আল ফাতাহ মামুন : রাজধানীর আশপাশের আবাসন প্রকল্পগুলোর প্লটের দাম সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। ১২ বছর আগেও যে প্লট স্বল্পমূল্যে কেনা যেত, সেগুলোর দাম এখন কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। মূল্যবৃদ্ধির এ প্রবণতাকে সামনে রেখে প্লটগুলোতে বাড়ি করার চেয়ে বাড়তি দামে বিক্রি করাকেই লাভজনক মনে করেছেন মালিকরা। ফলে এসব আবাসন প্রকল্প এলাকায় অর্ধেকের বেশি প্লট শুরু থেকে ভবন নির্মাণ ছাড়াই হাতবদল হয়েছে। ফলে দেখা যাচ্ছে, রাজধানীর আশপাশে সরকারি ও বেসরকারি আবাসন প্রকল্পগুলোর বেশির ভাগ জমি খালি পড়ে আছে। বছরের পর বছর ধরে জমির দাম বাড়ছে ঠিকই কিন্তু সে জমি বসবাস উপযোগী হচ্ছে না বা আবাসন সংকট মোকাবেলায় কোনো ভূমিকা রাখছে না।
প্লট বাণিজ্যের কৃত্রিম এ বাজার ভেঙে দিতে উদ্যোগ নিয়েছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। সম্প্রতি রাজউকের এক বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, অনুমোদনের ১০ বছরের মধ্যেই বেসরকারি আবাসন প্রকল্পগুলোর সব উন্নয়ন ও প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন করতে হবে। আর তা না করা হলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে রাজউক। তবে কী ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হবে বা কোন প্রক্রিয়ায় বিষয়টি কার্যকর করা হবে সে বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়নি। রাজউক-সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, প্লট খালি রাখার বিষয়টি জোরালোভাবে তদারকি করা হবে।
সূত্র জানায়, চলতি মাসের শুরুতে রাজউকের নগর পরিকল্পনা শাখার সভাকক্ষে বেসরকারি আবাসন প্রকল্প-সংশ্লিষ্টদের নিয়ে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ‘রাজউক কর্তৃক অনুমোদিত লে-আউট প্ল্যান অনুযায়ী সরেজমিনে বিদ্যমান খালি প্লটগুলোয় উন্নয়ন কার্যক্রম গ্রহণের জন্য করণীয় নির্ধারণ’ শীর্ষক বৈঠকে বেশকিছু সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সিদ্ধান্ত ছিল বারবার প্লট বিক্রির মাধ্যমে জমির দাম বাড়ানোর অসম প্রতিযোগিতা থামানো। এ লক্ষ্যে অনুমোদনের ১০ বছরের মধ্যেই আবাসন প্রকল্পের উন্নয়ন কার্যক্রম ও ভবন নির্মাণের সব কাজ শেষ করতে বাধ্যবাধকতা নির্ধারণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
বারবার প্লট হাতবদলের মাধ্যমে জমির দাম বাড়লেও রাজধানীর আবাসন সমস্যার সমাধান হচ্ছে না উল্লেখ করে সংস্থাটির নগর পরিকল্পনাবিদ মো. আশরাফুল ইসলাম বলেন, একশ্রেণীর উচ্চবিত্ত মানুষ মুনাফার জন্য প্লট কিনে ফেলে রাখায় প্লট বাণিজ্যের ক্ষেত্রে একটি কৃত্রিম বাজার সৃষ্টি হয়েছে। ফলে আবাসন খাত সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে। বেসরকারি আবাসন প্রকল্পসহ রাজউকের পূর্বাচল ও অন্যান্য আবাসন প্রকল্পেও এ চক্র ভাঙার জন্য রাজউক তত্পর হয়েছে। এ উদ্যোগ ক্রমবর্ধমান নগরবাসীর আবাসন সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান দেবে বলে আমরা আশাবাদী।
প্লট কিনে ফেলে রাখার কারণে সরকার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজির (বুয়েট) স্থাপত্য বিভাগের অধ্যাপক ড. খন্দকার সাব্বির আহমেদ। তিনি বলেন, বেশি মুনাফার আশায় যেসব প্লট বছরের পর বছর খালি পড়ে আছে, এতে শুধু যে জমির অপচয় হচ্ছে তা নয়। সরকারও বিভিন্নভাবে আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এসব প্লটে যদি বসতি গড়ে উঠত তাহলে সরকার হোল্ডিং ট্যাক্স, বিদ্যুৎ বিল, পানির বিলসহ নানাভাবে লাভবান হতো। গভীর দৃষ্টিতে দেখতে গেলে খালি প্লটে সরকার মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
তিনি বলেন, এ কথাও সত্য যদি কোনো আবাসন প্রকল্পে সব ধরনের নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত না হয়, তাহলে একটি বিরান এলাকায় গিয়ে তো কেউ বসবাস শুরু করবে না। কাছাকাছি দূরত্বে যদি দোকানপাট, স্কুল-কলেজ, মার্কেট, হাসপাতাল না থাকে তাহলে মানুষের বসবাস কীভাবে গড়ে উঠবে। এ বিষয়গুলোও রাজউককেই নিশ্চিত করতে হবে। সবচেয়ে ভালো হতো রাজউক যদি প্লট বিক্রি না করে, নিজেই ব্লকভিত্তিক ফ্ল্যাট বিক্রির সিস্টেম করতে পারত। এটা ব্যক্তি খাতে দিয়ে দিলে আরো ভালো হবে। রাজউক ডেভেলপারকে দিয়ে ব্লক বানাবে আর বিক্রির দায়িত্ব থাকবে রাজউকের হাতে। তাহলে আর সমস্যা থাকবে না।
রাজধানীর আবাসন সমস্যা দীর্ঘদিনের। এ সমস্যা মোকাবেলায় রাজউক পূর্বাচল ও ঝিলমিলসহ কয়েকটি আবাসন প্রকল্পের কাজ হাতে নিয়েছে। বেসরকারিভাবেও ৩৬টি আবাসন প্রকল্পের অনুমোদন দিয়েছে রাজউক। রাজউকের নিজস্ব এবং অনুমোদিত আবাসন প্রকল্পের সিংহভাগেই এখনো বসতি গড়ে ওঠেনি।
রাজউকের ওই সভায় এ সম্পর্কে প্রশ্ন ওঠে। সেখানে উপস্থিত বিভিন্ন হাউজিং প্রকল্পের প্রতিনিধিরা বলেন, রাস্তাঘাট ও ইউটিলিটি সুবিধা নিশ্চিত না হওয়ার কারণেই মূলত জমি কেনার পরও দীর্ঘ সময় আবাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলা যাচ্ছে না।
তাই বেসরকারি হাউজিং প্রকল্পের ক্ষেত্রে এ ধরনের সময় বেঁধে দেয়া সঠিক সিদ্ধান্ত নয় বলে মনে করেন খাতসংশ্লিষ্টরা।
আবাসন খাতের ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) সভাপতি আলমগীর শামসুল আলামিন কাজল বলেন, রাজউকের নিজস্ব প্রকল্পগুলোর ক্ষেত্রে অবকাঠামো নির্মাণ ও ভবন নির্মাণের সময় বেঁধে দেয়ার বিষয়টি যৌক্তিক। কিন্তু বেসরকারি আবাসন প্রকল্পের ক্ষেত্রে এ সিদ্ধান্ত সঠিক বলে মনে করি না। যেমন পূর্বাচলের জন্য ৩০০ ফুট রাস্তা নির্মাণ করা যতটা সহজ হয়েছে বেসরকারি কোনো প্রকল্পের ক্ষেত্রে কি এতটা সহজ হবে? তাই বিষয়টি শুধু রাজউকের নিজস্ব প্রকল্পের জন্যই সীমাবদ্ধ রাখা প্রয়োজন।
তবে স্বল্প আয়ের মানুষের আবাসন সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে রাজউকের এ সিদ্ধান্ত সঠিক বলে মনে করেন স্থপতি ইকবাল হাবিব। তিনি বলেন, আমরা দীর্ঘদিন ধরেই বলে আসছি জমির ব্যবসা বা ভূমি উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য সাশ্রয়ী ব্যবস্থা করতে হবে। রাজধানীর আশপাশে সরকারি ও বেসরকারি আবাসন প্রকল্পগুলোর বেশির ভাগ জমি খালি পড়ে আছে। আবাসন সুবিধা নিশ্চিত করেই হাউজিং প্রকল্প অনুমোদন দেয়া উচিত। কিন্তু রাজউক নিজেই আবাসন সমস্যার সমাধান না করে জমির দাম বাড়ানোর সব ধরনের ব্যবস্থা করে রেখেছে। পূর্বাচলে গত ২২ বছরেও আবাসন গড়ে ওঠেনি। উত্তরা থার্ড ফেজে ১৪ বছর ধরে কাজ চলছে। এ অবস্থায় রাজউক কোন মুখে অন্যকে নিষেধ করে?
প্লট কিনে ১০ বছরের বেশি ফেলে রাখা যাবে না, রাজউকের জন্য এটি একটি বিব্রতকর বাস্তবায়ন সংকল্প বলে মনে করেন এ নগর পরিকল্পনাবিদ। তিনি বলেন, তবুও এ ধরনের সিদ্ধান্ত দৃঢ়তার সঙ্গে বাস্তবায়ন করা উচিত।
আবাসন প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হলে বিশেষ করে পুরান ঢাকার ঘনবসতির সমস্যা সমাধানে বড় ভূমিকা রাখত বলে মনে করেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ মো. সিরাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, পূর্বাচলের, ঝিলমিলসহ রাজউকের যে প্রকল্পগুলো আছে, পাশাপাশি মানিকনগরের ভেতরে গ্রিন মডেল টাউনসহ যেসব বেসরকারি আবাসন প্রকল্প আছে সেগুলো যদি বসবাস উপযোগী হতো তাহলে মূল শহরের ঘনবসতিপূর্ণ অবস্থা অনেকটাই কমে যেত। পৃথিবীর সর্বোচ্চ ঘনবসতির এলাকা ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। নগর পরিকল্পনার সময় আমাদের এ বিষয়টি মাথায় রাখতে হয়। যদি এ ঘনবসতি কমানো যেত তাহলে শহরের পরিকল্পনা ও সার্বিক সেবার মান আরো বাড়ত এতে কোনো সন্দেহ নেই। তাই ঢাকার আবাসন সংকটের পাশাপাশি নাগরিক সেবার মান বাড়ানোর জন্যও খালি প্লটগুলো বসবাস উপযোগী করা জরুরি। সূত্র : বণিক বার্তা
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।