নিজস্ব প্রকিবেদক, গাজীপুর: বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের প্রাণভোমরা নারী শ্রমিকরা। তাদের আন্তরিক প্রচেষ্টা ও নিপুণ হাতের ছোঁয়ায় তৈরি হয় বিশ্বের বিভিন্ন নামীদামি ব্র্যান্ডের পোশাক। স্বল্প মূল্য, মানসম্মত পণ্য ও নির্ভরযোগ্যতার কারণে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশি পোশাকের বিপুল চাহিদা রয়েছে।
দেশের পোশাক খাতে শ্রমিকের অধিকাংশই নারী হলেও নেতৃত্বের জায়গায় তাদের অংশগ্রহণ খুবই কম। গাজীপুরের শিল্পাঞ্চল ঘুরে দেখা গেছে, বেশিরভাগ পোশাক কারখানায় নারী শ্রমিকরা উৎপাদন লাইনে কাজ করলেও ব্যবস্থাপনা বা নেতৃত্বের পদে পুরুষদেরই আধিপত্য।
শিল্প পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গাজীপুর জেলায় নিবন্ধিত কারখানার সংখ্যা ২ হাজার ১৭৬টি। এর মধ্যে ১ হাজার ১৫৪টি পোশাক কারখানা, যেখানে লাখ লাখ নারী শ্রমিক কাজ করছেন।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, অধিকাংশ কারখানায় প্রতিটি উৎপাদন লাইনে দুজন সুপারভাইজার ও একজন লাইনম্যান থাকেন। সাধারণত শ্রমিক পদ থেকেই এসব দায়িত্বে উন্নীত করা হয়। তবে, পুরুষদের সমান দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও অধিকাংশ নারী শ্রমিক এই দায়িত্ব নিতে অনীহা প্রকাশ করেন। অনেক নারী ১০-১২ বছর ধরে অপারেটর পদে থেকে যান, বিপরীতে অনেক পুরুষ কর্মী কম সময়ের মধ্যেই সুপারভাইজার বা লাইনম্যান হয়ে যান।
নারীরা নেতৃত্বের জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ, পরামর্শ বা সহায়তা খুব কমই পান। ফলে, অনেকেই নিজেকে নেতৃত্বের জন্য অযোগ্য মনে করেন, যদিও তাদের মধ্যে প্রকৃতপক্ষে নেতৃত্বের দক্ষতা রয়েছে।
উচ্চ পদ মানেই বড় দায়িত্ব, তাতে ভুল হলে চাকরি হারানোর আশঙ্কা। অনেক নারী নিরাপদ থাকার মানসিকতা থেকে নিচের পদে থেকেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। এর পেছনে রয়েছে পারিবারিক পিছুটান, সামাজিক ও কাঠামোগত প্রতিবন্ধকতা।
গাজীপুরের বিভিন্ন কারখানায় ছয় বছরের বেশি সময় ধরে কাজ করছেন এমন অর্ধশতাধিক নারী শ্রমিকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নেতৃত্ব দিতে না চাওয়ার পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে।
তারা বলছেন— শিক্ষাগত যোগ্যতা কম থাকা, সন্তানকে বেশি সময় দেওয়া, সংসারের দায়িত্ব পালন, ঝুঁকিমুক্ত থাকা, নারী অধিকার কর্মীর অভাব ও মাতৃত্বকালীন সময়ের চ্যালেঞ্জ।
লালমনিরহাট থেকে ১২ বছর আগে গাজীপুরে আসা মালেকা বেগম বলেন, “আমি সিনিয়র অপারেটর হিসেবেই ভালো আছি। সুপারভাইজার বা লাইনম্যানের দায়িত্ব নিতে চাই না। এসব দায়িত্ব অনেক বোঝা মনে হয়। জবাবদিহি ছাড়াও অতিরিক্ত সময় দিতে হয়। তার থেকে ভালো—কাজ শেষে পরিবারকে সময় দেওয়া।”
টাঙ্গাইলের সালমা খাতুন, যিনি ১৫ বছর ধরে গার্মেন্টসে কাজ করছেন, জানালেন, “দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি এই কাজ করে। সব কাজ পারি, কিন্তু দায়িত্ব নেওয়ার সাহস পাই না। পড়ালেখা নেই, কাগজপত্র বুঝতে পারি না। মেশিনকে চালানো সহজ, কিন্তু মানুষকে নয়।”
এক পোশাক কারখানার প্রশাসনিক কর্মকর্তা তানভীর আহমেদ নাহিদ বলেন, “নারীরা পোশাক খাতের প্রাণ। কিন্তু তারা নেতৃত্ব নিতে চান না। অনুরোধ করলেও তারা রাজি হন না। বাড়তি চাপ নিতে চান না। তবে বর্তমানে অনেক শিক্ষিত নারী নেতৃত্ব দিচ্ছেন।”
সচেতন মহল মনে করেন, নারী নেতৃত্ব বাড়াতে ও বৈষম্য কমাতে চাই— নারীবান্ধব কর্মপরিবেশ, আলাদা প্রশিক্ষণের উদ্যোগ, পরিবার ও সমাজের মানসিক কাঠামোর পরিবর্তন ও নারী কর্মীবান্ধব নীতিমালা।
বর্তমানে সমাজে নারীর ভূমিকাকে এখনও ‘পরিচর্যাকারী’ হিসেবে দেখা হয়। এই দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে পারলেই নারীরা নেতৃত্বের জায়গায় এগিয়ে আসতে পারবেন।
শ্রমিক নেতা ও ছাত্র-শ্রমিক-জনতার আন্দোলনের সংগঠক আরমান হোসাইন বলেন, “আমাদের দেশের অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি পোশাক খাত, যার প্রধান চালিকাশক্তি নারী শ্রমিকরা। সমাজে নারী-পুরুষের বৈষম্য পোশাক শিল্পেও আছে। নারীরা যৌন হয়রানি, কটূক্তি, অসম আচরণ, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের অভাবে নেতৃত্ব দিতে সাহস পান না।”
লেখক ও সাংবাদিক ফারদিন ফেরদৌস বলেন, “পোশাক শিল্পে নারীর অংশগ্রহণ অপরিহার্য হলেও সিদ্ধান্ত গ্রহণের জায়গায় তারা আজও পিছিয়ে। এর পেছনে রয়েছে বহুস্তরীয় সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কারণ। নারী শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ, আত্মবিশ্বাস ও সুযোগ দেওয়া হলে, তারা নেতৃত্বের দায়িত্বও সফলভাবে পালন করতে পারবেন।”
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।