জুমবাংলা ডেস্ক : দুজনেরই বাড়ি নাটোরে। সাম্যসাথী এইচএসসিতে পড়েছেন রাজশাহী কলেজে আর দেবযানী নাটোরের রানী ভবানী সরকারি মহিলা কলেজে। তখনো দুজনের কেউ কাউকে চিনতেন না। প্রথম দেখা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি প্রস্তুতির সময় ঢাকার একটি কোচিং সেন্টারে। তখন শুধু হাই-হ্যালোতে সীমাবদ্ধ ছিল। আসলে ভর্তি প্রস্তুতির সেই সময়টায় বিষ্ণু দের কবিতার মতো ‘প্রেম ফ্রেম বাজে’ মনে হতো।
১৯৯৩-৯৪ সেশনে সুযোগ পেলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কাকতালীয়ভাবে দুজনেই ভর্তি হলেন একই বিভাগে, ইংরেজি সাহিত্যে। সাম্যসাথীর ঠিকানা জগন্নাথ হল আর দেবযানীর শামসুন নাহার হল। তখন থেকে ধীরে ধীরে একে অন্যকে জানা-বোঝার সুযোগ পেলেন।
কে প্রথম কাছে এসেছিলেন
কে প্রথম মন হারানোর স্রোতে ভেসেছেন? প্রশ্নটা প্রথমে দেবযানীকে করেছিলাম। সরাসরি উত্তর না দিয়ে তিনি পাল্টা প্রশ্ন করলেন—‘কে প্রথম কাছে এসেছি, মান্না দে আর লতা মঙ্গেশকরের এই গানটা নিশ্চয়ই শুনেছেন? আমাদের অবস্থাও সে রকম।’ ‘ও এত বছর পরও সেই লাজুক রয়ে গেছে। বুক ফাটবে তো মুখ ফুটবে না’, বললেন সাম্যসাথী। আসলে প্রথম দেখায়ই পরস্পরকে মনে ধরে যায়। তবে কেউ বলতে পারছিলেন না। নীরবতার দেয়াল ভাঙলেন সাম্যসাথী। একদিন ক্লাসের পর দুরুদুরু বুকে দেবযানীর পিছু নিলেন। ‘দেবযানী’ লেখা একটা চিরকুট প্রেয়সীর হাতে ধরিয়ে দিয়েই সটকে পড়লেন। বললেন, ‘প্রপোজালটা আমিই দিয়েছিলাম। বলতে লজ্জা লাগছিল। একটা চিরকুট ওর হাতে দিয়ে সেবার পালিয়েছিলাম।’
এদিকে দুই দিন পার হয়ে গেছে। কিন্তু কোনো সাড়াশব্দ নেই দেবযানীর। তবে কি মন গলবে না? উত্তরের অপেক্ষায় সাম্যসাথীর তর যেন সইছিল না। তা-ও দেবযানীর মুখ ফোটেনি। একদিন চোখের ইশারায় নাটোরের এই তরুণীও সাম্যসাথীকে বললেন, ‘এত দিন কোথায় ছিলেন?’
এক দিন তোমায় না দেখিলে
এর পর থেকে ধীরে ধীরে দুজন হয়ে গেলেন দুজনার। ক্লাসের পর ক্যাম্পাসের এখানে-সেখানে চুটিয়ে আড্ডা দিতেন। প্রথম দিকে বন্ধুদের কাছে গোপন ছিল ব্যাপারটা। কিন্তু এমন প্রেম কত দিন আর চেপে রাখা যায়? বন্ধুরা জানার পর বায়না ধরল—খাওয়াতে হবে। তাদের আবদারও মেটাতে হলো। তখন দিনের একটা নির্দিষ্ট সময় মেয়েদের ‘কল’ দেওয়া যেত। মানে দেখা করতে হলে একটা চিরকুটে নাম, বিভাগ, রুম নম্বর লিখে হলের গেটম্যানদের দিতে হতো। এটা তাঁরা রুমে পৌঁছে দিতেন। এ রকম অনেক চিরকুট এখনো আগলে রেখেছেন দেবযানী। বেশির ভাগ দিন বিকেলে শামসুন নাহার হলের সামনের আইল্যান্ডে বসে আড্ডা দিতেন। সাম্যসাথী বলছিলেন, ‘তখন মানুষ আড্ডা দিতে ভালোবাসত। এমনও হয়েছে আমরা একান্তে বসে গল্প করছি। হুট করে বন্ধুবান্ধব এসে আমাদের সঙ্গে গল্প জুড়ে দিত। দুষ্টামি করত। মাঝে মাঝে খেতে চাইত।’
ক্যাম্পাসে প্রতিদিনই দেখা হতো দুজনের। সাম্যসাথী বললেন, ‘সম্ভবত বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে এমন একটা দিনও যায়নি, যেদিন আমাদের দেখা হয়নি। এমনকি পরীক্ষার ঠিক আগের দিন হলেও। মান-অভিমান হলে লোকে এখন কত কী করে। কিন্তু আমরা তখন একে অপরকে চিঠি লিখতাম। উত্তর-প্রতিউত্তরে দ্বিধা দূর করতাম।’
তাঁর কথার সুরে দেবযানী বললেন, ‘একবার তো মুষলধারে বৃষ্টি। হাঁটু পর্যন্ত জল। কোথাও বসার জো নেই। এমন বৃষ্টি ছাতাও মানে না। তখনো হলের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আলাপ করেছি। কথা যেন ফুরাত না। হলে ঢুকতাম একেবারে অন্তিম মুহূর্তে। গেটম্যানদের ‘দাদু’ বলতাম। দাদুরা দরজা পিটিয়ে যখন ডাকত, সময় একদম শেষ তখন ভেতরে ঢুকে যেতাম। প্রথম দিকে সন্ধ্যা ৭টায় গেট বন্ধ হতো। পরে সেটা বাড়িয়ে রাত ৯টা করা হলো। প্রতিদিন ৯টায়ই ঢুকতাম। তবে দাঁড়িয়ে শুধু যে প্রেমালাপ করছি তা নয়। পড়াশোনার ব্যাপারে শেয়ার করতাম।’
চাকরিও হলো একই সঙ্গে
মাস্টার্সের পর দুজনই পেশা হিসেবে বেছে নিলেন শিক্ষকতাকে। কাকরাইলের উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলে পড়াতেন সাম্যসাথী আর দেবযানী ধানমণ্ডির অক্সফোর্ড ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে। পরে সাম্যসাথী পড়িয়েছেন ধানমণ্ডির সানিডেইল স্কুলেও। পাশাপাশি সরকারি চাকরির প্রস্তুতি নিতে লাগলেন।
২০০০ সালের ৭ ডিসেম্বর বিয়ের পিঁড়িতে বসলেন তাঁরা।
২০০৩ সালে ২২তম বিসিএসে দুজনই শিক্ষা ক্যাডারে যোগদান করলেন। একই সঙ্গে সরকারি চাকরি পেয়েছেন। তবে দুজনের পোস্টিং হলো দুই জায়গায়। সাম্যসাথীর নাটোরের আব্দুলপুর সরকারি কলেজে আর দেবযানীর নওগাঁর পত্নীতলায় নজিপুর কলেজে।
চোখের আড়াল করতে চাইলেন না
দুজনের কর্মস্থলের দূরত্ব প্রায় ১০০ কিলোমিটার। তাই থাকার জন্য মধ্যবর্তী একটা জায়গা খুঁজলেন, যেখান থেকে দুজনই যাতায়াত করতে পারেন। রাজশাহীতে বাসা নিলেন। সেখান থেকেই কলেজে যেতেন। এর মধ্যে বদলির জন্য আবেদন করলেন দেবযানী। মাস ছয়েকের মধ্যে রাজশাহীর নিউ গভর্নমেন্ট ডিগ্রি কলেজে বদলি হয়ে এলেন। অন্যদিকে আব্দুলপুর সরকারি কলেজে পাঁচ বছর ছিলেন সাম্যসাথী। পরে পিএইচডির জন্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজে ভর্তি হলেন ২০০৮-০৯ সেশনে। পদোন্নতি পেয়ে ২০০৯ সালে দেবযানী রাজশাহী কলেজে এলেন। ২০১২ সালে পিএইচডি শেষে সাম্যসাথীও বদলি হয়ে এলেন সেই কলেজে। এখন কলেজটির ইংরেজি বিভাগে ১১ বছর ধরে পড়াচ্ছেন দুজন।
মা-বাবার মধ্যে এখনো যে আবেগ দেখি, তা আমাদের জেনারেশনে বিরল। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর মাঝেমধ্যেই মনে হতো, শামসুন নাহার হলের সামনে বসিয়ে মা-বাবার একটা ছবি তুলব। কয়েক দিন আগে তাঁরা ঢাকায় এসেছিলেন। তাই এবার সুযোগটা মিস করিনি। তবে ছবি তোলার সময় মা-বাবা একটু একটু লজ্জা পাচ্ছিলেন।
ভাইরাল ছবিটি
১৯৯৯ সালের শেষ দিকে মাস্টার্স পরীক্ষা হলো তাঁদের। পুরনো ছবিটি এই পরীক্ষার ঠিক আগে তোলা বলে জানালেন সাম্যসাথী, ‘ক্যাম্পাস লাইফের শেষবেলায় চাইলাম ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্পটে নিজেদের ফ্রেমবন্দি করে রাখতে। সম্ভবত আমার কোনো বন্ধু তুলে দিয়েছিল।’
আর পরের ছবিটি? সাম্যসাথী বলেন, “ঢাকায় গেলেই বিশ্ববিদ্যালয়ে যাই। যেসব জায়গায় বসতাম, সেগুলো দেখে আসি। এমনটা বহুবার হয়েছে। তবে ছবি তোলা হয়নি। আমার মেয়েটাও এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। অ্যালবামে ওই ছবিটা সে দেখেছে। এবার ঢাকা যাওয়ার পর বলল, ‘বাবা, শামসুন নাহার হলের আইল্যান্ডে তোমাদের একটা ছবি তুলব। দুই দশক আগে যেমন তুলেছিলে, তেমন করে।’ পরের ছবিটি ২৮ জানুয়ারি তোলা।” হাসতে হাসতে দেবযানী বললেন, ‘আমার মনে হয়েছে, ২৪ বছর আগের সেই দিনে ফিরে গেছি। আসলে আমরা আগের মতোই ইমোশনাল। বয়সটা শুধু সংখ্যায় বেড়েছে।’ ২ ফেব্রুয়ারি ফেসবুকে নিজের ওয়ালে দুটি ছবি পোস্ট করে সাম্যসাথী লিখেছিলেন, ‘আ গ্যাপ বিটুইন টোয়েন্টিফোর ইয়ারস।’ পোস্টটি ভাইরাল হতে সময় লাগেনি। সাম্যসাথী বললেন, ‘মাঝখানে ২৪টি বসন্ত পার হয়ে গেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যে বন্ধন গড়ে দিল তা এতটুকু মলিন হয়নি। এখন জীবনানন্দ দাশের কবিতার মতো মনে হয়, সারাদিনের ক্লান্তি শেষে মুখোমুখি বসবার মতো একজনই আছেন—তিনি নাটোরের দেবযানী।’
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।