ডলফিন নামটি সম্ভবত সবার পরিচিত। হয়তো জানেন, এরই বাংলা নাম শুশুক। জলজ পরিবেশের অন্যতম বুদ্ধিমান স্তন্যপায়ী প্রাণী এরা। পৃথিবীজুড়ে খুব আদুরে প্রাণী হিসেবেও পরিচিত। মানুষ আদর করলে কী হবে, নিজ বাস্তুতন্ত্রের শীর্ষ শিকারি প্রজাতির একটি এটি। গুরুত্বপূর্ণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে খাদ্যশৃঙ্খলে। শুধু এশিয়া ও দক্ষিণ আমেরিকায় এখনো শুশুকেরা টিকে আছে। প্রধানত ট্রপিকাল ও সাব-ট্রপিকাল অঞ্চলের কয়েকটি প্রধান নদী অববাহিকায় ছড়িয়ে আছে এরা।
দক্ষিণ আমেরিকার আমাজন ও ওরিনোকো এবং এশিয়ার গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা, সিন্ধু, ইরাবতী, মহাকাম ও মেকং নদীতে পাওয়া যায়। বিশ্বের মাত্র পাঁচ প্রজাতির নদীর শুশুক এখনো টিকে আছে। সেগুলো হলো অ্যামাজন নদীর ডলফিন, গঙ্গা নদীর ডলফিন, সিন্ধু নদীর ডলফিন, ইরাবতী ডলফিন ও টুকুসি (ওরিনোকো নদীতে পাওয়া যায়)। আইইউসিএনের তথ্য মতে, এগুলোর সবকটিই বৈশ্বিকভাবে বিপন্ন। এ ছাড়া চীন নদীর ডলফিন নামে আরও একটি নদীর শুশুক ছিল (এরা বাইজি নামে পরিচিত)। মারাত্মক মাত্রায় পরিবেশ দূষণ, আবাসস্থল ধ্বংস, ইলেকট্রনিক ফিশিং, জাহাজের প্রপেলারের সঙ্গে ধাক্কা লাগাসহ নানা কারণে পৃথিবী থেকে সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত হয়ে গেছে এ শুশুক।
বাংলাদেশ ভৌগলিকভাবে দুটি জীববৈচিত্র্যের হটস্পটে অবস্থিত। ইন্দো হিমালয়ান ও ইন্দো চাইনিজ। তাই এ দেশ জীববৈচিত্র্যে ভরপুর। এর সুবাদে ও প্রকৃতির আশীর্বাদে পৃথিবীর ৫টি নদীর শুশুকের মধ্যে দুটিই বাংলাদেশে পাওয়া যায়। গঙ্গা নদীর ডলফিন ও ইরাবতী ডলফিন।
গঙ্গা নদীর ডলফিনকে স্থানীয়ভাবে শুশুক বা শুশু নামে ডাকা হয়। অনেকে একে গঙ্গার বাঘ বলেও ডাকে। এটি ভারতীয় উপমহাদেশের একটা এন্ডেমিক প্রজাতি। বাংলাদেশসহ ভারত, নেপাল ও ভুটানে এদের বিচরণ। দেশীয়ভাবে এটি অরক্ষিত (Vulnerable) হলেও বৈশ্বিকভাবে বিপন্ন (Endangered)। এটাই বাংলাদেশের একমাত্র পরিপূর্ণ মিঠাপানির ডলফিন। বাংলাদেশে পদ্মা, মেঘনা, ব্রহ্মপুত্র, সাঙ্গু-কর্ণফুলী নদী অববাহিকায় এবং সুন্দরবনের নদীগুলোতে এদের পাওয়া যায়।
ধারণা করা হয়, পুরো বিশ্বে মাত্র ৩ হাজার ৫০০টি ডলফিন রয়েছে এ প্রজাতির। এদের গুরুত্ব বিবেচনা করে ২০১০ সালে ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে একে জাতীয় জলজ প্রাণী হিসাবে ঘোষণা করে।
ইরাবতী পরিপূর্ণ মিঠাপানির ডলফিন নয়। লবণাক্ত বা ঈষৎ লবনাক্ত পানির পাশাপাশি এরা নদীতেও থাকে। মিয়ানমারের ইরাবতী নদীর নামের সঙ্গে মিলিয়ে এ ডলফিনের এমন নাম রাখা হয়েছে। বাংলাদেশ ও ভারতসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মায়ানমার, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড, লাওস ও কম্বোডিয়ায় এদের পাওয়া যায়।
বাংলাদেশের উপকূলীয় নদীগুলো, বিশেষ করে সুন্দরবনের বলেশ্বর, বিষখালী, পশুর, রায়মঙ্গল ও পায়রা নদীর মোহনায় পাওয়া যায় এদের। বাংলাদেশেই সবচেয়ে বেশি রয়েছে এই ডলফিন। বাংলাদেশের উপকূলীয় সুন্দরবনের নদীগুলোর মোহনায় ৪৫১টি ইরাবতি ডলফিন রয়েছে। দেশীয়ভাবে এরা ঝুঁকির দ্বারপ্রান্তে রয়েছে, আর বৈশ্বিকভাবে বিপন্ন।
এই দুটি ডলফিনই বাংলাদেশের প্রচলিত বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন ২০১২ দিয়ে সুরক্ষিত। নদীর এই আদুরে স্তন্যপায়ী প্রাণী সংরক্ষণের সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ২০০৯ সালের ২৪ অক্টোবর ইন্দোনেশিয়ায় ‘মিঠাপানির ডলফিন দিবস’ হিসাবে ঘোষণা করা হয়। এরপর থেকে বিশ্বজুড়ে দিনটি উদ্যাপিত হচ্ছে।
বিপন্ন প্রজাতির এই স্তন্যপায়ী প্রাণীকে রক্ষা করতে ২০২৩ সালে কলম্বিয়ার রাজধানী বগোটাতে এশিয়া ও দক্ষিণ আমেরিকার মোট ১৪টি দেশ একত্র হয়। এদের রক্ষা করতে ৯টি দেশ চুক্তি স্বাক্ষর করে। এর মধ্যে বাংলাদেশও ছিল।
বাংলাদেশের বন বিভাগ এদের রক্ষা করতে ২০১২ সালে প্রথমবার সুন্দরবনে দুধমুখি, চান্দপাই ও ঢাংমারী নামে তিনটি ডলফিন অভয়ারণ্য ঘোষণা করে। এ ছাড়াও পরে ২০১৩ ও ২০২০ সালে পাবনা ও খুলনা জেলার পদ্মা ও যমুনা বিধৌত এলাকায় আরও ৬টি ডলফিন অভয়ারণ্য প্রতিষ্ঠা করে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশে বর্তমানে মোট ডলফিন অভয়ারণ্য আছে ৯টি। এর সম্মিলিত আয়তন ৫,০৭৫.২৮ হেক্টর।
এ ছাড়াও বন্যপ্রাণীর পাশাপাশি পদ্মার ডলফিন সংরক্ষণের লক্ষ্যে ২০২০ সালে পদ্মা সেতু বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য প্রতিষ্ঠা করা হয়। এর আয়তন প্রায় ১১ হাজার ৭৭৩ হেক্টর। পাশাপাশি আইইউসিএন ও বাংলাদেশ বন বিভাগের উদ্যোগে সুন্দরবনে সাতটি ডলফিন সংরক্ষণ দল গঠন করা হয়েছে। দেশের এই দুই প্রজাতির নদীর ডলফিন সংরক্ষণে বাংলাদেশ সরকার, বন বিভাগ, ইউএনডিপি ও অন্যান্য সহযোগী সংগঠনের উদ্যোগে ১০ বছর মেয়াদী (২০২০-২০৩০) ডলফিন অ্যাকশন প্ল্যান প্রণয়ন করা হয়েছে।
প্রকৃতিতে নদীর এই শুশুক বা ডলফিনের গুরুত্ব অপরিসীম। ডলফিনের উপস্থিতিতে জলজ পরিবেশের সুস্থতা ঠিক থাকে, মাছের সংখ্যার ওপরও ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। নদীর ডলফিন সংরক্ষণের মাধ্যমে নদীর কাছিম, ভোঁদড় ও ঘড়িয়ালের মতো জলজ প্রাণী সংরক্ষিত হবে। বিশেষ করে নদী বিধৌত এলাকার মানুষ পরিবেশগত ও আর্থিকভাবে উপকৃত হবে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও নানা কারণে এদের সংখ্যা কমে যাচ্ছে।
প্রায়ই মৃত ডলফিনের খবর দেখা যায় বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে। এসব ঘটনার অন্যতম কারণের মধ্যে রয়েছে অবৈধভাবে মাছ ধরা, কারেন্ট জালের ব্যবহার, এদের আবাসস্থল ধ্বংস, পানি দূষণ, পলি জমে নদীর প্রাবহে বাধা, নদীতে বাঁধ নির্মাণ, বিষ প্রয়োগে মাছ শিকার, অতি মাত্রায় নৌযান চলাচল, জাহাজের প্রপেলরের সঙ্গে সংঘর্ষ, অবৈধভাবে নদীর বালু উত্তোলন ইত্যাদি। এ ছাড়া এখনো বিভিন্ন প্রান্তিক অঞ্চলে ডলফিন শিকার করা হয় তেল, ওষুধ ও মাংসের জন্য। পাশাপাশি মানুষের সচেতনতার অভাব ডলফিন সংরক্ষণের অন্যতম অন্তরায়।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।