বদরুল হাসান লিটন : কথিত সমিতি থেকে টাকা নিয়ে বছরে ২০০ শতাংশের বেশি সুদ পরিশোধ করেও ‘ক্ষমা’ পাচ্ছেন না রাজশাহীর গনিপুর এলাকার ‘ঋণগ্রস্তরা’; বরং দিন দিন ঋণের বোঝা ভারী হচ্ছে বলে তাদের অভিযোগ।
কলেজ শিক্ষক থেকে শুরু করে বিভিন্ন শ্রেণির পেশাজীবী আছেন ঋণের এই ব্যবসায়।
পুলিশ তদন্ত করতে গিয়ে দেখে এসেছে ঋণ কারবারিদের হামলা, ভাঙচুর। ‘সুদ পরিশোধ করতে গিয়ে অন্তত ২০টি পরিবার সর্বস্বান্ত’ হয়েছেন বলে এলাকাবাসীর ভাষ্য।
জেলার বাগমারা উপজেলার গনিপুর গ্রামের কৃষক সোহরব আলী বলেন, পানের বরজ করতে ২০১৬ সালের ১৫ আগাস্ট স্থানীয়ভাবে গড়ে ওঠা ‘আশার আলো সমবায়’ নামে সমিতি থেকে এক লাখ টাকা ঋণ নেন তিনি।
“ছয় বছরে প্রায় পাঁচ লাখ টাকা সুদ ও জরিমানা নিয়েছে তারা। তারা আমার কাছে আরও পাঁচ লাখ টাকা দাবি করছে। পরিশোধের জন্য সমিতির লোকজন ভয়ভীতি দেখাচ্ছে।”
সোহরব বলেন, “এক লাখ টাকা ঋণের বিপরীতে সুদ দিয়েছি প্রতি সপ্তাহে দুই হাজার টাকা। কোনো সপ্তাহে দিতে না পারলে তার জন্য ২০০ টাকা জরিমানা দিতে হয়েছে। তার পরও তারা কেন আরও পাঁচ লাখ টাকা দাবি করছে জানি না।”
উপজেলার আক্কেলপুর গ্রামের আসমানি বেগম বলেন, স্বামীর চিকিৎসার জন্য ২০১৭ সালে আশার আলো ও পদ্মা সমবায় থেকে দুই লাখ ২২ হাজার টাকা ঋণ নেন তিনি।
“এখন আমার ঘাড়ে ঝুলছে ১২ লাখ ৮০ হাজার টাকা ঋণের বোঝা। এর মধ্যে আশার আলো সমিতির খাতায় এক লাখ ২২ হাজার টাকা ঋণের বিপরীতে পাওনা ছয় লাখ ৮০ হাজার টাকা। আর পদ্মা থেকে নেওয়া এক লাখ টাকার বিপরীতে তাদের দাবি ছয় লাখ।”
আসমানি বলেন, “প্রথম দিকে নিয়মিত সুদ দিয়েছি। তিন বছর আগে স্বামী মারা গেছে। এরপর আর নিয়মিত সুদ দিতে পারিনি। সমিতির লোকজনের অত্যাচারে পালিয়ে পালিয়ে থাকি।”
রাজশাহী শহর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার উত্তরে বাগমারা উপজেলার দক্ষিণ দৌলতপুর গ্রাম।
ওই গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে, রাস্তার পাশে লাল-কালো টিন শেডের আধা-পাকা ঘরটি আশার আলো সমবায় সমিতির কার্যালয়। সাইন বোর্ড নেই। ঘরটি সারাদিন বন্ধ থাকলেও সন্ধ্যার পর সেখানে চলে লাখ লাখ টাকার ঋণ ও সুদ লেনদেনের কারবার।
শুধু এই গ্রামেই এ ধরনের সাতটি সমিতি রয়েছে বলে এলাকাবাসীর ভাষ্য।
গ্রামের এক বৃদ্ধ বলেন, “এসব সমিতিতে কী হয় তা বললে গায়ের রোম একটিও থাকবে না। স্কুল-কলেজের শিক্ষকসহ স্থানীয় প্রভাবশালীরা এসব সমিতি চালান। তাদের বিরুদ্ধে কেউ কিছু বলতে সাহস পায় না।”
দক্ষিণ দৌলতপুর গ্রাম থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে আক্কেলপুর চৌরাস্তা মোড়। সেখানে বেশ কিছু দোকানপাট রয়েছে। সেখানে রয়েছে পদ্মা সমবায় সমিতি, বারনই ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড ও জনসমষ্টি সমিতির কার্যালয়।
এসব কার্যালয়ও দিনে বন্ধ থাকে। খোলা হয় সন্ধ্যার পর। সেখানে তিনটি কার্যালয়ে সমিতির সাইনবোর্ড থাকলেও ওই গ্রামে এ ধরনের গোটা দশেক সমিতি গড়ে উঠেছে বলে জানান স্থানীয়রা।
সেখান থেকে কাচাঁ রাস্তা ধরে প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরে গনিপুর গ্রামে রয়েছে একটি ছোট্ট বাজার। সেই বাজারের নাম সাহেববাজার। সেখানে রয়েছে তিনটি চায়ের স্টল ও একটি পল্লি চিকিৎসকের ওষুধের দোকানসহ ১৮টি দোকান। এর মধ্যে ছয়টি মুদি দোকান বন্ধ।
পল্লি চিকিৎসক রহিদুল ইসলাম বলেন, “সাহেববাজার এখন ফকির বাজারে পরিণত হয়েছে। এ বাজারের প্রায় সবাই দাদনের ঋণের জালে জড়িয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছে। আমি নিজেও ১০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলাম। ঋণমুক্ত হতে আমাকে দিতে হয়েছে ৩০ হাজার টাকা। গ্রামের লোকজন না বুঝে ঋণ নিয়ে উচ্চহারে সুদ দিতে গিয়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন।
“ঋণের সুদের টাকা দিতে এই বাজারে বন্ধ হয়ে গেছে ছয়টি দোকান।”
পল্লি চিকিৎসক আরও বলেন, সমিতির লোকজনের অত্যাচারে গনিপুর, দক্ষিণ দৌলতপুর ও আক্কেলপুর গ্রামের প্রায় ২০ থেকে ২৫ জন কৃষক ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী এলাকা ছেড়ে পালিয়ে রয়েছেন। তাদের পরিবারের সদস্যদের হুমকি-ধামকি দিচ্ছেন সমিতির লোকজন।
“আক্কেলপুর ও দক্ষিণ দৌলতপুর গ্রামেই গড়ে উঠেছে ১৭টি সমিতি। এর মধ্যে আক্কেলপুরে ১০ ও দক্ষিণ দৌলতপুরে সাতটি। এই দুই গ্রামসহ আশপাশের গ্রামের প্রায় ৬০ ভাগ মানুষ জড়িয়ে পড়েছে সমিতির ঋণের জালে।”
সমিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে সংবাদকর্মীদের ওপর রেগে যান আক্কেলপুর মোড়ে গড়ে ওঠা পদ্মা সমবায় সমিতির প্রধান আলাউদ্দিন। আক্কেলপুর গ্রামে রয়েছে তার একটি রাইস মিল।
পরে তিনি ঋণ দেওয়ার কথা অস্বীকার করেন।
আলাউদ্দিন বলেন, “আমার সমিতি অনুমোদনের জন্য আবেদন করা হয়েছে। এখনও অনুমোদন পায়নি। তাই ঋণ কার্যক্রম চালাই না। তবে কিছু লোক সমিতির সদস্য আছে। তারা কোরবানির জন্য প্রতি সপ্তাহে সঞ্চয় জমা করছে। ঈদের আগে তারা টাকা তুলে নিয়ে কোরবানির পশু কিনবে।”
দক্ষিণ দৌলতপুর গ্রামের আশার আলো সমবায় সমিতি পরিচালনা করেন পান ব্যবসায়ী আখিদুল ইসলাম। স্থানীয় বাজারে পান কিনে দূরের বাজারে পাঠান তিনি।
মোবাইল ফোনে তার সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেও তিনি সাড়া দেননি।
একই এলাকায় অর্জন সমবায় সমিতি চালান কলেজ শিক্ষক আব্দুর রাজ্জাক, আব্দুল হাকিম ও ব্যবসায়ী শহিদুল ইসলাম।
রাজ্জাক দুর্গাপুর ইজেলার হাটকানপাড়া ডিগ্রি কলেজের প্রভাষক। হাকিম বাগমারা উপজেলার মোহনগঞ্জ ডিগ্রি কলেজের প্রভাষক। শহিদুল পান চাষি এবং স্থানীয় বাজারে পান কিনে দূরের বাজারে সরবরাহ করেন।
হাকিমের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।
আব্দুল রাজ্জাক ফোন ধরলেও সাংবাদিক বলে পরিচয় দিতেই লাইন কেটে দেন। পরে একাধিকবার ফোন করা হলেও হলেও তিনি আর সাড়া দেননি।
অনুমোদনহীন এসব সমিতির কার্যক্রম বন্ধ ও তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থার দাবি জানিয়ে গত ৩১ জানুয়ারি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএএন) ও উপজেলা সমবায় সমিতি দপ্তরে অভিযোগ করেন গনিপুর গ্রামের আব্দুল মান্নান নামে এক ব্যক্তি।
অভিযোগের পর উপজেলা সমবায় কার্যালয়ের পরিদর্শক মাইনুল ইসলাম তদন্ত করে এসব সমিতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেন গত ২৩ ফেব্রুয়ারি। প্রতিবেদন দাখিল করেন। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি।
গত ২২ মার্চ আব্দুল মান্নান জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার বরাবার অভিযোগ দেন।
তদন্ত করে পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য ইউএনওকে গত ২৭ মার্চ নির্দেশ দেন জেলা প্রশাসক।
অভিযোগের প্রেক্ষাপটে গত ২ জুন রাতে বাগমারা থানার পুলিশ আক্কেলুপর গ্রামের অভিযান চালিয়ে ঋণ ও সুদ লেনদেনের সময় হাতেনাতে গ্রেপ্তার করে বারনই সমবায় সমিতির কোষাধ্যক্ষ শাহীন আলমকে।
পরে সমিতির সভাপতি রাকিব হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক জাকিরুল ইসলামসহ তিনজনের বিরুদ্ধে মামলা হয়। গনিপুর গ্রামের আশরাফুল ইসলাম এই মামলার বাদি হন। মামলায় সমিরি আরও ছয় সদস্যকেও আসামি করা হয়।
এ মামলাকে কেন্দ্র করে বাগমারা থানার ওসি মোস্তাক আহমেদের বিরুদ্ধে রাকিব হোসেন ও জাকিরুল ইসলাম গত ৯ জুন রাজশাহী পুলিশ সুপারের কাছে লিখিত অভিযোগ করেন।
তাদের অভিযোগ, ওসি অর্থের বিনিময়ে তাদের হয়রানি করছেন।
গত ১০ জুন এ অভিযোগের তদন্তে যান জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সনাতন চক্রবর্তী। তার সঙ্গে ছিলেন বাগমারা থানার এসআই মানিক মিয়া এবং এএসআই রাজু আহমেদ।
সনাতন চক্রবর্তী বলেন, “তদন্তের সময় দাদন কারবারিরা বাদি ও ঋণগ্রহীতাদের ওপর হামলা চালায়। লাঞ্ছিত করা হয় পুলিশ সদস্যদের। এতে তদন্ত কার্যক্রম পণ্ড হয়ে যায়। ফলে ১৩ জুন পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে ডেকে নিয়ে ঋণগ্রহীতাদের জবানবন্দি নেওয়া হয়।
“দাদন কারবারি ও ঋণগ্রহীতাদের মধ্যে দুটো পক্ষ হয়ে গেছে। দুই পক্ষের মধ্যে এলাকায় উত্তেজনা চলছে। তদন্ত গিয়ে দুই পক্ষের উত্তেজনার কারণে কার্যক্রম এখনও সম্পন্ন হয়নি।”
পুলিশ তদন্ত শেষে প্রয়োজনী পদক্ষেপ নেবে বলে তিনি জানান।- বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Get the latest Zoom Bangla News first — Follow us on Google News, Twitter, Facebook, Telegram and subscribe to our YouTube channel.