পুণ্যভূমি ফিলিস্তিন আজ রক্তাক্ত। এ ভূমির নাম উচ্চারণ করলেই আমাদের কল্পনায় ভেসে ওঠে নবী-রাসুলদের ইতিহাস, মসজিদে আকসার পবিত্রতা এবং আসমানি বার্তার মহিমা। পৃথিবীর খুব কম জায়গাই আছে, যেখানে আসমান থেকে নাজিল হওয়া এত বরকত, রহমত ও নুর একসঙ্গে মিলিত হয়েছে। মক্কা শরিফে কাবা, মদিনায় মসজিদে নববী যেমন ইসলামের কেন্দ্রবিন্দু, তেমনি ফিলিস্তিনের বুকেই দাঁড়িয়ে আছে মসজিদে আকসা, যা মুসলিম উম্মাহর এক সময়ের কেবলা, যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে নবীজি (সা.)-এর মিরাজের স্মৃতি, নবুয়তের নিদর্শন এবং আসমানি রহস্যময়তা। এই ভূমিকে কোরআনে আল্লাহ নিজেই বরকতময় ভূমি হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
ফিলিস্তিন শুধু ভৌগোলিক অবস্থানের জন্য নয়, বরং আধ্যাত্মিক মর্যাদার দিক থেকেও অনন্য। এখানকার প্রতিটি মাটি, প্রতিটি প্রান্তর যেন সাক্ষী অসংখ্য নবী-রাসুলের পদচারণার। পৃথিবীর অন্য কোনো অঞ্চল এত বিপুল সংখ্যক নবীর আগমন ও দাওয়াতের সাক্ষী হতে পারেনি।
এই কারণেই ফিলিস্তিনকে বলা হয় নবীদের ভূমি, হিজরতের ভূমি, বরকতময় ভূমি। এখানে নবুয়তের ইতিহাস যেমন লেখা হয়েছে, তেমনি রক্ত-ঘামে রচিত হয়েছে সত্য-মিথ্যার সংঘর্ষের অধ্যায়। আল্লাহর একত্ববাদ প্রচারের জন্য ইব্রাহিম (আ.) যখন নিজ মাতৃভূমি ছেড়ে এখানে এসে পাড়ি জমালেন, তখন থেকেই শুরু হলো ফিলিস্তিনের আধ্যাত্মিক যাত্রা।
এখানে সেই নবীদের উল্লেখ করা হবে, যারা ফিলিস্তিনকে ধন্য করেছিলেন তাদের পদচারণায়, যারা তাদের দাওয়াত, ত্যাগ, ধৈর্য ও সংগ্রামের মাধ্যমে এ ভূমিকে আসমানি নুরে আলোকিত করেছিলেন।
ইব্রাহিম (আ.) : ইব্রাহিম (আ.) ইরাকের বাবেল শহরে জন্মগ্রহণ করেন। আল্লাহর একত্ববাদের পয়গাম পৌঁছাতে গিয়ে অবর্ণনীয় কষ্টের সম্মুখীন হন তিনি। এক আল্লাহর ইবাদতের অপরাধে তার বাবা তাকে দেশান্তরিত করার হুমকি দেন। ইমান রক্ষায় স্ত্রী সারাকে নিয়ে প্রথমে হাররান, সেখান থেকে হালবে তারপর ফিলিস্তিনের বাইতুল মুকাদ্দাসে হিজরত করেন তিনি। ফিলিস্তিনেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। জেরুজালেমেই তাকে সমাহিত করা হয়। (আতলাসুল কোরআন ৩০, কাসাসুল কোরআন ২/১৬৪)
ইসমাইল (আ.) : বাইতুল মুকাদ্দাসে হিজরতের পর দীর্ঘ ২০ বছর নিঃসন্তান থাকেন ইব্রাহিম (আ.)। বিবি সারা (আ.) ইব্রাহিম (আ.)-কে বললেন, আল্লাহ আমাকে সন্তান দেননি। আপনি আমার দাসী হাজেরাকে বিয়ে করেন। হতে পারে আল্লাহ তার থেকে সন্তান দান করবেন। হাজেরার গর্ভে ফিলিস্তিনে ইসমাইল (আ.) জন্মগ্রহণ করেন। এরপর আল্লাহর আদেশে শিশু ইসমাইলসহ হাজেরা (আ.)-কে মক্কায় রেখে আসেন। (কাসাসুল আম্বিয়া ১/২০০)
ইসহাক (আ.) : ইব্রাহিম (আ.)-এর দ্বিতীয় ছেলে ইসহাক (আ.)। তিনি ফিলিস্তিনে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা ইব্রাহিম (আ.)-এর সঙ্গে সেখানেই বসবাস করেন। তিনি ফিলিস্তিনেই ইন্তেকাল করেন। সেখানেই কবরস্থ হন। (আতলাসুল কোরআন ৩৫)
লুত (আ.) : লুত (আ.)-এর বসবাস ছিল বৃহত্তর ফিলিস্তিনে। তিনি ইব্রাহিম (আ.)-এর প্রতি ইমান এনেছিলেন। তার সঙ্গে ফিলিস্তিনে হিজরত করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে ইব্রাহিম (আ.)-এর পরামর্শে দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালনার জন্য পার্শ্ববর্তী এলাকা সাদুম ও আমুরায় চলে যান। ঐহিতাসিকদের বর্ণনা মতে যা বর্তমান মৃত সাগর ও তার তীরবর্তী এলাকা। সেখানকার লোকেরা নিকৃষ্ট ও ঘৃণিত স্বভাবের ছিল। তারা সমকামিতায় আসক্ত ছিল। লুত (আ.) তাদের ঘৃণিত কাজ থেকে বিরত থাকতে বলেন।
কোরআনে আল্লাহ বলেন, ‘আমি লুতকে প্রেরণ করেছি। যখন সে নিজ জাতিকে বলল, তোমরা কি এমন অশ্লীল কাজ করছ, যা তোমাদের আগে সারা বিশ্বের কেউ করেনি। তোমরা তো কামবশত নারীদের ছেড়ে পুরুষদের কাছে গমন করো। তোমরা সীমালঙ্ঘন করছ। (সুরা আরাফ ৮০-৮১)
এ ঘৃণিত অপরাধের কারণে সাদুম ও আমুরাবাসীর ওপর আসমানি গজব নেমে আসে। আল্লাহর হুকুমে লুত (আ.) পার্শ¦বর্তী পাহাড়ে চলে যান। মৃত্যু পর্যন্ত সেখানে বসবাস করেন। (কাসাসুল কোরআন ২/১৫৪)
ইয়াকুব (আ.) : ইয়াকুব (আ.) হলেন ইসহাক (আ.)-এর ছেলে। ইব্রাহিম (আ.)-এর নাতি। তার জন্ম ফিলিস্তিনে। ভাই ইসুর সঙ্গে মনোমালিন্য হলে, মা রাফকার পরামর্শে তিনি দক্ষিণ ইরাকের ফাদ্দানে চলে যান। সেখানে দীর্ঘ সময় অবস্থানের পর স্ত্রী-সন্তানসহ ফিলিস্তিনে চলে আসেন। শেষ বয়সে মিসরে হিজরত করেছিলেন তিনি। সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তিনি সন্তানদের ওয়াসিয়ত করেছিলেন, মিসর ত্যাগকালে তার লাশ যেন ফিলিস্তিনে নিয়ে যাওয়া হয়। ওয়াসিয়ত অনুযায়ী তার লাশ ফিলিস্তিনে নিয়ে আসা হয়। ফিলিস্তিনের পবিত্র ভূমি বাইতুল মুকাদ্দাসে সমাহিত করা হয়। (আতলাসুল কোরআন ৩৫)
ইউসুফ (আ.) : ইয়াকুব (আ.)-এর ছেলে ইউসুফ (আ.)। দক্ষিণ ইরাকের ফাদ্দানে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। এরপরই পিতা ইয়াকুব (আ.)-এর সঙ্গে ফিলিস্তিনে চলে আসেন। শৈশবের কিছুদিন ফিলিস্তিনেই কাটে তার। ছোটবেলায় তিনি ভাইদের ষড়যন্ত্রের শিকার হন। পরে নবুয়ত লাভ করার পর মিসরের মন্ত্রী হন। নবুয়ত লাভের আগে তিনি ফিলিস্তিনিদের পক্ষে তালুতের দলে যুদ্ধে শরিক হন। অত্যাচারী বাদশাহ জালুতকে তিনি হত্যা করেন। আসদুদ, বাইতে দুজান, আবু গাওস, বাইতুল মুকাদ্দাস ও রামলার শাসক ছিলেন তিনি। ফিলিস্তিনেই ইন্তেকাল করেন। বাইতুল মুকাদ্দাস থেকে রামলাগামী পথের ডানপার্শ্বে একটি পাহাড়ে তাকে সমাহিত করা হয়। (আতলাসুল কোরআন ৬৪)
সুলাইমান (আ.) : গোটা পৃথিবী শাসনকারী শাসকদের অন্যতম সুলাইমান (আ.)। মহান আল্লাহ পশু-পাখি, বায়ুমণ্ডল ও জিন জাতিকে তার অধীন করে দিয়েছিলেন। এই নবীর জন্ম, বসবাস সবই ছিল ফিলিস্তিন-কেন্দ্রিক। তিনি ঐতিহাসিক বাইতুল মুকাদ্দাস মসজিদের নির্মাতা। খ্রিস্টপূর্ব ৯২৩ সালে ফিলিস্তিনে ইন্তেকাল করেন। বাইতুল মুকাদ্দাসে তাকে দাফন করা হয়। (আতলাসুল কোরআন ৬৮)
ইয়াহইয়া (আ.) : ইয়াহইয়া (আ.)-এর জন্ম ফিলিস্তিনে। জাকারিয়া (আ.)-এর দোয়ায় মহান আল্লাহ বৃদ্ধ বয়সে দান করেন ছেলে ইয়াহইয়া (আ.)-কে। তার মর্যাদা, তাকওয়া, জনপ্রিয়তা ও আল্লাহর দিকে আহ্বানের কারণে তিনি ইহুদিদের চক্ষুশূলে পরিণত হন। যার কারণে বাইতুল মুকাদ্দাসের ভেতরে তাকে শহীদ করা হয়। (কাসাসুল কোরআন ৭/৬২)
ঈসা (আ.) : ঈসা ইবনে মরিয়ম (আ.)-এর জন্ম ফিলিস্তিনের বাইতুল লাহামে। যিনি পিতা ব্যতীত আল্লাহর কুদরতের সাক্ষী হিসেবে দুনিয়াতে আগমন করেন। তিনি দোলনায় থাকাবস্থায় নিজের নবুয়তের ঘোষণা দেন। তিনি ফিলিস্তিন অঞ্চলে দাওয়াতি কাজ পরিচালনা করেন। মায়ের সঙ্গে মিসরেও গমন করেছিলেন তিনি। সেখান থেকে আবার ফিলিস্তিনে চলে আসেন। অভিশপ্ত ইহুদিরা তাকে জারজ সন্তান ও তার মাকে দুশ্চরিত্রা বলে অপবাদ দেয়। তিনি তাদের বিপক্ষে আল্লাহর কাছে বদ দোয়া করেন। আল্লাহর গজব নেমে আসে ইহুদিদের ওপর। তখন তারা ঈসা (আ.)-কে হত্যার পরিকল্পনা করে। মহান আল্লাহ তাকে নিজ কুদরতে জীবিত অবস্থায় আসমানে তুলে নেন। কেয়ামতের আগে তিনি বাইতুল মুকাদ্দাসে নেমে আসবেন। দাজ্জালকে হত্যা করবেন। ন্যায়-ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করবেন।
প্রায় দুই বছর যাবৎ ইসরায়েলি দখলদার বাহিনী নিরপরাধ ফিলিস্তিনিদের ওপর নির্মম গণহত্যা চালাচ্ছে। এক্ষেত্রে মুসলিম বিশ্বের যে অবস্থান গ্রহণ করার প্রয়োজন ছিল তা কেউ করতে পারেনি। তাই আজও ফিলিস্তিনি মুসলমানরা গণহত্যার শিকার হচ্ছেন। মহান আল্লাহ ফিলিস্তিনিদের মুক্তি দান করুন। আমিন।
লেখক:মাদ্রাসাশিক্ষক ও প্রবন্ধকার
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।