আফ্রিকার বুকে একটি ক্ষুদ্র দেশ বতসোয়ানা। দীর্ঘদিন পর্যন্ত অনেকটাই অজানাই ছিল এই দেশটি, কিন্তু একটি বিস্ময়কর আবিষ্কার রাতারাতি বদলে দিয়েছে সবকিছু। গ্যাবোরোন থেকে প্রায় ১৭০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে, একটি প্রাচীন নিস্তেজ আগ্নেয়গিরির গর্ভে আবিষ্কৃত হয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান হীরার খনি—জোয়ানেং। পৃথিবীর ভেতরের গভীরে লুকিয়ে থাকা এই হীরার খনি শুধু অর্থনৈতিক দিক দিয়েই নয়, প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ ও পরিবেশবান্ধব খননপদ্ধতির জন্যও বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এই হীরার খনি আবিষ্কারের ফলে বদলে গেছে পুরো একটি দেশের ভাগ্য।
Table of Contents
হীরার খনি: জোয়ানেঙের ঐতিহাসিক আবিষ্কার ও আর্থিক মূল্য
জোয়ানেং হীরার খনি বতসোয়ানার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত একটি অদ্ভুত ভূপ্রাকৃতিক কাঠামোর মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায়। এটি এক প্রাচীন আগ্নেয়গিরির কিম্বারলাইট শিলায় গঠিত। কিম্বারলাইট একটি গভীরভূমি থেকে উঠে আসা আগ্নেয়শিলা, যেটির মধ্যে হীরার সৃষ্টি হয় উচ্চ তাপমাত্রা ও চাপে। এই ধরনের শিলা সাধারণত পৃথিবীর আভ্যন্তরস্থ স্থানে পাওয়া যায়, এবং সেখান থেকেই উঠে আসে হীরা।
এই খনিটি আবিষ্কৃত হয় ১৯৭০ সালে, ব্রিটিশ খ্যাতনামা হীরা সংস্থা ডি বিয়ার্সের একটি অনুসন্ধান অভিযানের সময়। খনিটি থেকে বাণিজ্যিকভাবে হীরার উৎপাদন শুরু হয় ১৯৮২ সালে। সেই সময় থেকেই এটি বিশ্ব হীরাবাজারে এক নতুন মাত্রা যোগ করে।
বর্তমানে খনিটির বাজারমূল্য প্রায় ৯ হাজার ৬১৫ কোটি মার্কিন ডলার। শুধুমাত্র ২০২৩ সালেই এই খনি থেকে উৎপাদিত হয় ১৩৩ লক্ষ ক্যারাট হীরা, যা পৃথিবীর সর্বোচ্চ উৎপাদনশীল খনিগুলোর মধ্যে অন্যতম। এখান থেকে উত্তোলিত হীরার গুণগত মান এতটাই উন্নত যে, এটিকে ‘খনির রাজপুত্র’ নামেও অভিহিত করা হয়।
কিম্বারলাইট পাইপ ও খনির গঠনপ্রণালি
জোয়ানেং খনি গঠিত হয়েছে মূলত তিনটি কিম্বারলাইট পাইপ দ্বারা। এই পাইপগুলো হলো ভূগর্ভস্থ খনিজ পদার্থের উল্লম্ব শিরা, যেগুলো আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাতের ফলে তৈরি হয়। এই কিম্বারলাইট শিলায় ঘন ও ভারী খনিজের উপস্থিতির কারণে হীরা সৃষ্টি হয় এবং ভূ-উপরে উঠে আসে।
এই খনির প্রতিটি পাইপই বছরের পর বছর ধরে বিপুল পরিমাণ হীরা উৎপাদন করে চলেছে। আধুনিক ড্রিলিং প্রযুক্তি এবং ট্রাক পরিবহণ ব্যবস্থার মাধ্যমে এই হীরাগুলো উত্তোলন করা হয়। এক্সরে, লেজার সর্টার ও স্বয়ংক্রিয় স্ক্যানিং সিস্টেমের মতো প্রযুক্তির ব্যবহারে প্রক্রিয়াজাত পাথর থেকে হীরা আলাদা করা হয়।
খনিটির গভীরতা বর্তমানে প্রায় ৪০০ মিটার। তবে ২০২৪ সালে নতুন করে “কাট-৯” নামের একটি প্রকল্প শুরু হয়েছে, যার মাধ্যমে খনিটির গভীরতা ও উৎপাদনক্ষমতা আরও বাড়ানো হচ্ছে। এই সম্প্রসারণের ফলে খনিটির আয়ুষ্কাল ২০৩৪ সাল পর্যন্ত বাড়ানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
বতসোয়ানার অর্থনীতিতে হীরার খনির অবদান
হীরার খনি আবিষ্কারের আগে বতসোয়ানা ছিল বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র দেশ। কিন্তু জোয়ানেং খনির আবিষ্কার দেশটির ভাগ্য বদলে দেয়। আজ বতসোয়ানা মধ্যম আয়ের দেশের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে। দেশটির সরকার এবং ডি বিয়ার্স যৌথভাবে একটি সংস্থা গঠন করে—ডেবসওয়ানা, যেটি বর্তমানে এই খনির দায়িত্বে রয়েছে।
ডেবসওয়ানা কোম্পানির আয় শতকরা প্রায় ৭০ শতাংশই আসে এই খনি থেকে। এখান থেকে প্রাপ্ত রাজস্ব দেশের অবকাঠামো উন্নয়ন, শিক্ষা, স্বাস্থ্যখাত ও কর্মসংস্থানে ব্যবহৃত হয়।
২০২১ সালের হিসাব অনুযায়ী, খনিতে প্রায় ৩০ কোটি ক্যারাট হীরার মজুত রয়েছে। ডেবসওয়ানা ২০২১ সালে ১ হাজার ৯৮ ক্যারাটের একটি বিশাল হীরা উদ্ধার করে, যা ছিল বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম।
বিশ্ব হীরাবাজারে বতসোয়ানার অবস্থান
বর্তমানে রাশিয়ার পরেই বতসোয়ানার অবস্থান হীরার উৎপাদনে। পৃথিবীর ২৩টি দেশে হীরার খনি থাকলেও, বড় আকারের ও মানসম্পন্ন হীরা সাধারণত ছয়টি দেশে—রাশিয়া, বতসোয়ানা, কানাডা, দক্ষিণ আফ্রিকা, অ্যাঙ্গোলা ও নামিবিয়ায় পাওয়া যায়।
বিশ্বের মোট হীরার প্রায় ৩০ শতাংশই রাশিয়া সরবরাহ করে। এর ১৭টি প্রধান খনি রয়েছে। অপরদিকে বতসোয়ানা হীরার গুণগত মান ও সরবরাহের দিক থেকেও প্রায় সমানতালে এগিয়ে চলেছে। জোয়ানেং খনি একাই দেশের অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করছে।
আধুনিক প্রযুক্তিতে খনির পরিচালনা ও পরিবেশ সচেতনতা
এই খনিতে ব্যবহৃত হচ্ছে বিশ্বের অত্যাধুনিক খনন প্রযুক্তি। প্রতিদিন কয়েক হাজার টন পাথর উত্তোলন করে আধুনিক প্রক্রিয়াজাত কারখানায় প্রেরণ করা হয়। সেখানে উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে হীরাগুলো আলাদা করা হয়।
তবে বিপুল পরিমাণ বর্জ্য পাথর খনিটির পরিবেশে প্রভাব ফেলতে শুরু করেছিল। এই সমস্যা বিবেচনা করে ২০০০ সালে জোয়ানেং খনিকে পরিবেশবান্ধব করার কার্যক্রম নেওয়া হয়। ফলস্বরূপ, এটি বতসোয়ানার প্রথম খনি যা আইএসও পরিবেশ সনদ অর্জন করে।
সম্প্রসারণ পরিকল্পনা ও কর্মসংস্থান
‘কাট-৯’ প্রকল্পের অধীনে খনির সম্প্রসারণের ফলে আগামী কয়েক বছরে হাজার হাজার কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। উৎপাদনের পরিমাণও বহুগুণ বাড়বে। আশা করা হচ্ছে, প্রায় ২০০০ কোটি পাউন্ড মূল্যের হীরা এই প্রকল্প থেকে আহরণ করা যাবে।
জোয়ানেং খনি বতসোয়ানার শুধু অর্থনৈতিক ভিত্তিকেই শক্তিশালী করেনি, বরং এটি প্রযুক্তি, পরিবেশ সচেতনতা এবং কর্মসংস্থানের এক যুগান্তকারী দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে।
এই হীরার খনি শুধু বতসোয়ানার নয়, বিশ্বের অর্থনীতিতেও বিশাল প্রভাব ফেলছে। খনিটির বিপুল সম্পদ, আধুনিক প্রযুক্তি ও পরিবেশ সচেতন কার্যক্রম একে একটি আদর্শ হীরার খনি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
❓ প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী (FAQs)
১. জোয়ানেং হীরার খনি কোথায় অবস্থিত?
বতসোয়ানার রাজধানী গ্যাবোরোন থেকে প্রায় ১৭০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে এই খনিটি অবস্থিত। এটি একটি প্রাচীন আগ্নেয়গিরির কিম্বারলাইট শিলায় গঠিত।
২. হীরার খনি জোয়ানেং-এর বাজার মূল্য কত?
২০২৩ সালের হিসাব অনুযায়ী, এই হীরার খনিটির বাজারমূল্য প্রায় ৯ হাজার ৬১৫ কোটি মার্কিন ডলার।
৩. খনিটি পরিচালনা করে কে?
ডেবসওয়ানা নামে একটি সংস্থা এই খনিটি পরিচালনা করে, যা ডি বিয়ার্স ও বতসোয়ানার সরকারের যৌথ মালিকানায় পরিচালিত।
৪. খনিটির গভীরতা কত এবং সম্প্রসারণ কীভাবে হচ্ছে?
বর্তমানে খনিটির গভীরতা ৪০০ মিটার, এবং ‘কাট-৯’ নামের প্রকল্পের মাধ্যমে আরও গভীরে খনন করা হচ্ছে।
৫. এই খনি বতসোয়ানার অর্থনীতিতে কতটা ভূমিকা রাখছে?
দেশটির রপ্তানি আয়, কর্মসংস্থান, অবকাঠামো উন্নয়ন ইত্যাদির পেছনে খনিটির আয় একটি বড় অবদান রাখে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।