প্রকৃতির চারটি বলের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী বলটির নাম সবল বা শক্তিশালী পারমাণবিক বল। ইংরেজিতে বলা হয় স্ট্রং নিউক্লিয়ার ফোর্স। এই বলটিই এখন পর্যন্ত আমাদের জানা পরমাণুর সবচেয়ে ক্ষুদ্রতম কণা কোয়ার্কদের একত্রে ধরে রাখে। আর কোয়ার্ক কণা দিয়ে গঠিত হয় পরমাণুর যৌগিক কণা প্রোটন ও নিউট্রন। এই দুটি কণা একসঙ্গে গাদাগাদি হয়ে গড়ে তোলে পরমাণুর নিউক্লিয়াস।
প্রোটনের বৈদ্যুতিক চার্জ ধনাত্মক এবং নিউট্রন চার্জ নিরপেক্ষ। বৈদ্যুতিকভাবে চার্জিত হওয়ার কারণে একটি প্রোটন অন্য প্রোটনকে বিকর্ষণ করে। তাই পরমাণুর নিউক্লিয়াসে একসঙ্গে একাধিক প্রোটন গাদাগাদি হয়ে থাকার কথা নয়। অথচ হাইড্রোজেন ছাড়া অন্যান্য মৌলে প্রোটনের সংখ্যা ক্রমেই বাড়তে থাকে।
যেমন হিলিয়ামের নিউক্লিয়াসে দুটি প্রোটন থাকে। অক্সিজেন পরমাণুতে থাকে ৮টি। আর প্রকৃতিতে পাওয়া সবচেয়ে ভারী মৌল ইউরেনিয়ামে থাকে ৯২টি প্রোটন। এই প্রোটন ও নিউট্রন কণাদেরও পরস্পরের সঙ্গে আটকে রাখে শক্তিশালী বল। প্রোটনদের মধ্যে যে বৈদ্যুতিক বিকর্ষণ বা বিদ্যুৎচুম্বকীয় বল কাজ করে, তাকে বাতিল করে তার ওপর আধিপত্য বিস্তারের ক্ষমতা আছে একমাত্র শক্তিশালী বলের। সে কারণেই তার নাম শক্তিশালী বা সবল পারমাণবিক বল।
কিন্তু বলটি আসলে কতটা শক্তিশালী?
সেই উত্তর দেবার আগে শক্তিশালী পারমাণবিক বলের চরিত্র, মানে কিছু দোষ-গুণের কথা বলে নেই। বস্তু বা পদার্থের স্থিতিশীলতার পেছনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকা রাখছে শক্তিশালী বল। সূর্যের ভেতর নিউক্লিয়ার ফিউশন কিংবা পারমাণবিক বোমায় ঘটা নিউক্লিয়ার ফিশন প্রক্রিয়ায় যে বিপুল পরিমাণ শক্তি বেরিয়ে আসে তা আসলে এ বলেরই শক্তির প্রকাশ।
তবে এত শক্তিশালী হওয়া সত্ত্বেও এ বলের পরিসর খুবই ছোট। আসলে বলা উচিত খুবই খুবই খুবই ছোট। অতিপারমাণবিক পরিসরে প্রায় এক ফেমটোমিটার বা ১০-১৫ মিটার দূরত্বে কাজ করে এ বল। অর্থাৎ আরও ভালোভাবে বলা যায়, পরমাণু নিউক্লিয়াসের মধ্যেই এই কার্জকারবার সীমাবদ্ধ। বড় দূরত্বে এর প্রভাব একেবারেই নগণ্য হওয়ার কথা। তবে এখানে একটা প্যারাডক্স আছে।
বিদ্যুৎচুম্বকীয় বল বহন করে ফোটন। এর কোনো বৈদ্যুতিক চার্জ নেই। কিন্তু শক্তিশালী বলের বাহকের নাম গ্লুয়ন শক্তিশালী বলের সমতুল্য ‘কালার চার্জ’ বহন করে। তাই চার্জিত দুটি কণার দূরত্ব বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের বিদ্যুৎচুম্বকীয় বলের পরিমাণ কমতে থাকলেও শক্তিশালী বলের ক্ষেত্রে দেখা যায় একটা অদ্ভুত ঘটনা।
কোয়ার্ক ও গ্লুয়ন কণাদের যদি টেনে আলাদা করার চেষ্টা করা হয়, তাহলে এই কণাদের মধ্যকার বল আরও বেড়ে যায়। অনেকটা রাবার ব্যান্ডের মতো। একটা রাবার ব্যান্ডকে যেমন টেনে লম্বা করা হলে, একটা নির্দিষ্ট দূরত্ব পর্যন্ত সেটা শক্তিশালীভাবে ভেতরের দিকে টেনে ধরে, দুটি কোয়ার্ক কণা আলাদা করতে গেলেও প্রায় একই ঘটনা ঘটে। তাই প্রকৃতিতে একটা মাত্র কোয়ার্ক কিংবা একটা মাত্র গ্লুয়ন কণার দেখা মেলে না।
প্রকৃতিতে ছয় ধরনের কোয়ার্ক কণার খোঁজ পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। সেগুলো হলো, আপ, ডাউন, স্ট্রেঞ্জ, চার্ম, বটম এবং টপ কোয়ার্ক। এছাড়া রয়েছে তাদের প্রতিকণারা। তবে একটি প্রোটন কণা গঠিত হয় তিনটি কোয়ার্ক দিয়ে। এর মধ্যে দুটি আপ কোয়ার্ক এবং একটি আপ কোয়ার্ক। দেখা গেছে, প্রোটনের ভরের মাত্র ১ ভাগের জন্য দায়ী ওই তিনটি কোয়ার্ক কণা। বাকী ৯৯ ভাগ ভর আসে গ্লুয়ন কণার মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে।
আগেই বলেছি, কোয়ার্ক কণা কালার চার্জ বহন করে। এই কালারও মাত্র একটি নয়, বরং তিনটি। সেগুলো হলো লাল, সবুজ ও নীল। প্রকৃতির মৌলক রং। এছাড়া এদের বৈদ্যুতিক চার্জও রয়েছে। তবে অদ্ভুত ব্যাপার হলো, এই চার্জ পূর্ণ সংখ্যা নয়, বরং ভগ্নাংশ মানের।
যেমন আপ, চার্জ এবং টপ কোয়ার্কের চার্জের পরিমাণ +২/৩, ডাউন, স্ট্রেঞ্জ ও বটম কোয়ার্কের চার্জ -১/৩। সে কারণেই একটা প্রোটন চার্জের মান হয় +১। নিজেই হিসেব করে দেখুন। দুটি আপ কোয়ার্কের চার্জ হবে +২/৩+২/৩= ৪/৩। আর এর সঙ্গে একটি ডাউন কোয়ার্কের চার্জ যোগ করলে পাওয়া যাবে ৪/৩-১/৩= ৩/৩ বা +১।] কিংবা দুটি ডাউন কোয়ার্ক এবং একটি আপ কোয়ার্ক মিলে গঠিত একটা নিউট্রন চার্জশূন্য হয়। হিসেব করলে পাওয়া যাবে: -১/৩-১/৩+২/৩= ০।
১৯৬০-এর দশকে কোয়ার্ক মডেলের প্রস্তাব দেন পদার্থবিদ মারি গেল-মান। পরে গবেষণাগারে এই মডেলের পরীক্ষামূলক প্রমাণও পাওয়া যায়। যাই হোক, এবার তাহলে আসল কথাটা বলি। বিজ্ঞানীদের চুলচেরা হিসেবে, শক্তিশালী পারমাণবিক বলের পরিসর খুবই ছোট হলেও অন্যান্য বলের চেয়ে এর শক্তি অনেক বেশি।
শক্তিশালী বলের শক্তি বিদ্যুৎচুম্বকীয় বলের চেয়ে প্রায় ১৩৭ গুণ বেশি। অন্যদিকে দুর্বল পারমাণবিক বলের চেয়ে ১০৬ গুণ বেশি। আর প্রকৃতির চারটি বলের মধ্যে সবচেয়ে দুর্বল বলটির নাম মহাকর্ষ। এ বলের চেয়ে শক্তিশালী পারমাণবিক বল প্রায় ১০৩৮ গুণ শক্তিশালী।
মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, প্রকৃতিতে শক্তিশালী বল না থাকলে কী হতো? কী এমন ক্ষতি হতো তাতে? এর সংক্ষিপ্ত উত্তরটা হলো, বিগ ব্যাংয়ের পর মহাবিশ্বের কোনো পদার্থ বা বস্তুই আর গঠিত হতো না। কারণ অতিপারমাণবিক কণাগুলো একত্রে গাদাগাদি হতে পারতো না। তাতে প্রোটন, নিউট্রন বা পরমাণু এবং গ্রহ, নক্ষত্র, ছায়াপথসহ বস্তুজগৎ এবং সবশেষে আমি, আপনি কোনো কিছুরই অস্তিত্ব থাকত না।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।