মেঘনা নদীর উত্তাল ঢেউ আর হুঙ্কার ছেড়ে আসা ঘূর্ণিঝড়ের গর্জনের মধ্যেও একটু আশার আলো জ্বলে – সেটা হল প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রস্তুতি। ২০২৪ সালের মে মাস, কক্সবাজারের কুতুবদিয়া দ্বীপ। সাইক্লোন শেলির আঘাতের পর ধ্বংসস্তূপের মধ্যে দাঁড়িয়ে রহিমা বেগমের চোখে অশ্রু, কিন্তু হতাশা নেই। “আগে থেকে শুকনো খাবার, টর্চলাইট, জরুরি ওষুধ প্যাকেট বানিয়ে রেখেছিলাম,” বললেন তিনি, ভাঙা ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে। “এই ছোট প্রস্তুতিই আমার নাতিদুটোর প্রাণ বাঁচালো।” বাংলাদেশে প্রতি বছর বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, ভূমিধসের মতো দুর্যোগ হাজারো রহিমার জীবন ওলটপালট করে দেয়। কিন্তু একথা স্পষ্ট: দুর্যোগ অনিবার্য, কিন্তু প্রাণহানি ও সম্পদ ধ্বংস নয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রস্তুতি শুধু নীতিবাক্য নয়, এটি একটি জীবনদায়ী অভ্যাস, একটি সামাজিক দায়িত্ব। এই গাইডলাইন শুধু তথ্য দেবে না, আপনাকে দেবে সেই মানসিক ও ব্যবহারিক শক্তি, যা দুর্যোগের মুখে আপনাকে অটুট রাখবে।
প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রস্তুতি: কেন অগ্রিম পরিকল্পনা জীবন-মরণ প্রশ্ন?
প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখোমুখি হওয়ার অর্থ শুধু শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই নয়, বরং সময়ের বিরুদ্ধে প্রতিযোগিতা। বাংলাদেশ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর (ডিএমডি)-এর তথ্য বলছে, ২০২০ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত শুধু ঘূর্ণিঝড় ও বন্যায় দেশে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ২৫ লাখেরও বেশি মানুষ। অথচ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)-এর মতে, প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রস্তুতি ও সচেতনতা ৭০% পর্যন্ত প্রাণহানি ও ৫০% পর্যন্ত অর্থনৈতিক ক্ষতি কমাতে পারে।
- দ্রুত সাড়াদানের ক্ষমতা: দুর্যোগ আঘাত হানার পরের মুহূর্তগুলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। বিদ্যুৎ চলে গেছে, যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন, রাস্তা বন্ধ। এমন অবস্থায় আপনার যদি আগে থেকে একটি জরুরি প্রস্তুতি কিট (Emergency Kit) এবং পরিবারের পুনর্মিলন পরিকল্পনা (Family Reunion Plan) থাকে, তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ হয়। ভাবুন, বন্যার পানি দ্রুত উঠছে। আপনি জানেন কোন উঁচু আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে হবে, কীভাবে যাবেন, কাকে ফোন করবেন – এই জ্ঞানই তখন অমূল্য।
- মানসিক দৃঢ়তা ও আত্মবিশ্বাস: অজানার ভয় সবচেয়ে তীব্র। প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রস্তুতি মানে শুধু সামগ্রী জমা করা নয়, মানসিকভাবে সক্ষম হওয়া। আপনি যখন জানেন কোন দুর্যোগের জন্য কী করণীয়, কীভাবে পরিবারের সদস্যদের শান্ত রাখবেন, তখন আতঙ্ক কমে যায়। দুর্যোগ-পরবর্তী মানসিক আঘাত (PTSD) মোকাবিলার প্রথম ধাপও এটাই।
- সম্পদ সুরক্ষা ও দ্রুত পুনরুদ্ধার: জীবিকা, কষ্টার্জিত সম্পদ রক্ষা করাও প্রস্তুতির অংশ। ফসল, গবাদিপশু, দালান-কোঠা, দলিলপত্রের সুরক্ষা আগে থেকে ভাবলে দুর্যোগ-পরবর্তী পুনর্গঠন দ্রুত হয়। কুড়িগ্রামের কৃষক জাহাঙ্গীর আলী তার ধান কাটার সময়সূচী দুর্যোগ পূর্বাভাস শুনে এগিয়ে নিয়ে আসেন, শস্য মাটির নিচে নিরাপদ স্থানে সংরক্ষণ করেন। ফলস্বরূপ, বন্যার পরও তার পরিবার খাদ্য সংকটে পড়েনি।
- সামাজিক সংহতি: ব্যক্তিগত প্রস্তুতি সামষ্টিক সুরক্ষার ভিত্তি। পাড়া-প্রতিবেশী, স্থানীয় কমিউনিটি মিলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি (Disaster Management Committee) গঠন, আশ্রয়কেন্দ্র চিহ্নিতকরণ, দুর্বল জনগোষ্ঠী (বৃদ্ধ, প্রতিবন্ধী, গর্ভবতী নারী) চিহ্নিতকরণের মতো কাজগুলো সম্প্রদায়কে দুর্যোগে একসাথে টিকে থাকতে সাহায্য করে। সাতক্ষীরার শ্যামনগরে স্থানীয় যুব সংগঠনের উদ্যোগে এমন কমিউনিটি ম্যাপিং প্রজেক্ট বহু প্রাণ বাঁচিয়েছে।
গুরুত্বপূর্ণ: ডিএমডি’র ‘ঘরে ঘরে দুর্যোগ প্রস্তুতি’ ক্যাম্পেইন জোরদার করেছে। তাদের ওয়েবসাইটে (https://dmd.gov.bd/) স্থানীয় ঝুঁকি অনুযায়ী রেডি-টু-প্রিন্ট প্রস্তুতি চেকলিস্ট পাওয়া যায়।
দুর্যোগের ধরনভেদে প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রস্তুতি: বন্যা, ঘূর্ণিঝড় ও ভূমিধসের জন্য সুনির্দিষ্ট কৌশল
প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রস্তুতি সর্বজনীন নয়। বাংলাদেশের প্রধান তিন দুর্যোগের জন্য প্রস্তুতির রূপরেখা আলাদা:
বন্যা: দীর্ঘস্থায়ী জলাবদ্ধতার মোকাবিলা
বাংলাদেশে বন্যা প্রায় নিয়মিত দর্শন। প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রস্তুতি-র ক্ষেত্রে বন্যার জন্য দীর্ঘমেয়াদী ও তাৎক্ষণিক – দুই ধরনের ভাবনা জরুরি:
- গৃহ নির্মাণ ও মেরামত: বন্যা প্রবণ এলাকায় বাড়ি তৈরি বা মেরামতের সময় উঁচু ভিত্তি (প্লিন্থ লেভেল), পানিনিরোধক উপকরণ ব্যবহার অত্যাবশ্যক। বৈদ্যুতিক সুইচবোর্ড, মিটার ইত্যাদি যতটা সম্ভব উঁচুতে স্থাপন করুন। নলকূপের মাথা উঁচু করে রাখুন দূষণ রোধে।
- খাদ্য, পানি ও স্বাস্থ্য:
- শুকনো ও দীর্ঘস্থায়ী খাবার: চাল, ডাল, চিড়ে, মুড়ি, গুড়, শুকনো বিস্কুট, টিনজাত খাবার, শুকনো মরিচ-পেঁয়াজ সংরক্ষণ। প্লাস্টিক ড্রামে বিশুদ্ধ পানি ভরে রাখুন (প্রতি সদস্যের জন্য কমপক্ষে ৩ দিনের জলাভাব মেটানোর পরিমাণ)।
- ওষুধপত্র: নিয়মিত প্রয়োজনীয় ওষুধ (বিপি, ডায়াবেটিস, হাঁপানি), ORS, পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট (পানি বিশুদ্ধকরণে), জীবাণুনাশক, মশারি, ফার্স্ট এইড বক্স অবশ্যই প্রস্তুত রাখুন।
- স্বাস্থ্য সচেতনতা: বন্যার পানিতে ডায়রিয়া, টাইফয়েড, চর্মরোগের প্রকোপ বাড়ে। বিশুদ্ধ পানি পান, সাবান দিয়ে হাত ধোয়া, রান্না-খাওয়ার আগে পাত্র জীবাণুমুক্ত করা জরুরি।
- গবাদিপশু ও কৃষি: গবাদিপশুর জন্য উঁচু শেড বা আশ্রয়স্থল ঠিক করুন। দ্রুত কাটা যায় এমন ফসল (যেমন: কলা, পেঁপে) আগে থেকে রোপণ বিবেচনা করুন। বীজ, সার নিরাপদ উঁচু স্থানে রাখুন।
- বন্যায় তাৎক্ষণিক করণীয়:
- রেডিও/মোবাইলে নিয়মিত বন্যা সতর্কতা শুনুন।
- দ্রুত মূল্যবান জিনিস (দলিল, টাকা, ওষুধ, শুকনো খাবার) উঁচু স্থানে তুলুন।
- বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করুন।
- নির্দিষ্ট উঁচু আশ্রয়কেন্দ্র বা নিরাপদ স্থানে সরে যান। নৌকা বা ভেলা প্রস্তুত রাখুন।
- ভাসমান বস্তু, সাপ-পোকামাকড় থেকে সতর্ক থাকুন।
ঘূর্ণিঝড়: প্রচণ্ড বাতাস ও জলোচ্ছ্বাসের বিরুদ্ধে লড়াই (H3)
ঘূর্ণিঝড়ের প্রধান আতঙ্ক জলোচ্ছ্বাস (Storm Surge) ও প্রচণ্ড বাতাস। প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রস্তুতি এখানে দ্রুত সাড়াদান ও কঠিন কাঠামোগত নিরাপত্তার সমন্বয়:
- আশ্রয়কেন্দ্র জেনে রাখুন: আপনার নিকটতম সাইক্লোন শেল্টার কোথায়, কীভাবে যাবেন, সেখানে কী নিতে হবে (জরুরি কিট, পানি, কিছু খাবার) – পরিবারের সবাইকে জানান। প্রতিবন্ধী বা অসুস্থ ব্যক্তির জন্য বিশেষ ব্যবস্থা আছে কিনা খোঁজ নিন।
- বাড়ি সুরক্ষিত করা:
- জানালা-দরজায় শক্ত শাটার বা ক্রসব্রেসিং (Cross Bracing) দিন। না পারলে পুরু কাঠের তক্তা দিয়ে মজবুত করে বন্ধ করার ব্যবস্থা রাখুন।
- ছাদের টিন, চিলেকোঠার হালকা জিনিসপত্র শক্ত করে বেঁধে রাখুন বা নামিয়ে ফেলুন।
- আশেপাশের গাছের ডালপালা কেটে রাখুন যা ঝড়ে ভেঙে ক্ষতি করতে পারে।
- জরুরি যোগাযোগ ও তথ্য:
- ডিএমডি’র হটলাইন নম্বর (১০৯০, ১০৯১) এবং স্থানীয় প্রশাসন/ইউনিয়ন পরিষদের জরুরি নম্বর ফোনে সেভ করুন।
- বেতার (রেডিও) চালু রাখুন – সাইক্লোনের গতিপথ, তীব্রতা, স্থলভাগে আঘাতের সময়ের আপডেট পেতে এটি সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য।
- পরিবারের জন্য একটি পুনর্মিলন স্থান (বাড়ি থেকে দূরে কোনো নিরাপদ জায়গা বা আত্মীয়ের বাসা) ঠিক করুন যদি যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
- ঘূর্ণিঝড়ের সময় করণীয়:
- সিগন্যাল ৩ উঠলেই দ্রুত আশ্রয়কেন্দ্রে বা শক্ত কংক্রিট বাড়িতে চলে যান। জলোচ্ছ্বাসের ঝুঁকিতে থাকা নিম্নাঞ্চল ত্যাগ করুন।
- বিদ্যুৎ, গ্যাসের মেইন সুইচ বন্ধ করুন।
- জানালা-দরজা থেকে দূরে, বাড়ির সবচেয়ে মজবুত কক্ষের ভিতরের দিকে অবস্থান নিন।
- জলোচ্ছ্বাসের সময় উঁচু ভবনের উপরতলায় যান, গাছ বা বৈদ্যুতিক খুঁটির কাছে দাঁড়াবেন না।
ভূমিধস: পাহাড়ি এলাকার নীরব ঘাতক (H3)
চট্টগ্রাম, রাঙামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়িতে বর্ষায় ভূমিধস ভয়াবহ রূপ নেয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রস্তুতি এখানে ঝুঁকিপূর্ণ স্থান চিহ্নিতকরণ ও সতর্ক পর্যবেক্ষণের উপর নির্ভরশীল:
- ঝুঁকি মূল্যায়ন:
- খাড়া পাহাড়ের পাদদেশে, প্রাকৃতিক নালার পাশে, ভূমিধসের ইতিহাস আছে এমন জায়গায় বাড়ি নির্মাণ এড়িয়ে চলুন।
- পাহাড় কাটার সময় সঠিক ঢাল (Slope Angle) বজায় রাখুন, রিটেইনিং ওয়াল (Retaining Wall) বানান।
- পাহাড়ের গায়ে গাছপালা কাটা (যার শিকড় মাটি ধরে রাখে) মারাত্মক ঝুঁকি বাড়ায়।
- সতর্কতা লক্ষণ:
- দেয়ালে নতুন ফাটল দেখা দেওয়া।
- দরজা-জানালা আটকে যাওয়া বা সহজে না খোলা।
- মাটি বা পাথর খসা শুরু হওয়া।
- পাহাড় থেকে অস্বাভাবিক শব্দ (গর্জন বা ফাটলের শব্দ) শোনা।
- ঝরনা বা নালার পানির রং হঠাৎ ঘোলা হয়ে যাওয়া (মাটি ক্ষয়ের ইঙ্গিত)।
- তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ:
- সতর্কতা লক্ষণ দেখামাত্রই দ্রুত নিরাপদ স্থানে (ভূমিধসের গতিপথের বাইরে, উঁচু ও সমতল স্থান) সরে যান।
- আশেপাশের মানুষজনকে সতর্ক করুন।
- স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে জানান।
- বিদ্যুৎ-গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করুন (নিরাপদে থাকলে)।
অবশ্যই প্রস্তুত রাখুন: আপনার পরিবারের জরুরি প্রস্তুতি কিট (Emergency Go-Bag)
প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রস্তুতি-র সবচেয়ে বাস্তব ও কার্যকরী পদক্ষেপ হল একটি পোর্টেবল জরুরি কিট তৈরি করে সহজে নাগালের জায়গায় রাখা। এটি এমন হওয়া উচিত যেন ৭২ ঘন্টা (৩ দিন) আপনার পরিবারের মৌলিক চাহিদা মেটাতে পারে:
- জল: ব্যক্তিপ্রতি কমপক্ষে ৩-৪ লিটার (পান ও প্রাথমিক স্বচ্ছতার জন্য)। সিল করা প্লাস্টিক বোতলে সংরক্ষণ। পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট (Aquatabs) বা ফিল্টার রাখুন।
- খাদ্য:
- শুকনো খাবার: বিস্কুট, চিড়ে, মুড়ি, খই, শুকনো ফল, চিনি, লবণ।
- টিনজাত খাবার (যেমন: ডাল, সবজি, ফল, মাছ/মাংস – খোলার জন্য ক্যান ওপেনারসহ)।
- উচ্চ শক্তির খাবার: চকলেট, এনার্জি বার।
- শিশু থাকলে পর্যাপ্ত শিশুখাদ্য ও দুধের ফর্মুলা।
- মনে রাখুন: রান্নার প্রয়োজন হয় না বা খুব সহজে প্রস্তুত করা যায় – এমন খাবার নির্বাচন করুন।
- প্রাথমিক চিকিৎসা সরঞ্জাম (First Aid Kit):
- ব্যান্ডেজ (বিভিন্ন সাইজ), গজ কাপড়, অ্যাডহেসিভ টেপ, কাঁচি।
- জীবাণুনাশক (স্যাভলন/ডেটল), অ্যান্টিসেপটিক ক্রিম।
- ব্যথানাশক (প্যারাসিটামল), পাতলা পায়খানার ওষুধ (Loperamide), অ্যান্টাসিড।
- ORS প্যাকেট, প্রয়োজনীয় ব্যক্তিগত ওষুধ (কমপক্ষে ৭ দিনের স্টক)।
- জ্বর মাপার থার্মোমিটার, টুইজার্স, সেফটি পিন।
- যোগাযোগ ও আলো:
- হ্যান্ড-ক্র্যাঙ্ক বা সোলার চার্জারযুক্ত রেডিও (বেতার সংবাদ শোনার জন্য)।
- অতিরিক্ত ব্যাটারিসহ টর্চলাইট (প্রতি ব্যক্তির জন্য আলাদা হলে ভালো)।
- অতিরিক্ত ব্যাটারি (সব ডিভাইসের জন্য)।
- পাওয়ার ব্যাংক (ফুল চার্জড রাখুন)।
- সিটি (Whistle) – সাহায্যের জন্য সংকেত দিতে।
- নথিপত্র ও টাকা:
- পাসপোর্ট, জন্মনিবন্ধন, জাতীয় পরিচয়পত্র, ভোটার আইডি, জমির দলিলের ফটোকপি – ওয়াটারপ্রুফ পাউচে রাখুন।
- কিছু নগদ টাকা (ছোট নোটে) ও কয়েন।
- জরুরি যোগাযোগ নম্বরের লিস্ট (আত্মীয়স্বজন, বন্ধু, স্থানীয় কর্তৃপক্ষ)।
- স্বাস্থ্যকরতা ও অন্যান্য:
- সাবান, হ্যান্ড স্যানিটাইজার, টয়লেট পেপার, স্যানিটারি ন্যাপকিন/ট্যাম্পন, ডায়াপার (প্রয়োজন হলে)।
- বহু-উদ্দেশ্য ছুরি (সুইস আর্মি নাইফ বা Multi-tool)।
- স্থানীয় মানচিত্র (হাতে আঁকা বা প্রিন্ট করা)।
- কাপড়ের পুরো সেট, রেইনকোট/প্লাস্টিক শীট, কম্বল/স্লিপিং ব্যাগ।
- মুখোশ (ধুলোবালি, ধোঁয়া থেকে)।
টিপ: কিটটি একটি শক্তিশালী, বহনযোগ্য ব্যাগে (ব্যাকপ্যাক/ডাফেল ব্যাগ) রাখুন। প্রতি ৬ মাসে একবার খাবার ও ওষুধের এক্সপাইরি ডেট চেক করুন এবং প্রয়োজনীয় জিনিস রিপ্লেস করুন। পরিবারের সবার জানা উচিত এটি কোথায় রাখা আছে।
দুর্যোগের সময় ও পরে: আতঙ্ক নয়, দৃঢ়তায় কী করবেন?
প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রস্তুতি শুধু আগে নয়, দুর্যোগ চলাকালীন ও পরবর্তী সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়াও এর অংশ।
দুর্যোগ চলাকালীন (During the Disaster)
- শান্ত থাকুন: আতঙ্কিত হলে ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। গভীর শ্বাস নিন, প্রস্তুতির কথা মনে করুন।
- নির্ভরযোগ্য তথ্য শুনুন: সরকারি রেডিও (বিটিআরসি, বাংলাদেশ বেতার), টেলিভিশন চ্যানেল বা ডিএমডি’র অফিসিয়াল অ্যাপ/ওয়েবসাইটের নির্দেশনা অনুসরণ করুন। গুজব বা সোশ্যাল মিডিয়ার অপ্রমাণিত খবরে কান দেবেন না।
- আশ্রয়স্থলে থাকুন: ঝড়, বন্যা বা ভূমিধসের তীব্রতা কাটা পর্যন্ত নিরাপদ আশ্রয়ে অবস্থান করুন। বাইরে বেরোনোর তাড়না সামলান।
- বিদ্যুৎ ও গ্যাস: নিরাপদ মনে না হলে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মেইন সুইচ বন্ধ রাখুন। লিকের গন্ধ পেলে দ্রুত বেরিয়ে যান।
- অন্যদের সাহায্য করুন: নিজে নিরাপদ থাকলে প্রতিবেশী, বিশেষ করে বৃদ্ধ, শিশু বা প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সাহায্য করুন।
দুর্যোগ-পরবর্তী (After the Disaster)
- নিরাপত্তা যাচাই করুন: বাইরে বেরোনোর আগে আশেপাশের পরিস্থিতি যাচাই করুন। ভাঙা বৈদ্যুতিক তার, ক্ষতিগ্রস্ত ভবন, ভূমিধসের অবশিষ্ট ঝুঁকি, সাপ-বিচ্ছু থেকে সতর্ক থাকুন।
- জরুরি সহায়তা: আহত ব্যক্তিদের প্রাথমিক চিকিৎসা দিন। গুরুতর আহতদের স্থানীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা রিলিফ ক্যাম্পে নিয়ে যান। জরুরি নম্বরে সাহায্য চাইতে দ্বিধা করবেন না (৯৯৯)।
- যোগাযোগ স্থাপন: পরিবারের অন্য সদস্যদের খোঁজ নিন। আগে ঠিক করা পুনর্মিলন স্থানে যান। মোবাইল নেটওয়ার্ক চালু হলে প্রিয়জনদের জানান আপনি নিরাপদ আছেন।
- পানি ও খাদ্য সতর্কতা: নলকূপের পানি ফুটিয়ে বা বিশুদ্ধ করে পান করুন। বন্যার পানি বা ভেজা/নষ্ট খাবার এড়িয়ে চলুন। রিলিফের খাদ্য/পানি গ্রহণে সতর্ক থাকুন।
- ঘর ফেরা: ঘরে ফেরার আগে স্থানীয় কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিন। ঘর প্রবেশের আগে গ্যাস লিক, বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট, কাঠামোগত দুর্বলতা আছে কিনা ভালো করে পরীক্ষা করুন।
- মানসিক স্বাস্থ্য: দুর্যোগের অভিজ্ঞতা মানসিক আঘাত দিতে পারে। নিজের ও পরিবারের সদস্যদের মানসিক অবস্থা লক্ষ্য করুন। কথা বলুন, অনুভূতি শেয়ার করুন। প্রফেশনাল কাউন্সেলিং সহায়তা নিতে সংকোচ করবেন না। স্থানীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা এনজিওগুলো প্রায়ই সাইকোসোসিয়াল সাপোর্ট দেয়।
- ক্ষতি রিপোর্ট ও সাহায্য প্রাপ্তি: ইউনিয়ন পরিষদ বা উপজেলা প্রশাসনে ক্ষতির পরিমাণ রিপোর্ট করুন। সরকারি ত্রাণ বা পুনর্বাসন সহায়তার জন্য রেজিস্ট্রেশন করুন।
মনে রাখবেন: পুনরুদ্ধার সময়সাপেক্ষ। ধৈর্য ধরুন, একে অপরের সাহায্য করুন। সম্প্রদায়ের সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টাই দ্রুত স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার চাবিকাঠি।
প্রযুক্তি ও সম্প্রদায়: প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রস্তুতির আধুনিক সহায়ক
প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রস্তুতি-কে আরও কার্যকর করতে প্রযুক্তি ও সামাজিক সংগঠন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে:
- আর্লি ওয়ার্নিং সিস্টেম (Early Warning Systems): ডিএমডি’র অ্যাপ, এসএমএস অ্যালার্ট, কমিউনিটি লাউডস্পিকার, রেডিও ও টিভি ব্রডকাস্টের মাধ্যমে দুর্যোগের আগাম সতর্কতা এখন অনেক বেশি সহজলভ্য। এই সতর্কতাগুলো গুরুত্ব সহকারে নিন এবং তাড়াতাড়ি পদক্ষেপ নিন।
- মোবাইল অ্যাপস:
- ‘ঘরে ঘরে দুর্যোগ প্রস্তুতি’ (DMD Ready): ডিএমডি’র অফিসিয়াল অ্যাপ, দুর্যোগের পূর্বাভাস, নিকটস্থ আশ্রয়কেন্দ্রের মানচিত্র, প্রস্তুতি গাইডলাইন ও জরুরি হেল্পলাইন নম্বর প্রদান করে।
- ‘বন্যা সতর্কতা’ (FFWC): বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের অ্যাপ, নদীর পানির স্তর ও বন্যা পরিস্থিতি হালনাগাদ তথ্য দেয়।
- সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম (সতর্কতার সাথে): ফেসবুক গ্রুপ, টুইটার হ্যাশট্যাগ (#CycloneAlertBD, #FloodSituation) দ্রুত তথ্য শেয়ার করতে সাহায্য করতে পারে। তবে শুধুমাত্র সরকারি বা স্বনামধন্য সংস্থার পোস্ট/খবরেই বিশ্বাস রাখুন। গুজব ছড়ানো থেকে বিরত থাকুন।
- স্থানীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি (DMC): গ্রাম/মহল্লা ভিত্তিক এই কমিটিগুলো দুর্যোগ ঝুঁকি মূল্যায়ন, আশ্রয়কেন্দ্র ব্যবস্থাপনা, দুর্যোগকালীন সাহায্য বণ্টন এবং সচেতনতা সৃষ্টিতে কাজ করে। আপনার এলাকার DMC-তে যোগ দিন বা তাদের কার্যক্রমে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করুন।
- স্কুল, মাদ্রাসা ও কর্মস্থলে প্রস্তুতি: শিশু ও কর্মজীবীদের সুরক্ষায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও অফিসে দুর্যোগ ড্রিল নিয়মিত করা উচিত। জরুরি প্রস্থান পথ, মিলনস্থল এবং প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকা জরুরি।
লিংক: ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অধিদপ্তর (DMD) এর প্রাতিষ্ঠানিক ওয়েবসাইটে প্রস্তুতি সংক্রান্ত বিস্তারিত বাংলা রিসোর্স: https://dmd.gov.bd/
Honor 200 Pro বাংলাদেশে ও ভারতে দাম বিস্তারিত স্পেসিফিকেশনসহ
জেনে রাখুন-
- প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রস্তুতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ কোনটি?
উত্তর: পরিবারের সবার জন্য একটি জরুরি প্রস্তুতি কিট (গো-ব্যাগ) তৈরি করে সহজে নাগালের স্থানে রাখা এবং একটি পরিষ্কার পুনর্মিলন পরিকল্পনা করা। এছাড়া, আপনার এলাকার জন্য সবচেয়ে বড় ঝুঁকি কী (বন্যা/ঘূর্ণিঝড়/ভূমিধস) তা জেনে সেই অনুযায়ী সুনির্দিষ্ট প্রস্তুতি নেওয়া ও নিকটস্থ আশ্রয়কেন্দ্রের অবস্থান জেনে রাখা অত্যন্ত জরুরি। - জরুরি কিটে কী কী রাখতে হবে তার একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা চাই?
উত্তর: সংক্ষিপ্ত তালিকা: (১) ব্যক্তিপ্রতি ৩-৪ লিটার পানি, (২) শুকনো/টিনজাত খাবার (৩ দিনের), (৩) ফার্স্ট এইড বক্স ও প্রয়োজনীয় ওষুধ, (৪) টর্চলাইট ও অতিরিক্ত ব্যাটারি, (৫) রেডিও (হ্যান্ড-ক্র্যাঙ্ক/সোলার), (৬) গুরুত্বপূর্ণ নথির ফটোকপি (ওয়াটারপ্রুফ পাউচে), (৭) কিছু নগদ টাকা, (৮) হ্যান্ড স্যানিটাইজার/সাবান, টয়লেট পেপার, (৯) রেইনকোট/কম্বল, (১০) মাল্টি-টুল ছুরি। - বন্যা বা ঘূর্ণিঝড়ের সতর্কতা পেলে সঙ্গে সঙ্গে কী করব?
উত্তর: (১) জরুরি কিট ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র প্রস্তুত রাখুন। (২) বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মেইন সুইচ বন্ধ করুন। (৩) বাড়ির জানালা-দরজা শক্ত করে বন্ধ করুন/শাটার দিন। (৪) নিকটস্থ উঁচু ও শক্তিশালী আশ্রয়কেন্দ্রে (Cyclone Shelter) বা নিরাপদ স্থানে (বন্যার জন্য) দ্রুত চলে যান। (৫) স্থানীয় কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা শুনুন ও মেনে চলুন। (৬) পরিবারের সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন। - ভূমিধসের কোনো পূর্ব লক্ষণ দেখলে কী করণীয়?
উত্তর: (১) সঙ্গে সঙ্গে ওই স্থান থেকে দূরে সরে যান, ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা ত্যাগ করুন। (২) আশেপাশের মানুষজনকে জোরে জোরে সতর্ক করুন। (৩) স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ/পৌরসভা/উপজেলা প্রশাসনকে ফোন করে খবর দিন। (৪) কোনো অবস্থাতেই ভূমিধসের গতিপথের দিকে বা নিচে যাবেন না। (৫) নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান নিয়ে সাহায্যের অপেক্ষা করুন। - দুর্যোগ-পরবর্তী মানসিক আঘাত (PTSD) মোকাবিলা কীভাবে সম্ভব?
উত্তর: (১) নিজের অনুভূতি সম্পর্কে কথা বলুন – পরিবার, বন্ধু বা কাউন্সেলরের সাথে শেয়ার করুন। (২) পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিন, যথাসম্ভব স্বাভাবিক রুটিনে ফিরে আসার চেষ্টা করুন। (৩) শিশুদের প্রতি বিশেষ মনোযোগ দিন, তাদের ভয় প্রশমিত করুন, খেলার ছলে কথা বলুন। (৪) নিজেকে দোষারোপ করা বা আটকে রাখা এড়িয়ে চলুন। (৫) প্রফেশনাল সাহায্য নিতে সংকোচ করবেন না। স্থানীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা এনজিওগুলো প্রায়ই সাইকোসোসিয়াল সাপোর্ট দেয়। - শিশুদের দুর্যোগ প্রস্তুতিতে কীভাবে শেখাবো?
উত্তর: (১) বয়স উপযোগী ভাষায় দুর্যোগ সম্পর্কে সহজভাবে বুঝিয়ে বলুন, ভয় না দেখিয়ে সতর্কতা শেখান। (২) জরুরি কিট দেখান, জিনিসপত্রের ব্যবহার বুঝিয়ে দিন। (৩) পুনর্মিলন স্থান ও জরুরি নম্বরগুলো শেখান ও লিখে দিন। (৪) দুর্যোগ ড্রিলের অনুশীলন করান (আশ্রয় নেওয়া, মাথা ঢাকা ইত্যাদি)। (৫) তাদের ছোট্ট জরুরি ব্যাগ (পানির বোতল, হালকা খাবার, পছন্দের ছোট খেলনা, হুইসেল) তৈরি করতে উৎসাহিত করুন।
বিশেষ সতর্কতা: এই গাইডলাইন সাধারণ তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি। নির্দিষ্ট এলাকার জন্য সর্বাধিক প্রাসঙ্গিক ও হালনাগাদ নির্দেশনার জন্য সর্বদা বাংলাদেশ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর (DMD), স্থানীয় প্রশাসন এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) বা রেড ক্রিসেন্ট/রেড ক্রস এর অফিসিয়াল নির্দেশনা অনুসরণ করুন।
প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রস্তুতি কখনোই সময় বা সম্পদের অপচয় নয়; এটা আপনার পরিবার, আপনার সম্প্রদায় এবং আপনার ভবিষ্যতের জন্য একমাত্র টেকসই বিনিয়োগ। আজকের এই পরিকল্পনা, এই ছোট ছোট পদক্ষেপই কালকে আপনার প্রিয়জনের মুখে হাসি ফোটানোর নিশ্চয়তা দিতে পারে। ভবিষ্যতের কোন ঘূর্ণিঝড়, কোন বন্যাকে ভয় নয়, বরং প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রস্তুতি-র আত্মবিশ্বাস নিয়ে মোকাবিলা করুন। আপনার তৈরি করা জরুরি কিট, আপনার জানা আশ্রয়কেন্দ্রের পথ, আপনার পরিবারের সাথে করা পরিকল্পনা – এগুলোই হবে আপনার সবচেয়ে বড় শক্তি। আজই শুরু করুন। আপনার বাড়িতে বসে পরিবারের সদস্যদের সাথে আলোচনা করুন। জরুরি কিটের তালিকা তৈরি করুন। আপনার নিকটতম আশ্রয়কেন্দ্রটি চিনে নিন। এই সহজ প্রস্তুতিই হতে পারে আপনার জীবনের সেরা সিদ্ধান্ত।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।