আঙ্গুর নাহার মন্টি: জাতীয় রাজনীতি, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ইস্যুর পাশাপাশি বাংলাদেশের আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে প্রতিনিয়তই বদলে যাচ্ছে কূটনৈতিক চালচিত্র। বিশ্বের পরাশক্তিগুলোর সঙ্গে ভারসাম্যের কূটনীতির পারদের ওঠানামার খেলায় সরকার যে বেশ হিসাব করেই পা রাখছে, তা দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে বিভিন্ন হাইপ্রোফাইল সফরে।
পশ্চিমা বিশ্ব বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ইস্যুতে সরকারকে চাপে রাখতে বরাবরই গণতন্ত্র, মানবাধিকারসহ তাদের অগ্রাধিকারের নানা বিষয়ে সোচ্চার ছিল।
উপরন্তু দেশের এলিট ফোর্স র্যাব ও এর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে ঢাকা-ওয়াশিংটন সম্পর্কের টানাপোড়েন তীব্র হয়ে উঠেছিল। চলতি বছরের শুরুতে মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লুর সফরের সময় থেকে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বরফ গলতে শুরু করে।
সদ্যসমাপ্ত যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের বিশেষ উপদেষ্টা ডেরেক শোলের সফরে দুই দেশের সুসম্পর্ক জোরদারের মনোভাব আরও স্পষ্ট হয়েছে। এদিকে শীতল সম্পর্কের বাঁক বদলে মার্কিন এই নরম সুরের নেপথ্যে বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী ভারতের ভূমিকা রয়েছে বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা।
ডেরেক শোলের সফরের সময়ে বাংলাদেশ সফর করেন ভারতের নতুন পররাষ্ট্র সচিব বিনয় মোহন কোয়াত্রা। ঢাকা, দিল্লি ও ওয়াশিংটনের সূত্রগুলো তাদের এই সফরকে কাকতালীয় বললেও এর ইতিবাচক প্রভাব অস্বীকার করেননি। কারণ এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বিশ্বস্ত বন্ধু ভারত। আর আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের প্রতি বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী দেশটির অকুণ্ঠ সমর্থন ঐতিহাসিকভাবেই রয়েছে। তাই দিল্লি-ওয়াশিংটনের কৌশলগত ও অংশীদারত্বের সম্পর্কে ইতিবাচক প্রভাব ঢাকা-ওয়াশিংটন সম্পর্কে পড়তে শুরু করেছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। যদিও বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ইস্যুতে ভারত খুব সতর্কভাবেই কূটনৈতিক সীমা মেনে চলে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ডেরেক শোলের বৈঠকে মার্কিন উদ্বেগের ইস্যুগুলোতে বিশেষ করে সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যাপারে আশ্বস্ত করেছেন সরকারপ্রধান। গণমাধ্যমে সে কথা উল্লেখ করে বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন ভালো হবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন মার্কিন শীর্ষ কূটনীতিক শোলে। অন্যদিকে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব জানিয়ে গেছেন, শেখ হাসিনার সরকারের প্রতি তাদের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রতি ভারতের মনোভাব একই থাকলেও এবার মার্কিন সুর যেন আরও নমনীয় হয়েছে। এর নেপথ্যেও বড় কারণ আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মে ভূরাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও কৌশলগত কারণে বাংলাদেশের গুরুত্ব বেড়ে যাওয়া। ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় চীনের উপস্থিতি যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের জন্য শুরু থেকেই স্বস্তিকর নয়। এ অঞ্চলের স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে একসঙ্গে কাজ করছে দিল্লি-ওয়াশিংটন। কৌশলগত কারণে ভারতের ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী বাংলাদেশকেও পাশে চায় যুক্তরাষ্ট্র। আর এক্ষেত্রে ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের আধিপত্যের লড়াইয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধু ভারতের চোখে বাংলাদেশকে দেখার বিকল্প নেই।
শুধু ভারত বা যুক্তরাষ্ট্রই না, বড় শক্তিগুলো সবাই বাংলাদেশকে তাদের সব উদ্যোগে পাশে চায়। আর এ কারণেই একের পর এক হাইপ্রোফাইল গুরুত্বপূর্ণ সফরও বাড়ছে। বিনয় মোহন ও ডেরেক শোলের সঙ্গে একই সময়ে বাংলাদেশে সফর করে গেলেন দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্টের বিশেষ দূত জ্যাং সুং মিন। এ ছাড়া উন্নয়ন সহযোগী দেশ ও সংস্থাগুলোর প্রতিনিধিরা একের পর এক সফর করছেন। সবাই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রশংসা করছেন। কারণ ইতোমধ্যে এ অঞ্চলের উদীয়মান অর্থনীতিতে বাংলাদেশ এক উজ্জ্বল নামে পরিণত হয়েছে।
আর এ কারণেই আগামী সেপ্টেম্বরে দিল্লিতে অনুষ্ঠেয় জি-২০ সম্মেলনে অংশ নেওয়ার ভারতের মর্যাদাপূর্ণ আমন্ত্রণও পেয়েছে বাংলাদেশ। এই সম্মেলনে বিশ্বের বড় শক্তিগুলো এক টেবিলে বসবে। সেখানেও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমন্ত্রিত সম্মানিত অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেবেন। আর বড় শক্তিগুলোর মনোভাব জানার সুযোগ পাবে বাংলাদেশ। এই সম্মেলন সফল করতে ভারত বন্ধু দেশগুলোর মধ্যে কোনো নেতিবাচক সম্পর্কের প্রভাব চাইবে না।
আর বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও নির্বাচন নিয়ে সরব না থাকলেও ভারতের প্রভাব কারও অজানা নয়। সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমনে জিরো টলারেন্স নীতির কারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার বরাবরই ভারতের অকুণ্ঠ সমর্থন পেয়েছে। তবে আগামী নির্বাচনে ভারতের সেই সমর্থন অব্যাহত থাকবে কিনা, তা জানতে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। এমন বাস্তবতায় সরকারকে আগামী সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কূটনৈতিক দক্ষতার পরিচয় দিতে হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
তাদের মতে, ঢাকা-ওয়াশিংটন টানাপোড়েন ও অস্বস্তি কমাতে দিল্লির ভূমিকাকেও গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে বাইডেন প্রশাসন। আর এরই প্রতিফলন মার্কিন সফরগুলোতে দেখা যাচ্ছে। তবে আগামী সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করবে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র। এর পরই আগামী নির্বাচন ইস্যুতে তাদের অবস্থান স্পষ্ট হবে। আর স্বাভাবিকভাবেই আমেরিকার সুরেই কথা বলবে পশ্চিমা বিশ্ব। সরকার অবশ্য ঢাকায় নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়িয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার ইইউ রাষ্ট্রদূতসহ ইউরোপীয় ৭ দেশের কূটনীতিকের সঙ্গে বৈঠক করেছেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
এ প্রসঙ্গে সাবেক কূটনীতিক হুমায়ুন কবীর বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগের বিষয়গুলো বরাবরের মতো এবারও ডেরেক শোলের সফরে স্পষ্ট বলে গেছেন। তারা যে বাংলাদেশকে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে তা স্পষ্ট হয়েছে উচ্চ পর্যায়ের ৭ সদস্যের প্রতিনিধি দলের সফরে। তারা চায় এদেশের জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। সরকারপ্রধান খোদ এবার তাদের আশ্বস্ত করেছেন। তাই সম্পর্ক ভিন্ন মাত্রা পাবে। তবে এই আশ্বাসের বাস্তবায়নের ওপরই আগামী দিনের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক নির্ভর করবে।
এদিকে মার্কিন প্রতিনিধিদের সফর প্রসঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, সব ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটিয়ে আমেরিকা বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতে চায়। সরকারও এ ব্যাপারে ইতিবাচক।
তবে ঢাকা সম্পর্কে ওয়াশিংটনের মনোভাব বদলে দিল্লির ভূমিকাকে ধারণা বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্বদ্যিালয়ের সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজের পরিচালক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ। তিনি বলেন, ভারত বাংলাদেশের পরীক্ষিত বন্ধু। বর্তমান সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্কও দৃশ্যমান। এ অঞ্চলে অর্থনৈতিক সম্ভাবনাময় দেশ এখন বাংলাদেশ। ভারত, যুক্তরাষ্ট্রসহ সব বড় শক্তির কাছে এখন অর্থনৈতিক গুরুত্ব অগ্রাধিকার পাবে। তাই সবাই নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় উদীয়মান অর্থনীতির দেশ বাংলাদেশ বিষয়ে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেবে এটাই স্বাভাবিক।
(দৈনিক কালবেলা)
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।