জুমবাংলা ডেস্ক : রাজশাহীতে কয়েক শ একর জমির পাকা ধান ফণীর প্রভাবে ঝড়বৃষ্টিতে তলিয়ে গেছে। কোমড় পানিতে নেমে ধান কেটে ঘরে তুলতে কৃষকের কষ্টের শেষ নেই। তবুও ফসলের ন্যায্যমূল্য তারা পাচ্ছেন না ।
দেশে বোরো কাটা শুরু হয়েছে পুরোদমে। উৎপাদনও ভালো। এরই মধ্যে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানিয়েছে, এবার বোরোর উৎপাদন গত বছরকেও ছাড়িয়ে যাবে। কিন্তু কৃষকের মুখে হাসি নেই। কারণ ক্রেতা নেই। আর ধানের যে দাম তাতে লাভ-তো দূরের কথা উৎপাদন খরচই উঠছে না। প্রতি মণ ধানে ন্যূনতম ২০০ টাকা করে লোকসান হচ্ছে কৃষকদের।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, সার, সেচ, কৃষি যন্ত্রপাতির দাম বেশি। এখন এক মণ ধানের দামে একদিনের জন্য একজন শ্রমিকও পাওয়া যায় না। এজন্য কৃষির আধুনিকায়ন জরুরি।
বিশেষজ্ঞদের অভিমত, আমাদের দেশের জমিগুলো ছোট ছোট। এজন্য উত্পাদন খরচ বেশি পড়ে। যদি কৃষকরা একত্র হয়ে একসঙ্গে জমি চাষ করে তাহলে উত্পাদন খরচ কমে আসবে। তারা লাভবান হবে। সেইসঙ্গে সরকারের অভ্যন্তরীণ ধান-চাল সংগ্রহ পদ্ধতি নিয়ে ভাবতে হবে। এতে কৃষকের কোনো লাভ হচ্ছে না। বাজারেও কোনও ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে না। তারা আরও বলেন, ফণীর আঘাতে ফসলের ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু শস্য বীমা না থাকায় কৃষক কোনো ক্ষতিপূরণ পাবে না। এসব বিষয় নিয়ে সরকারকে এখনই ভাবতে হবে।
উৎপাদন খরচ উঠছে না কৃষকের
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছর প্রতি কেজি বোরো ধান উৎপাদনে খরচ হয়েছে সাড়ে ২৪ টাকা। আর প্রতি কেজি চালের উৎপাদন খরচ পড়েছে ৩৬ টাকা। এ হিসেবে প্রতি মণ (কেজির হিসেবে) ধানের উৎপাদন খরচ হয়েছে ৯০৬ টাকা ৫০ পয়সা। অথচ বর্তমানে দেশের হাট-বাজারগুলোতে প্রতি মণ বোরো ধান বিক্রি হচ্ছে ৫শ থেকে সর্বোচ্চ ৭শ টাকায়। অর্থাৎ প্রতি মণ ধানে কৃষকের লোকসান দাঁড়াচ্ছে প্রায় ২শ থেকে ৪শ টাকা। বর্তমান দরে কৃষক তার কষ্টার্জিত ফসল বিক্রি করে স্বচ্ছলতার মুখ দেখা-তো দূরের কথা জীবিকা চালানোই অসম্ভব হয়ে পড়েছে। অথচ গত এক দশক ধরেই ধানের উৎপাদন ক্রমাগত বাড়িয়ে চলেছেন কৃষক। চলতি বছরের শুরুতে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) এবং যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিষয়ক সংস্থা ইউএসডিএ বলেছে, বিশ্বে এ বছর ধানের উৎপাদন সবচেয়ে বেড়েছে বাংলাদেশে।
গত কয়েক বছরের অর্থনৈতিক সমীক্ষা থেকে দেখা যায়, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে দেশে মোট চাল উৎপাদন হয় তিন কোটি ৪৭ লাখ টন, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে তিন কোটি ৩৮ লাখ টন আর ২০১৭-১৮ অর্থবছরে উৎপাদন হয় তিন কোটি ৬২ লাখ টন। এ বছর চালের উৎপাদন অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যাবে বলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানিয়েছে।
সূত্র জানায়, চলতি অর্থবছরে আউশ, আমন ও বোরো মিলে মোট তিন কোটি ৬৪ লাখ টন চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সরকার। এর মধ্যে চলতি অর্থবছরে আউশ মৌসুমে ২৯ লাখ ২০ হাজার টন ও আমনে এক কোটি ৪৩ লাখ টন চাল উৎপাদিত হয়েছে। বিশ্বব্যাংক বলেছে, পরপর কয়েক বছর ধানের বাম্পার ফলনের ফলে কৃষিতে প্রবৃদ্ধি বাড়ছে। কিন্তু কৃষকের জীবনমানের কোনও উন্নতি নেই। তাদের ভাগ্য বদলাচ্ছে না।
১৯৯৬ সালের কৃষিশুমারি অনুযায়ী ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক, মাঝারি ও বড় কৃষকের সংখ্যা যথাক্রমে ৭৯ দশমিক ৮৭ শতাংশ, ১৭ দশমিক ৬১ ও ২ দশমিক ৫২ শতাংশ। ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষিরা মহাজনের কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ করে ফসল ফলান। তারা ফসল ওঠার সঙ্গে সঙ্গে তা বিক্রি করে দেন। এ সময় যদি ধানের ন্যায্য দাম না পাওয়া যায় তাহলে তারা একদম পথে বসে যান।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, সরকারের অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে ধান-চাল সংগ্রহের কার্যকর ব্যবস্থাপনা গড়ে না ওঠায় তা কৃষকের কোনও কাজে আসছে না। গত আমন মৌসুমেও ৮ লক্ষ টন সিদ্ধ চাল সংগ্রহ করেও বাজারে ধানের দামে কোনও ইতিবাচক প্রভাব পড়েনি। এ বছর বোরো মৌসুমে ২৬ টাকা কেজি দরে ধান ও ৩৬ টাকা কেজি দরে ১২ লাখ টন চাল কিনবে সরকার। কিন্তু কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি না কেনায় তাদের ভাগ্যের কোনও পরিবর্তন হবে না। অথচ ২০০৬ সালের জাতীয় খাদ্য নীতিতেও অতিরিক্ত উৎস হিসেবে উন্মুক্ত প্রতিযোগিতামূলক দরপত্রের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে খাদ্যশস্য সংগ্রহের নির্দেশনা রয়েছে।
সিরিয়াসলি ভাবছেন কৃষিমন্ত্রী
এ প্রসঙ্গে কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, সরকার অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে প্রতি বছর যে ধান-চাল সংগ্রহ করে তাতে কিছু পলিটিক্যাল অ্যাক্টিভিস্ট, মিলার ও ব্যবসায়ীরা লাভবান হচ্ছে। এতে কৃষকের কোনও লাভ নেই। এবারও বোরো মৌসুমে ধানের দাম কম উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা বিষয়টা নিয়ে সিরিয়াসলি ভাবছি। এ ব্যাপারে খুব শিগগির কৃষি, খাদ্য ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বসে করণীয় ঠিক করব।
এক প্রশ্নের জবাবে ড. রাজ্জাক বলেন, আমাদের এখন সাড়ে তিন কোটি টনের বেশি চাল উৎপাদন হয়। সেখানে ১০ লাখ টন চাল সংগ্রহ করলে বাজারে কোনও প্রভাব পড়বে না। আমাদের সারের দাম আরও কমাতে হবে। ভর্তুকি বাড়াতে হবে কৃষি যন্ত্রপাতিতে। কৃষিমন্ত্রী বলেন, এখন তো প্রতিদিন ৬ শ টাকা ও তিন বেলা খাওয়াতেও একজন শ্রমিক পাওয়া যায় না। তিনি বলেন, ৬০/৭০ ভাগ বোরো কাটার পর আমরা উৎপাদন দেখবো। প্রয়োজনে উদ্বৃত্ত চাল রফতানি করব। তাহলে কৃষক লাভবান হবে।
বিশেষজ্ঞরা যা বলেন
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক মুস্তফা কে মুজেরী বলেন, প্রতিবছর কৃষক ধানের উৎপাদন বাড়ালেও সে তার ফসলের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে না। কিন্তু যেভাবেই হোক কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে হবে। না হলে কৃষক ফসল উৎপাদনে আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। তিনি বলেন, যখন ফসল ওঠে তখন একজন ক্ষুদ্র কৃষক তার ফসল ধরে রাখতে পারে না। কারণ তখন ফসল বিক্রি করে তার প্রয়োজন মেটাতে হয়। এই সুযোগটাই নেয় মধ্যস্বত্বভোগীরা। এজন্য যখন ফসল ওঠে তখন কৃষক যেন তার ফসল রেখে প্রয়োজনীয় অর্থ নিতে পারে এবং পরে ফসল বিক্রি করে সে অর্থ ফেরত দিতে পারে সে ব্যবস্থা করতে হবে।
বিআইডিএস-এর সাবেক এই মহাপরিচালক আরো বলেন, সরকারি পর্যায়ে কৃষিপণ্যের বিতরণ ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে হবে। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি ও কৃষির জন্য প্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। সেইসঙ্গে কৃষিকে আধুনিকায়ন করতে হবে। যন্ত্রপাতির ব্যবহার বাড়াতে হবে।
জানা গেছে, এবার বোরোর ফলন ভাল হওয়ায় কৃষকরা যে স্বপ্ন দেখেছিল তা বেচা-কেনা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মুছে গেছে। গত মৌসুমের চেয়ে ধানের দাম এবার ২শ’ থেকে ৩শ’ টাকা নেমে গেছে। গত কয়েকদিন হলো বগুড়ার বিভিন্ন হাটবাজারে নতুন ধান ওঠা শুরুর পরই ধানের দাম নেমে গেছে। বগুড়ার সবচেয়ে বড় ধান কেনা-বেচার হাট নন্দীগ্রামের রণবাঘা হাটে গত রবিবার বোরো ধান কেনা-বেচা হয়েছে বি-আর ২৮ ধান ৫ থেকে সাড়ে ৫’শ টাকা মণ দরে। সেখানে মিনিকেট জাতের ধান ৬৫০ থেকে ৭০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গত বছরের চেয়ে মণপ্রতি ১০০ থেকে ১৫০ টাকা কমে ধান বিক্রি হচ্ছে। নাটোরের সিংড়া উপজেলার বনকুড়াইল গ্রামের কৃষক আবদুল মোমিন হাটে ৪৫ মণ মিনিকেট জাতের ধান এনে বসে আছেন। প্রতিমণ ধান ৭০০ টাকা দাম বলছেন পাইকারেরা। তিনি বলেন, গত বছর এই জাতের ধান ৯০০ টাকায় বিক্রি করেছেন।
নন্দীগ্রাম উপজেলার চুকাইপাড়া গ্রামের আবদুল জব্বার বলেন, প্রতি বিঘায় সেচে ১ হাজার ৫০০, সার ও কীটনাশকে ৩ হাজার, বীজ ৫০০, নিড়ানি ৫০০, কাটায় ৩ হাজার টাকাসহ সব মিলিয়ে ১৩ থেকে ১৪ হাজার টাকা খরচ হয়। বিঘায় ২০ মণ ধান হলে দেড় থেকে দুই হাজার টাকা লোকসান হবে।
বগুড়ার দুপচাঁচিয়া উপজেলা ধানের অন্যতম মোকাম। সেখানেও বি-আর ২৮ ধান বিক্রি হয়েছে ৫২০ থেকে ৫৩০ টাকা মণ। আর মিনিকেট ৭১০ থেকে ৭২০ টাকা। এবার ধানের দামে এই অবস্থা কেন জানতে চাইলে দুপচাঁচিয়ার চাল ব্যবসায়ী ফারুক আহম্মেদ চঞ্চল বলেন, গত বছরের মজুদ করা অনেক ধান ও চাল কিছু কৃষক ও অনেক ব্যবসায়ীর ঘরে পড়ে রয়েছে। এসব ধান চাল বিক্রি না হওয়ায় ব্যবসায়ীরা নতুন করে ধান চাল কিনতে চাচ্ছে না। এ জন্য ধানের দাম পড়ে গেছে।
বোরো নিয়ে বিপাকে সিলেটের কৃষক
সিলেট অফিস থেকে হুমায়ূন রশিদ চৌধূরী জানান, এবার সিলেটে বোরো ধান নিয়ে কৃষকরা বিপাকে পড়েছেন। তারা এই ধান বিক্রি করতে পারছেন না উৎপাদন খরচের তুলনায় বাজারমূল্য কম থাকায়। ধান বিক্রি করে সংসারের অন্যান্য খরচ মেটাতে হিমশিম খাচ্ছেন। বিশেষ করে বোরো প্রধান সুনামগঞ্জ অঞ্চলে এবার সরকারিভাবে ধান-চাল ক্রয়ের লক্ষ্যমাত্রা অন্যান্য বছরের তুলনায় অনেক কম। তাই কৃষকরা দুশ্চিন্তায় ভুগছেন। তারা মনে করছেন সরকারিভাবে ধান-চাল ক্রয়ের লক্ষ্যমাত্রা বৃদ্ধি করা না হলে ধানের বাজার মূল্য আশানুরূপ উঠবে না।
এদিকে সিলেটে বোরো ধানের উৎপাদন এবার অনেকটা ভালোই হয়েছে। অবশ্য ফণীর প্রভাবে সুনামগঞ্জে নদীর পানি বেড়ে গিয়ে ফসল রক্ষা বাঁধ ভেঙে ৬ টি বড় হাওরের পাকা ধান তলিয়ে যায়।
বৈশাখের শেষে পাকা ধান ঘরে তুলতে না পেরে সংশ্লিষ্ট হাওর এলাকার মানুষের কষ্টের শেষ নেই। আর যারা পানির সঙ্গে যুদ্ধ করে কিছু ধান ঘরে উঠিয়েছে তা-ও বিক্রি করতে পারছে না উপযুক্ত দাম না পাওয়ায়। এক মণ ধানের বর্তমান মূল্য ৫শ টাকা। অথচ প্রতি মণ ধানের উৎপাদন খরচই হয়েছে ৭শ টাকার বেশি।
সূত্র : ইত্তেফাক
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।