো হবে বাসের অযোগ্য। আবার কেন্দ্রের দিকে টান বেশি থাকায় পৃথিবীর সাগর-মহাসাগরগুলোও তৈরি হবে ৬টি পৃষ্ঠের কেন্দ্র বরাবর।
এবার আসা যাক জলবায়ুর কথায়। ঘনকাকার পৃথিবীর জলবায়ু নির্ভর করত পৃথিবী কীভাবে ঘুরছে, তার ওপর। যদি দুটি পৃষ্ঠের কেন্দ্র বরাবর অক্ষ ধরে পৃথিবী ঘোরে, তবে প্রতিটি সমতল পৃষ্ঠের জলবায়ুর খুব একটা পরিবর্তন হতো না এখনকার চেয়ে। তবে কিছুটা চরমভাবাপন্ন হতো। অক্ষের দুটি পৃষ্ঠে থাকত এখনকার মেরু অঞ্চলের মতো আবহাওয়া। বাকি চার পৃষ্ঠ হতো এখনকার বিষুবীয় অঞ্চলের মতো। কারণ, এ চারটি পৃষ্ট সমানভাবে সূর্যের আলো পেত। কম পেত মেরুর দুটি পৃষ্ঠ।
তবে পৃথিবী কর্ণ বরাবর অক্ষ ধরে ঘুরলে ঘটনা ভিন্ন হতো। তখন পৃথিবীতে বিরাজ করত এখনকার চেয়ে অনেক সহনশীল আবহাওয়া। চরম আবহাওয়াকে বিদায় জানাতে পারতেন চিরতরে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, এর সঙ্গে বিষুবীয় অঞ্চলের বৈচিত্র্যময় আবহাওয়াকেও বিদায় জানাতে হতো। এরকম ঘোরার ফলে অতিরিক্ত পাওনা হিসেবে কর্ণ-মেরুতে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা হতো মহাকাশে ভ্রমণের মতো।
মহাকর্ষ ভূপৃষ্ঠের চারদিকে বায়ুমণ্ডলকে ধরে রাখে। ঘনকাকার পৃথিবীর মহাকর্ষ (বা অভিকর্ষ) বলের মান যেহেতু এর সমতল পৃষ্ঠগুলোর কেন্দ্রের দিকে বেশি, তাই বায়ুমণ্ডলের ঘনত্বও বেশি থাকবে এখানে। একই কারণে প্রান্তের দিকে বায়ুমণ্ডল হবে পাতলা, যেটা আগেই বলেছি। অদ্ভুত সেই পৃথিবী বসবাসের অযোগ্য হতো না হয়তো, কিন্তু এক পৃষ্ঠ থেকে অন্য পৃষ্ঠে যাওয়া সহজ হতো না। হয়তো মহাকাশযানের প্রয়োজন পড়ত।
কেন্দ্রের দিকে সমুদ্রের ধার ধরে বাস করত মানুষ। পৃথিবীর বাসযোগ্য স্থলভাগের পরিমাণ যে বেশ কমে যেত, তা বলা বাহুল্য। জীববৈচিত্র্য ঠিক কেমন হতো, তা জানার সুযোগ আমাদের আপাতত নেই। তবে জীবন যে গোলাকার পৃথিবীর চেয়ে কঠিন হতো, তাতেও সন্দেহ নেই।
ঘনকাকার বিচিত্র পৃথিবীতে কি ‘ভূগোল’ নামের কোনো বিষয় থাকত? নাকি ‘ভূ-ঘনক’ নামে কিছু একটা পড়তে হতো? সেটাও একটা ভাবার মতো বিষয় বটে! এবারে আসল কথাটা বলি। পৃথিবীর ঘনকাকৃতি হওয়ার কোনো আশঙ্কা সুদূর ভবিষ্যতেও নেই। এমনকি কোনো গ্রহেরই এমন হওয়ার সম্ভাবনা নেই বলে জানান বিজ্ঞানীরা। তাই সেটা নিয়ে দুশ্চিন্তারও সুযোগ নেই।
আমাদের এখন যা আছে, অর্থাৎ এই গোলাকার পৃথিবীটা সুন্দর করে তুলতে পারি আমরা। এ জন্য সবার নিজ নিজ জায়গা থেকে এ গ্রহের প্রকৃতি ও পরিবেশ ভালোবাসতে হবে। বন্ধ করতে হবে সব কলহ-যুদ্ধ। তবেই পৃথিবীটা বাসযোগ্য থাকবে, সুন্দর এক পৃথিবী দিয়ে যেতে পারব পরের প্রজন্মকে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।