ফারুক তাহের, চট্টগ্রাম: কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মাণাধীন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের নির্মাণকাজ ৯০ দশমিক ৫০ শতাংশ শেষ হয়েছে। বাকি কাজ চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে সম্পন্ন হবে বলে আশাবাদী প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।
আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে টানেলটি চালুর লক্ষ্যমাত্রা সামনে রেখে কাজ করছে টানেল কর্তৃপক্ষ। এই টানেল নির্মাণকে কেন্দ্র করে কর্ণফূলীর দক্ষিণ পাড়ে গড়ে উঠছে বড় বড় শিল্প কারখানা। যা বাণিজ্য নগরী চট্টগ্রামে উন্মোচন করতে যাচ্ছে ব্যবসার নতুন দিগন্ত।
সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানিয়েছেন, চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মাণাধীন বঙ্গবন্ধু টানেলের একটি টিউব আগামী অক্টোবরে চালু করা হবে। অন্য টিউবটি চালু করা হবে নভেম্বরে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টানেলের উদ্বোধন করবেন।
৭ সেপ্টেম্বর সচিবালয়ে বাংলাদেশ সেক্রেটারিয়েট রিপোর্টার্স ফোরাম (বিএসআরএফ) আয়োজিত সংলাপে এ তথ্য জানান তিনি।
বঙ্গবন্ধু টানেলের কাজ যত এগিয়েছে ততই স্থাপিত হচ্ছে নতুন নতুন শিল্প কারখানা; আসছে নতুন বিনিয়োগও। আবার পুরনো অনেক কারখানাও সম্প্রসারিত হচ্ছে। অনেক বড় বড় শিল্প গ্রুপ ইতোমধ্যেই কারখানা গড়ে তোলার পরিকল্পনা থেকে কিনে রেখেছে আগাম জমি। সব মিলিয়ে কর্ণফুলী টানেল বন্দরনগরী চট্টগ্রামের ল্যান্ডস্কেপে আনছে বড় ধরনের পরিবর্তন। দক্ষিণ চট্টগ্রাম হয়ে উঠছে দেশের নতুন বিজনেস হাব।
চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স, বিজিএমইএ, বিকেএমইএ, বিজিএপিএমইএ এবং স্থানীয় উপজেলা প্রশাসনের সাথে কথা বলে জানা গেছে, গত চার বছরে কর্ণফূলীর দক্ষিণ পাড়ে গার্মেন্টস, জাহাজ নির্মাণ, ভোজ্যতেল, মৎস্য প্রক্রিয়াকরণ, ইস্পাত, সিমেন্টসহ অন্তত ৮০টি শিল্প কারখানা গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছেন ব্যাসায়ীরা। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান উৎপাদনও শুরু করেছে।
বঙ্গবন্ধু টানেলকে কেন্দ্র করে দেড় হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নদীর দক্ষিণ তীরে একটি ইস্পাত কারখানা ও অক্সিজেন প্লান্ট চালু করেছে দেশের অন্যতম বৃহত্তম শিল্প পরিবার মোস্তফা হাকিম গ্রুপ। এইচ এম স্টিল কারখানা ও এইচ এম অক্সিজেন প্লান্ট নামের প্রতিষ্ঠান দুটিতে বর্তমানে প্রায় দুই হাজার শ্রমিক কাজ করছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০১৫ সালের নভেম্বর থেকে ২০২০ সালের ডিসেম্বর মেয়াদের লক্ষ্য নিয়ে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) অনুমোদিত হয় কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণ প্রকল্প। ব্যয় ধরা হয় ৮ হাজার ৪৬৪ কোটি টাকা। করোনা মহামারীর কারণে প্রকল্পের নির্মাণকাজ বিঘ্নিত হওয়ার কারণে প্রকল্প প্রস্তান (ডিপিপি) সংশোধন করে মেয়াদ বাড়ানো হয় ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। বাড়ানো হয় নির্মাণ ব্যয়ও। এখন প্রকল্পটি বাস্তবায়নে খরচ হচ্ছে ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা।
সর্বশেষ অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক হারুনুর রশীদ চৌধুরী জুমবাংলাকে বলেন, ‘গত জুন পর্যন্ত প্রকল্পের কাজের সার্বিক অগ্রগতি ছিল ৮৭ শতাংশ। এখন ৯০ দশমিক ৫০ শতাংশ শেষ হয়েছে। যেসব কাজ বাকি রয়েছে, সেগুলো বেশ জটিল কাজ। এসব কাজে সময় লাগে বেশি, অগ্রগতি হয় কম। তারপরও টানেলের নির্মাণকাজ শেষ করার যে লক্ষ্য রয়েছে, সেই লক্ষ্যেই শেষ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’
তিনি আরো বলেন, ‘সাংহাই থেকে প্রকল্পে ব্যবহারের জন্য বিভিন্ন মালপত্র আনতে কিছুটা জটিলতা তৈরি হয়েছে। করোনার কারণে এ সমস্যা হলেও আমরা কিন্তু থেমে নেই। প্রথতবন্ধকতা মোকাবিলা করেই কাজ এগিয়ে নিচ্ছি।’
টানেল প্রকল্পের তথ্যানুযায়ী, ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টানেলের বোরিং কাজের উদ্বোধন করেন। ২ হাজার ৪৫০ মিটার দৈর্ঘ্যের প্রথম টানেল টিউবের রিং প্রতিস্থাপনসহ বোরিংয়ের কাজ ২০২০ সালের ২ আগস্ট শেষ হয়। এরপর ওই বছরের ১২ ডিসেম্বর ২ হাজার ৪৫৯ মিটার দৈর্ঘ্যের দ্বিতীয় টানেল টিউবের বোরিং কাজের উদ্বোধন করেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, যা ২০২১ সালের ৭ অক্টোবর শেষ হয়।
টানেলটির নির্মাণকাজ বাস্তবায়ন করছে চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না কমিউনিকেশনস কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড (সিসিসিসিএল)। ওই প্রতিষ্ঠানই টানেল রক্ষণাবেক্ষণ ও টোল আদায়ের দায়িত্ব নিয়েছে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে।
অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি দেশের জিডিপি বাড়াতেও এ টানেল ভূমিকা রাখবে উল্লেখ করে সেতু কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তারা জানান, প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে ফাইন্যান্সিয়াল ও ইকোনমিক ইন্টারনাল রেট অব রিটার্নের (আইআরআর) পরিমাণ দাঁড়াবে যথাক্রমে ৬ দশমিক ১৯ ও ১২ দশমিক ৪৯ শতাংশ। ফাইন্যান্সিয়াল ও ইকোনমিক বেনিফিট কস্ট রেশিওর (বিসিআর) পরিমাণ দাঁড়াবে যথাক্রমে ১ দশমিক শূন্য ৫ ও ১ দশমিক ৫। ফলে কর্ণফুলী টানেল দেশের জিডিপিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
নির্মাণাধীন টানেলটির দৈর্ঘ্য ৩ দশমিক ৪ কিলোমিটার। টানেলটিতে থাকছে দুটি টিউব, যেগুলো দিয়ে চলাচল করবে যানবাহন। টানেলের পাশাপাশি পাঁচ কিলোমিটারের বেশি সংযোগ সড়ক ও ৭২৭ মিটার দৈর্ঘ্যের একটি ওভারব্রিজও নির্মাণ করা হচ্ছে।
টানেলটি বাস্তবায়ন হলে চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার সঙ্গে শহরাঞ্চলের সহজ যোগাযোগ স্থাপন হবে। পাশাপাশি ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম শহরকে বাইপাস করে সরাসরি কক্সবাজারের সঙ্গে যোগাযোগও সহজ করে তুলবে কর্ণফুলী টানেল। এতে কমে আসবে চট্টগ্রাম শহরের যানজট। তাছাড়াও ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার জাতীয় মহাসড়কের যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়ন, এশিয়ান হাইওয়ে নেটওয়ার্কের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন, কর্ণফুলী নদীর দুই পাশে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং বিদ্যমান দুটি সেতুর ওপর যানবাহনের চাপ কমিয়ে আনার উদ্দেশ্যেই টানেলটি নির্মাণ করার উদ্যোগ নেওয়া হয় বলে জানান সরকারের অগ্রাধিকার ভিত্তিক এই প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।
প্রকল্প কর্মকর্তাদের মতে, চট্টগ্রাম শহরে নিরবচ্ছিন্ন ও যুগোপযোগী সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলা এবং বিদ্যমান সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার আধুনিকায়নে ভূমিকা রাখবে এ প্রকল্প। পাশাপাশি কর্ণফুলী নদীর পূর্ব তীর ঘেঁষে গড়ে ওঠা শহরের সঙ্গে ডাউন টাউনকে যুক্ত করা এবং উন্নয়নকাজ ত্বরান্বিত করবে। এছাড়া চট্টগ্রাম বন্দরের বিদ্যমান সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি এবং প্রস্তাবিত গভীর সমুদ্রবন্দরের নির্মাণকাজ ত্বরান্বিত করবে।
কর্ণফুলী টানেল নির্মিত হলে চীনের সাংহাই শহরের মতো চট্টগ্রাম শহরকে ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ মডেলে গড়ে তোলা সম্ভব হবে।
এদিকে, টানেলটির কারণে আনোয়ারায় প্রস্তাবিত শিল্প এলাকার উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে এবং পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত চট্টগ্রাম শহর, চট্টগ্রাম বন্দর ও বিমানবন্দরের সঙ্গে উন্নত ও সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপিত হবে। ফলে ভ্রমণ সময় ও খরচ কমবে এবং পূর্ব প্রান্তের শিল্প-কারখানার কাঁচামাল ও উৎপাদিত পণ্যের পরিবহন সহজ হবে।
কর্ণফুলী টানেলের নিরাপত্তার দায়িত্বে রয়েছে বাংলাদেশ নৌবাহিনী। বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের সঙ্গে করা চুক্তি অনুযায়ী, আগামী চার বছর প্রকল্প এলাকার সার্বিক নিরাপত্তা দেবেন নৌবাহিনীর সদস্যরা।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।