আশরাফুল ইসলামের চোখে স্বপ্নের ছবি ছিল – গ্রামের বাড়ির পাশে ছোট্ট ফলের বাগান, যেখানে নাতিদের নিয়ে বসবে পরিবার। জীবনভর সঞ্চয় করে কেনা তিন কাঠা জমির রেজিস্ট্রেশন হয়েছিল দালালের হাত ধরে। কিন্তু পাঁচ বছর পর আদালতের নোটিশ এল: “জমির মালিকানা দাবিদার আরও দু’জন!” কাগজপত্র পরীক্ষায় ধরা পড়ল—সেই রেজিস্ট্রেশন দলিলে বিক্রেতার স্বাক্ষর জাল, স্ট্যাম্প নকল। আশরাফুলের স্বপ্নভূমি এখন আইনি লড়াইয়ের ময়দান। প্রপার্টি রেজিস্ট্রেশন গাইড:সহজ পদক্ষেপ জানা থাকলে এতবড় সংকট এড়ানো যেত। বাংলাদেশে প্রতিবছর ৬৫ হাজারেরও বেশি সম্পত্তি বিবাদে জড়ায় শুধুমাত্র ত্রুটিপূর্ণ রেজিস্ট্রেশনের কারণে, জানাচ্ছে ভূমি মন্ত্রণালয়ের ২০২৩ সালের প্রতিবেদন।
প্রয়োজনীয় কাগজপত্র: কোন ডকুমেন্ট ছাড়া রেজিস্ট্রেশন অসম্ভব
মৌলিক শর্ত পূরণ করুন
ভূমি রেজিস্ট্রেশন অধিদপ্তরের পরিপত্র (২০২২-০৩) অনুযায়ী, রেজিস্ট্রেশনের আগে এই ৭টি কাগজ অবশ্যই প্রস্তুত রাখুন:
বিক্রয় দলিলের খসড়া (খতিয়ানসহ):
ভূমি কর্মকর্তা অনুমোদিত খসড়া, যাতে স্পষ্ট উল্লেখ থাকবে জমির সীমানা, দাগ নম্বর, খতিয়ান নম্বর এবং পূর্ববর্তী মালিকের বিবরণ।জাতীয় পরিচয়পত্র (বিক্রেতা ও ক্রেতা):
NID-এর ফটোকপি নোটারি পাবলিক কর্তৃক সত্যায়িত হতে হবে।টিন সার্টিফিকেট:
ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নম্বর (TIN) সনদ।মিউটেশন সার্টিফিকেট:
জমির নামজারি কাগজ দেখিয়ে প্রমাণ করতে হবে বিক্রেতাই প্রকৃত মালিক।পূর্ববর্তী দলিলের ফটোকপি:
সর্বশেষ বৈধ মালিকের কাছ থেকে কেনার প্রমাণপত্র।ভূমি উন্নয়ন কর রশিদ:
বর্তমান বছরের কর পরিশোধের প্রমাণ।- পাসপোর্ট সাইজ ছবি:
ক্রেতা-বিক্রেতার প্রত্যেকের ৪ কপি করে রঙ্গিন ছবি।
“অনেকেই শুধু দলিলের খসড়া আর NID নিয়ে রেজিস্ট্রি অফিসে হাজির হন। পরে টিন সনদ বা মিউটেশন না থাকায় প্রক্রিয়া আটকে যায়,” সতর্ক করছেন ঢাকা জেলা রেজিস্ট্রার মো. শফিকুল ইসলাম।
প্রপার্টি রেজিস্ট্রেশনের ধাপসমূহ: প্রতিটি স্তরে সতর্কতা
ধাপ ১: দলিল খসড়া প্রস্তুতকরণ (বিক্রেতা ও ক্রেতার সমন্বয়ে)
- বিশেষজ্ঞের সহায়তা নিন: ভূমি আইনজীবী বা রেজিস্ট্রেশন এজেন্ট দিয়ে খসড়া তৈরি করালে ভুলের ঝুঁকি কমে।
- স্ট্যাম্প ক্রয়: দলিলের মূল্যমানের ৩% হারে নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প কিনতে হবে (অর্থ আইন, ২০২৩ অনুযায়ী)।
- স্থানীয় ভূমি অফিসে যাচাই: দাগ-খতিয়ান মিলিয়ে নিন ভূমি মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট-এ বা ইউনিয়ন ভূমি অফিসে।
ধাপ ২: উপজেলা রেজিস্ট্রার অফিসে আবেদন
- সাক্ষীদের উপস্থিতি: রেজিস্ট্রেশন আইন, ১৯০৮-এর ৩২ ধারা মতে, দু’জন প্রাপ্তবয়স্ক সাক্ষীর প্রয়োজন।
- বায়োমেট্রিক যাচাই: বিক্রেতা-ক্রেতার থাম্ব ইম্প্রেশন নেওয়া হবে।
- ফি জমা: সম্পত্তির মূল্যের ১.৫% রেজিস্ট্রেশন ফি + ১০০ টাকা সার্ভিস চার্জ (ভূমি সেবা গাইডলাইন, ২০২১)।
ধাপ ৩: দলিল নিবন্ধন ও গ্রহণ
- ৩০ দিনের রেকর্ড: রেজিস্ট্রারের স্বাক্ষরিত দলিল ৩০ কর্মদিবসের মধ্যে কালেক্টরেট থেকে সংগ্রহ করুন।
- মিউটেশনে আবেদন: নিবন্ধিত দলিলের ভিত্তিতে ৯০ দিনের মধ্যে নামজারি আবেদন করুন।
ডিজিটাল সুবিধা: ঢাকা, চট্টগ্রাম ও গাজীপুরে এখন অনলাইন অ্যাপয়েন্টমেন্টের মাধ্যমে রেজিস্ট্রেশনের সময়定 করা যায় e-RRS পোর্টাল-এ।
সচরাচর ভুল ও আইনি ফাঁদ: যে বিষয়গুলো উপেক্ষা করবেন না
ভূমি জালিয়াতির ৪টি সাধারণ কৌশল
- ফটোশপকৃত দলিল: বিক্রেতার পরিচয়পত্র বা পূর্ববর্তী দলিল ডিজিটালি পরিবর্তন।
- জাল স্ট্যাম্প: নকল নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প ব্যবহার (স্ট্যাম্প দপ্তরে যাচাই করুন)।
- নকল মালিক: প্রকৃত মালিকের অনুকরণে ব্যক্তি উপস্থাপন।
- সীমানা বিভ্রাট: খতিয়ানে উল্লিখিত পরিমাণের চেয়ে কম জমি বিক্রি।
সতর্কতা সমূহ:
- বিক্রেতার পারিবারিক ইতিহাস জানুন (যৌথ সম্পত্তি হলে অনুমতি প্রয়োজন)।
- রেজিস্ট্রেশনের আগে জমি পরিদর্শন করুন পাড়া-প্রতিবেশীর সাথে।
- দলিলে “অবাধ ও চিরস্থায়ী স্বত্ব” (Absolute Ownership) লেখা আছে কি না দেখুন।
খরচ কাঠামো: কোথায় কত টাকা খরচ হবে?
ভূমি রেজিস্ট্রেশনের আনুমানিক ব্যয় (১০ লাখ টাকার জমি) | খরচের বিবরণ | টাকার পরিমাণ | মন্তব্য |
---|---|---|---|
নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প | ৩০,০০০ | মূল্যের ৩% | |
রেজিস্ট্রেশন ফি | ১৫,০০০ | মূল্যের ১.৫% | |
আইনজীবীর ফি | ৫,০০০ – ১০,০০০ | আলোচনাসাপেক্ষ | |
সাক্ষী ফি | ১,০০০ | প্রতি সাক্ষী | |
মোট | ৫১,০০০ – ৫৬,০০০ | আনুমানিক |
“রেজিস্ট্রেশন ফি’র হার স্থির, কিন্তু দালালরা নানা অজুহাতে বাড়তি টাকা চায়। সরাসরি অফিসে ফি জমা দিন,” পরামর্শ দেন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার তানজিম আল ইসলাম।
ডিজিটাল রেজিস্ট্রেশন: ভবিষ্যতের পথে এগিয়ে বাংলাদেশ
ই-মিউটেশন ও ভূমি সেবা অ্যাপ
২০২৪ সালের মধ্যে দেশের সব উপজেলায় চালু হবে ই-মিউটেশন সিস্টেম। ইতিমধ্যে:
- ভূমি সেবা অ্যাপ: অ্যান্ড্রয়েড ফোনে জমির খতিয়ান, দখলদারির তথ্য দেখা যায়।
- ডিজিটাল পেমেন্ট: স্ট্যাম্প ফি ও রেজিস্ট্রেশন চার্জ বিকাশ/নগদের মাধ্যমে পরিশোধ।
- অনলাইন ট্র্যাকিং: আবেদনের অবস্থা জাতীয় ভূমি পরিষেবা পোর্টাল-এ চেক করা যায়।
সতর্কবার্তা: অনলাইন প্ল্যাটফর্মে দলিল আপলোড করতে গেলে ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁসের ঝুঁকি। শুধুমাত্র সরকারি সাইট ব্যবহার করুন।
জেনে রাখুন (FAQs)
১. রেজিস্ট্রেশন ছাড়া জমি ক্রয়-বিক্রয় করা কি বৈধ?
না, সম্পত্তি হস্তান্তর আইন, ১৮৮২-এর ৫৪ ধারা অনুযায়ী, রেজিস্ট্রেশন ব্যতীত জমি বিক্রয় আইনত অবৈধ। এমন লেনদেন আদালতে চ্যালেঞ্জ করা যায় এবং ক্রেতার মালিকানা স্বীকৃত হয় না।
২. রেজিস্ট্রেশনের সময়সীমা কত?
দলিল সম্পাদনের ৪ মাস (১২০ দিন)ের মধ্যে রেজিস্ট্রেশন বাধ্যতামূলক (রেজিস্ট্রেশন আইনের ২৩ ধারা)। সময় পার হলে জরিমানা দিতে হয়।
৩. বিদেশে থাকলে রেজিস্ট্রেশন কীভাবে করব?
বিক্রেতা বা ক্রেতা বিদেশে থাকলে নোটারি পাবলিক সমক্ষে স্বাক্ষর করে “পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি” প্রেরণ করতে হবে। এজেন্ট মূল দলিলে স্বাক্ষর করবেন।
৪. রেজিস্ট্রেশন ফি কমাতে কোনো উপায় আছে কি?
জমির প্রকৃত মূল্য গোপন করে ফি কমালে তা জালিয়াতি। তবে কৃষি জমি/পৈতৃক বাড়ির ক্ষেত্রে কিছু ছাড় আছে। ভূমি অফিসে জিজ্ঞাসা করুন।
৫. পুরনো দলিল হারিয়ে গেলে কী করব?
সাব-রেজিস্ট্রার অফিসে আবেদন করে নকল দলিল সংগ্রহ করুন। শর্ত: গেজেট বিজ্ঞপ্তি, শুনানির নোটিশ এবং শপথনামা জমা দিতে হবে।
৬. রেজিস্ট্রেশনের পর কী কী কপি পাবো?
আপনি পাবেন: ১) নিবন্ধিত দলিলের মূল কপি, ২) রেজিস্ট্রার কর্তৃক সত্যায়িত ফটোকপি, ৩) ভূমি উন্নয়ন করের রশিদ।
বিগত ৩০ বছরে ভূমি জটিলতায় ১২ লক্ষ পরিবার সর্বস্বান্ত হয়েছে। আপনার প্রিয় সম্পত্তি যেন পরিণত না হয় দীর্ঘ মামলার বোঝায়—প্রপার্টি রেজিস্ট্রেশন গাইড:সহজ পদক্ষেপ মেনে আজই সঠিকভাবে নথিবদ্ধ করুন। একজন স্বনামধন্য ভূমি আইনজীবীর পরামর্শ নিন, সরকারি ওয়েবসাইটে তথ্য যাচাই করুন, এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য নিরাপদ ভিত্তি গড়ে তুলুন।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।