বছরে একবার পৃথিবী ঘুরে আসে সূর্যের চারপাশে। কথাটা উল্টোভাবেও বলা যায়। পৃথিবীর সূর্যের চারপাশে একবার ঘুরে আসলে এক বছর হয়। এর অর্থ, আমরা ইতিমধ্যেই প্রচণ্ড বেগে ঘুরছি সূর্যকে কেন্দ্র করে। তারপরও চলুন, পৃথিবীর বার্ষিক গতি আরও বাড়িয়ে দেওয়া যাক।
তথ্য ও যুক্তির ভিত্তিতে আসুন কল্পনা করার চেষ্টা করি, পৃথিবী আলোর বেগে ছুটলে কী হতো। পৃথিবীর মতো স্থির ভরের বস্তু কি আদৌ চলতে পারত আলোর বেগে? কিংবা আলোর বেগের কাছাকাছি গেলে কি বদলে যেত পৃথিবীর ভর? আর পৃথিবীর বাসিন্দা, অর্থাৎ আমাদের অবস্থাই-বা কেমন হতো উচ্চবেগে ছুটে চলা সেই পৃথিবীতে?
আমাদের মহাবিশ্বের কোনো কিছুই আলোর চেয়ে বেশি বেগে চলতে পারে না। শূন্য মাধ্যমে আলোর বেগ প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ৩ লাখ কিলোমিটার। পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্ব প্রায় ১৫ কোটি কিলোমিটার। এই দূরত্ব পাড়ি দিয়ে সূর্য থেকে আলো পৃথিবীতে পৌঁছাতে সময় লাগে প্রায় ৮ মিনিট। আর চাঁদ থেকে আলো প্রতিফলিত হয়ে আমাদের কাছে পৌঁছাতে সময় লাগে মাত্র ১ সেকেন্ড।
স্থির ভর আছে, এমন কিছুকে আলোর বেগে গতিশীল করা সম্ভব নয়। কারণটা সহজ, ভরযুক্ত কোনো বস্তুকে আলোর বেগে গতিশীল করার জন্য গতি যত বাড়ানো হয়, বস্তুর ভরও তত বাড়ে। আলোর সমান বেগ হয়ে গেলে বস্তুর ভর অসীম হয়ে যায়। লরেঞ্জ রূপান্তর থেকে গতি ও ভরের এই সম্পর্কটি আমরা দেখতে পাই।
বাস্তবে কোনো বস্তুর ভর অসীম হতে পারে না। আর সেটা হলেও, অসীম ভরের কোনো বস্তুকে নড়াতে হলে অসীম পরিমাণ শক্তি প্রয়োজন। এটাও বাস্তবে অসম্ভব। অন্তত এখন পর্যন্ত মহাবিশ্বকে আমরা যতটুকু বুঝতে পারি, তাতে সম্ভব নয়। স্থির ভরের কোনো বস্তু তাই সর্বোচ্চ আলোর ৯৯.৯৯ শতাংশ বেগে চালানো সম্ভব।
কথা হলো, পৃথিবী যদি এমন উচ্চবেগে সূর্যের চারপাশে ঘুরত, তাহলে কী হতো? আসুন, যৌক্তিক কল্পনার সাহায্যে বিষয়টি দেখার চেষ্টা করি। এ মুহূর্তে পৃথিবী প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ৩০ কিলোমিটার বেগে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করছে। আমাদের কাছে বেশ দ্রুত মনে হলেও আলোর তুলনায় পৃথিবীর বেগ আসলে খুবই সামান্য। মাত্র ০.০১ শতাংশ। বুঝতেই পারছেন, তাত্ত্বিকভাবে পৃথিবীর গতিবেগ আরও বাড়ানোর সুযোগ আছে।
গতি বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হতো বিড়াম্বনা। যেমন পৃথিবীর বেগ যদি সেকেন্ডে মাত্র ৪২ কিলোমিটার হতো, তাহলে সূর্যের মহাকর্ষ বল ছিন্ন করে ফেলতে পারত পৃথিবী। সেক্ষেত্রে নীল এই গ্রহটি নিজ কক্ষপথ ছেড়ে ছুটত অসীম পানে। পৃথিবী পরিণত হতো শীতল, প্রাণহীন এক ভবঘুরে গ্রহে। নক্ষত্রের তাপ আর পৃথিবীকে উষ্ণ করে তুলতে পারত না।
এ বেগে তিন বছর চললে পৃথিবী পৌঁছে যেত নেপচুনের কাছাকাছি। সেজন্য অবশ্য শনি ও বৃহস্পতির মতো গ্রহকে নিরাপদে পাশ কাটাতে হবে। যাত্রাপথে দানবীয় এসব গ্রহের সঙ্গে ধাক্কা খেলে সেখানেই থেমে যাবে পৃথিবীর ছুটে চলা। বিলীনও হয়ে যেতে পারে অস্তিত্ব। ধরে নিই, কোনো সমস্যা ছাড়াই পৃথিবী এ গতিতে সৌরজগতের বাইরে চলে গেল। পরিণতি কী হবে, সেটা তো আগেই বলেছি। এবার বলি, এ বেগে গতিশীল হওয়ার জন্য কেমন শক্তি প্রয়োজন।
যেকোনো মানুষকে আলোর ৯০ শতাংশ বেগে গতিশীল করতে চাইলে প্রয়োজন হবে পৃথিবীতে ব্যবহৃত প্রায় ৫ দিনের মোট শক্তি। বুঝতেই পারছেন, পুরো পৃথিবীকে এ বেগে চালাতে হলে কী বিশাল পরিমাণ শক্তির প্রয়োজন। এত শক্তি কোথায় পাওয়া যাবে?
এর একটা উপায় হতে পারে, অতি দ্রুতগতির কোনো নক্ষত্রের গতিপ্রক্রিয়া অনুসরণ করা। মহাবিশ্বে এদের খুঁজে পাওয়া বেশ কঠিন। এদেরকে বলা হয় হাইপার ভেলোসিটি স্টার। আলোর প্রায় ৩৩ শতাংশ বেগে গতিশীল থাকতে পারে এসব নক্ষত্র। আমাদের পুরো গ্যালাক্সিতে এ ধরনের নক্ষত্র আছে মাত্র ১ হাজারটির মতো। এর কারণ, অতি বেগসম্পন্ন এসব নক্ষত্রের জন্য বিশেষ পরিবেশ প্রয়োজন। ব্ল্যাকহোলকে কেন্দ্র করে ঘোরে এসব নক্ষত্র।
তবে একক ব্ল্যাকহোল নয়। দুটি ব্ল্যাকহোল একে অপরকে ঘিরে চক্কর খাচ্ছে, এমন ব্ল্যাকহোলের পাশে এদের পাওয়া যায়। দুটি ব্ল্যাকহোল একে অন্যকে প্রদক্ষিণ করার কারণে গতি বাড়তে থাকে, যতক্ষণ না তারা মিলিত হচ্ছে। ব্ল্যাকহোল দুটি একত্রিত হলে মহাকর্ষ তরঙ্গে ওঠে এক বিশাল ঢেউ। এই ঢেউয়ের ধাক্কায় পাশে থাকা নক্ষত্র প্রচণ্ড বেগে মহাশূন্য ধরে ছোটা শুরু করে।
পৃথিবীর বেগ আলোর কাছাকাছি নিতে হলে এমন এক জোড়া ব্ল্যাকহোলের আশেপাশে যেতে হবে আগে পৃথিবীকে। তারপর তাদের মধ্যকার সংঘর্ষের কারণে পৃথিবী ছুটবে আলোর কাছাকাছি বেগে। খুবই সহজ ব্যাপার। তবে সমস্যা এখনও শেষ হয়নি। আলোর বেগে নাহয় পৃথিবীকে গতিশীল করা গেল, কিন্তু পৃথিবীর উপরিভাগের অবস্থা কী হবে?
উচ্চগতিতে চললে পৃথিবীর ভর বেড়ে যেত, এ কারণে এর অভিকর্ষজ ত্বরণও বাড়ত। ফলে, ওজন বেড়ে যেত পৃথিবীবাসীর। উচ্চ গতিতে চলার কারণে রাতের আকাশে আমরা আর নক্ষত্র দেখতে পেতাম না। কারণটা ডপলার ক্রিয়া। এ ক্রিয়ার ফলে যখন কোনো তরঙ্গ আমাদের দিকে ছুটে আসে বা আমরা কোনো তরঙ্গের দিকে ছুটে যাই, তখন সে তরঙ্গের দৈর্ঘ্য কমে যায়। তরঙ্গের দৈর্ঘ্য কমলে বেড়ে যায় কম্পাঙ্ক। আর কোনো তরঙ্গ আমাদের থেকে দূরে ছুটে গেলে সে তরঙ্গের দৈর্ঘ্য বেড়ে যায়। সেক্ষেত্রে কমে যায় কম্পাঙ্ক।
উচ্চবেগে ছোটার কারণে পৃথিবীতে আসা সাধারণ আলো পরিণত হতো উচ্চ কম্পাঙ্কের আলোতে। দৃশ্যমান আলোর বদলে পৃথিবীতে এসে পড়ত এক্স-রের মতো উচ্চ কম্পাঙ্কের তড়িৎ চৌম্বকীয় বিকিরণ। আমরা যেহেতু খালি চোখে এক্সরে দেখতে পাই না, তাই আকাশ হতো পুরোপুরি অন্ধকার। তবে ক্রমাগত এক্স-রে বিকিরণের মাঝে থাকায় গণহারে ক্যান্সারের মতো জটিল স্বাস্থ্যগত সমস্যার মুখোমুখি হতো মানবজাতি।
নক্ষত্র থেকে এখনও এসব উচ্চ কম্পাঙ্কের তড়িৎ চৌম্বকীয় বিকিরণ এসে পৌঁছায় পৃথিবীতে। কিন্তু পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল যথেষ্ট পুরু হওয়ায় এ বিকিরণ আর ভূপৃষ্ঠ পর্যন্ত আসে না। আলোর কাছাকাছি বেগে ছুটতে থাকা পৃথিবীতে বায়ুমণ্ডল বিলীন হওয়ার একটি আশঙ্কা আছে। সেক্ষেত্রে শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে পারত না জীবেরা। মারা পড়ত সব।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।