ড. আলা উদ্দিন : গ্রামীণ ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়ার সবচেয়ে সফল এবং কার্যকরী উদ্যোগগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো কমিউনিটি ক্লিনিক। ১৯৯৮ সালে প্রতিষ্ঠিত এই সেবামূলক প্রতিষ্ঠান দেশের দরিদ্র মানুষের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এখন পর্যন্ত ১৪,২০০টি কমিউনিটি ক্লিনিক সারাদেশে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, যা গ্রামীণ ওয়ার্ড পর্যায়ের জনগণকে নানামুখী স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করছে। ৫ কোটির বেশি গ্রামের মানুষ এই ক্লিনিক থেকে স্বাস্থ্যসেবা পেয়ে থাকে।
এই স্বাস্থ্যসেবায় ১৩,৬৬৭ জন কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার (সিএইচসিপি) নিয়োজিত রয়েছেন। এই সংখ্যাই বলে দেয় সপ্তাহে ৬ দিন স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করতে তাদের কী পরিমাণ পরিশ্রম করতে হয়। নানা অসুবিধার কারণে অনেকে চাকরি ছাড়েন, আগ্রহ পান না, আবার অনেকদিন পদ শূন্য থাকে। গবেষণার কল্যাণে বিভিন্ন সেবা ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে স্বাস্থ্যকর্মীদের বঞ্চনার কথা জানার সুযোগ হয়েছে।
গড়ে প্রতিমাসে ৫০০-১০০০ রোগী প্রতেক ক্লিনিকে স্বাস্থ্যসেবার জন্য আসে। ক্লিনিক প্রদত্ত সেবাসমূহ শুধু শারীরিক স্বাস্থ্য উন্নয়নের জন্যই নয়, বরং সামাজিক ও মানসিক স্বাস্থ্যেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে সাধারণত মা ও শিশুর স্বাস্থ্যসেবা, প্রজনন স্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা, টিকাদান কর্মসূচি, পুষ্টি এবং বিভিন্ন ধরনের পরামর্শ প্রদান করা হয়। বিশেষত, মা ও শিশুর জন্য গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্যসেবা, যেমন- প্রসবপরবর্তী যত্ন এবং টিকাদান কর্মসূচি, অত্যন্ত কার্যকরীভাবে পরিচালিত হচ্ছে।
এ ছাড়া ক্লিনিকগুলোতে বিনামূল্যে ২৭ প্রকারের ওষুধ প্রদান করা হয়, যা দরিদ্র জনগণের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ। এই স্বাস্থ্যসেবা প্রকল্পের মাধ্যমে তারা এমন সব সেবা পায়, যা তাদের জীবনের মান উন্নত করতে সাহায্য করে। বিভিন্ন দুর্যোগের সময় এ কর্মীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে সেবা পৌঁছে দেওয়ার নজির স্থাপন করে আসছে, যা তাদের সাহসিকতা এবং দায়িত্ববোধের প্রমাণ দেয়। বিশেষ করে করোনাভাইরাস মহামারির সময়ে কমিউনিটি ক্লিনিকের কর্মীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেছেন এবং জনগণের কাছে আস্থাভাজন হয়ে উঠেছেন। তবে, কর্মীদের সঠিক বেতন এবং সুযোগ-সুবিধার অভাব তাদের মনোবলকে দমিয়ে দিচ্ছে, যা এই গুরুত্বপূর্ণ সেবা প্রদানের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
কমিউনিটি ক্লিনিক বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থায় একটি বিপ্লবের সূচনা করেছে। প্রান্তিক জনগোষ্ঠী যারা আগে কোনো স্বাস্থ্যসেবা পেত না, তারা এখন এই ক্লিনিকগুলোর মাধ্যমে স্বাস্থ্য সেবা গ্রহণ করতে পারছে। গ্রামের দরিদ্র মানুষের জন্য এই ক্লিনিক একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। বিশেষ করে, নারীদের স্বাস্থ্যসেবা, শিশুদের টিকাদান কর্মসূচি, স্বাস্থ্যবিষয়ক সচেতনতা এবং প্রজনন স্বাস্থ্যসেবায় কমিউনিটি ক্লিনিকের সাফল্য অনস্বীকার্য।
এই ক্লিনিকগুলোর মাধ্যমে সহজলভ্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত হওয়ায় নারীদের মধ্যে স্বাস্থ্যের গুরুত্ব বোঝার মানসিকতা পরিবর্তিত হয়েছে। অনেক এলাকায় বাল্যবিয়ে রোধ এবং নারীদের স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধিতে এই ক্লিনিকের কর্মীদের অবদান অসাধারণ। তাদের প্রচেষ্টায় স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রেও সমাজের বিভিন্ন স্তরে ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে, যা কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে গ্রামের জনগণের জীবনমান উন্নয়নে সহায়ক হয়েছে।
কমিউনিটি ক্লিনিকের সাফল্যের মধ্যে অন্যতম হলো গ্রামীণ জনগণের মধ্যে আস্থা সৃষ্টি করা। যারা শহরের সুবিধা থেকে বঞ্চিত, তারা এই ক্লিনিকগুলো থেকে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা পেয়ে থাকেন। সাধারণ মানুষ, যারা স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত ছিল, তারা এখন সহজেই ক্লিনিকগুলোতে এসে সেবা নিতে পারছে।
বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত এই উদ্যোগ বিশেষভাবে সফল হয়েছে মা ও শিশুর স্বাস্থ্যসেবায়। কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে নারীদের সন্তান প্রসবের জন্য প্রয়োজনীয় সব উপকরণ রয়েছে এবং অনেক ক্লিনিকে নিরাপদ ডেলিভারি ব্যবস্থা কার্যকরভাবে পরিচালিত হচ্ছে। ক্লিনিকগুলোতে প্রসবপূর্ব সেবা (এএনসি) ও প্রসবপরবর্তী সেবা (পিএনসি) চালু করা হয়েছে। প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মীদের উপস্থিতিতে প্রসব হওয়ায় অনেক মা ও শিশু স্বাস্থ্যঝুঁকি থেকে রক্ষা পান।
এই ক্লিনিকগুলোতে মাতৃ ও শিশু মৃত্যুর হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে, যা প্রমাণ করে যে, সঠিক সেবা এবং সহায়তার মাধ্যমে জীবন রক্ষা সম্ভব। করোনা মহামারির সময়ে কমিউনিটি ক্লিনিকের কর্মীরা সম্মুখযোদ্ধা হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তারা করোনা টিকা প্রদানসহ জরুরি সেবা পৌঁছে দিয়েছে গ্রামবাসীর কাছে। তাদের অক্লান্ত পরিশ্রম এবং মানবিকতা গ্রামের মানুষের মধ্যে সেবা গ্রহণের অভ্যাস তৈরি করেছে এবং স্বাস্থ্যসেবায় একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে।
যদিও কমিউনিটি ক্লিনিক কার্যকরভাবে সেবা প্রদান করছে, এই ক্লিনিকের কর্মীরা দীর্ঘদিন ধরে বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন। ২০১৮ সালের আইনে কর্মীদের বেতন ও সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও তা এখনো কার্যকর হয়নি। ওই বছরের অক্টোবর মাসে পাস হওয়া কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্ট আইন অনুযায়ী কর্মীদের সরকারি চাকরির মতো সব সুবিধা পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বাস্তবতায় কর্মীরা ১৩-১৪ বছর ধরে একই বেতন পাচ্ছেন এবং অনেক সময় তাদের বেতন নিয়মিত নয়।
অথচ, এই কর্মীরা সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন। এমনকি, করোনাকালে অনেক কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার (১০৪ জন) সেবা দিতে গিয়ে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন, কিন্তু তাদের পরিবার কোনো আর্থিক সহায়তা পায়নি। বর্তমানে, কমিউনিটি হেলথ প্রোভাইডার কর্মীরা তিন মাস ধরে বেতনবঞ্চিত রয়েছেন, যা তাদের জীবনে মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে। স্বাস্থ্য উপদেষ্টা এই দুরবস্থার বিষয়টি অবগত; তিনি আশু প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
এই পরিস্থিতি শুধু তাদের আর্থিক কষ্টে ফেলে দেয়নি, বরং তাদের সামাজিক অবস্থানকেও ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। কর্মীদের ন্যায্য বেতন ও সুযোগ-সুবিধার অভাব তাদের প্রতি সমাজের আস্থা ও বিশ্বাসকে ক্ষুণœ করছে, যা দেশের স্বাস্থ্যসেবায় ভবিষ্যতের জন্য একটি গুরুতর সমস্যা।
কমিউনিটি ক্লিনিকের কর্মীদের প্রধান দাবি হলো তাদের চাকরি রাজস্ব খাতে স্থানান্তর করা। তারা বিশ্বাস করেন, রাজস্ব খাতে স্থানান্তরিত হলে ২০১৮ সালের আইন অনুযায়ী তারা সরকারি চাকরির মতো সুযোগ-সুবিধা পাবেন, যা তাদের জীবনের অনিশ্চয়তা দূর করবে। এই আইন অনুযায়ী তাদের বেতন ও সুযোগ-সুবিধা উন্নত হওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। কর্মীরা বারবার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করলেও তাদের সমস্যার সমাধানে কোনো অগ্রগতি হয়নি।
অথচ, অনেক কর্মী তাদের পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী। বেতন না পাওয়ায় তাদের পরিবারগুলো চরম অর্থনৈতিক সংকটে পড়ছে। এ অবস্থায়, তাদের সন্তানদের শিক্ষার খরচ, খাদ্য ও স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। এ ছাড়া করোনা মহামারির সময় যারা জীবনবাজি রেখে কাজ করেছেন, তাদেরও সঠিক মূল্যায়ন করা হয়নি। মৃত্যুবরণ করা কর্মীদের পরিবারকে আর্থিক সাহায্য দেওয়ার কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি, যদিও সে সময়ে তারা নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গ্রামীণ জনগণের স্বাস্থ্যসেবার জন্য অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে কর্মীদের আবেদন হলো, সরকারের উচিত দৃষ্টিভঙ্গির ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটিয়ে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা, যাতে তারা তাদের ন্যায্য অধিকার পায় এবং তাদের সামাজিক অবস্থান সুসংহত হয়।
গ্রামীণ এলাকায় দরিদ্র জনগণের জন্য স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছানোর ক্ষেত্রে কমিউনিটি ক্লিনিকের অবদান আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও পেয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছে কমিউনিটি ক্লিনিকের কার্যক্রম প্রান্তিক মানুষের স্বাস্থ্যসেবার অনন্য মডেল হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে, যা বাংলাদেশের জন্য গর্বের বিষয়। অথচ এই সেবা খাতটি নানা সমস্যায় জর্জরিত এবং কর্মীরা হতাশায় নিমজ্জিত। কমিউনিটি ক্লিনিকের কর্মীদের সঠিক মূল্যায়ন এবং তাদের ন্যায্য দাবিগুলো পূরণ করা সরকারের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
কর্মীরা যদি সঠিক বেতন ও সুবিধা না পান, তবে তাদের মনোবল কমে যাবে এবং স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থায় বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে। সরকারের উচিত দ্রুত কর্মীদের চাকরি রাজস্ব খাতে স্থানান্তর করা এবং তাদের সঠিক সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা। কমিউনিটি ক্লিনিকের সেবা আরও কার্যকর করতে এবং জনগণের মধ্যে আস্থা বজায় রাখতে কর্মীদের ন্যায্যতার ভিত্তিতে প্রাপ্য সুবিধা দিতে হবে। স্বাস্থ্যসেবা খাতের উন্নয়নের জন্য এই পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করা আবশ্যক।
কমিউনিটি ক্লিনিক বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবায় এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। গ্রামাঞ্চলের দরিদ্র মানুষের জন্য এই ক্লিনিক বিনামূল্যে মানসম্মত সেবা পৌঁছে দিচ্ছে, যা তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। মানসম্মত সেবা নিশ্চিতকল্পে কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডারদের (সিএইচসিপি) বঞ্চনা ও অনিশ্চয়তা দূর করতে সরকারের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন।
প্রতিশ্রুত রাজস্ব খাতে স্থানান্তরসহ ন্যায্য বেতন ও সুযোগ-সুবিধা প্রদান করলেই স্বাস্থকর্মীদের মনোবল বৃদ্ধি পাবে এবং স্বাস্থ্যসেবা আরও কার্যকর ও টেকসই হবে। এর মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার উন্নতি সাধিত হবে, যা প্রকারান্তরে দেশের জনগণের স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নয়নে সহায়তা করবে।
লেখক : অধ্যাপক ও সাবেক সভাপতি, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। Email: [email protected]
*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।
বৈষম্যমুক্ত সমাজ নির্মাণে একমুখী শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তন অপরিহার্য
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।