তাকী জোবায়ের: স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে শুধু কতগুলো ‘আশাবাদের’ ওপর ভিত্তি করে চারটি প্রধান লক্ষ্য সামনে রেখে সামগ্রিক উন্নয়ন অভিলাষী বাজেট দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। স্মার্ট নাগরিক, স্মার্ট সরকার, স্মার্ট সোসাইটি ও স্মার্ট ইকোনমি গড়ার লক্ষ্যকে বাজেটের চারটি স্তম্ভ বললেও শুধু খেলাপি ঋণের কারণে শেষ দুটি স্তম্ভই নড়বড়ে ও ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে।
বৃহস্পতিবার (১ জুন) জাতীয় সংসদে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব পেশ করেন করেন অর্থমন্ত্রী। যেখানে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়াবে ২ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা (অনুদান ছাড়া)। আর বাজেটে উন্নয়ন বরাদ্দ বা এডিপি রাখা হয়েছে ২ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা। ঘাটতি মেটাতে সরকার ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নিতে চাচ্ছে ১ লাখ ৩২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা।
এই যখন বাজেটের হিসাব, তখন আমাদের নজর দিতে হচ্ছে ব্যাংক খাতে। বাজেট ঘোষণার মাত্র দুইদিন আগে বাংলাদেশ ব্যাংক যে হিসাব দিল তাতে চলতি বছরের মার্চ শেষে দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ৩১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা। অবশ্য অর্থনীতি বোদ্ধারা দাবি করেন, দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ এই হিসাবের দুই থেকে তিন গুণ বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংক ইচ্ছাকৃতভাবেই খেলাপি ঋণ কম দেখানোর সুযোগ করে দিয়েছে।
আইএমএফ এক হিসাবে দেখিয়েছিল, বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি ঋণের যে তথ্য প্রকাশ করে প্রকৃত খেলাপি এর দ্বিগুণের বেশি। ইচ্ছাকৃত খেলাপি হয়ে আদালতে মামলা করে স্থগিতাদেশ নেওয়া ঋণ, স্পেশাল মেনশন লোন, পুনঃতফসিলকৃত ঋণের পরিমাণ খেলাপির খাতায় যোগ হয় না। এর বাইরে রয়েছে অবলোপনকৃত ঋণ যা বর্তমানে ৬০ হাজার কোটি টাকার বেশি।
আইএমএফ এক গবেষণায় দেখিয়েছে, দেশে মোট বিরতণকৃত ঋণের ২৫ ভাগ খেলাপি। এই হিসাবকে আমলে নিলে বর্তমানে ব্যাংক খাতে প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৩ লাখ ৭৪ হাজার কোটি টাকার বেশি। কারণ, ২০২৩ সালের মার্চ পর্যন্ত ব্যাংক খাতে ঋণ স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৪ লাখ ৯৬ হাজার ৩৪৬ কোটি টাকা।
এই হিসাব বাদ দিলেও বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপির যে পরিসংখ্যান দিয়েছে তা দিয়ে বাজেট ঘাটতির ব্যাংক ঋণের হিসাব মেটানো সম্ভব। এছাড়া উন্নয়ন বাজেটেরও অর্ধেক মেটানো সম্ভব রাজনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রতিশ্রুতিশীল হয়ে খেলাপি ঋণ আদায় করা হলে। কারণ, খেলাপি ঋণের বেশিরভাগই ইচ্ছাকৃত যা গবেষকরা বার বার জোর দিয়ে বলে আসছেন।
আর খেলাপি ঋণ ও সরকারের ব্যাংক ঋণ নিয়ে সামষ্টিক অর্থনীতি মারাত্মক ব্যাধির মধ্যে পড়েছে। এগুলো একদিকে দেশের মূল্যস্ফীতিকে উস্কে দিচ্ছে। অন্যদিকে চরম তারল্য সংকট সৃষ্টি করে দেশের বেসরকারি বিনিয়োগের জন্য প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। সার্বিকভাবে বাজেটের লক্ষ্য পুরণকেই অসম্ভব করে তুলছে।
সরকার ব্যাংকঋণের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে তাতে মূল্যস্ফীতি ধরে রাখা সম্ভব হবে না উল্লেখ করে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ মুঠোফোনে জুমবাংলাকে বলেছেন, বিভিন্ন কারণেই বাজারে ইতোমধ্যে টাকার সরবরাহ বেশি। চলতি অর্থবছরেও সরকার ব্যাংক ঋণের যে লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছিল তার চেয়ে বেশি ঋণ নিচ্ছে। আগামী অর্থবছরে আরও বাড়ানোর ঘোষণা এসেছে। কিন্তু ব্যাংকঋণ অর্থনীতির জন্য ভালো নয়। কারণ বেশি ব্যাংকঋণ নিলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বেশি টাকা ছাপায়। বেশি টাকা ছাপানো হলে স্বাভাবিকভাবেই মূল্যস্ফীতি উষ্কে যায়।
এছাড়া সরকার বেশি ব্যাংকঋণ নিলে বেসরকারি খাতের ঋণ পাওয়ার সুযোগ সংকুচিত হয়ে যায়। এতে বেসরকারি কর্মসংস্থা বাধাগ্রস্ত হয়।
দেশের বর্তমান মূল্যস্ফীতি ডাবল ডিজিট ছুই ছুই। এর একটি বড় কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হচ্ছে ব্যাংকের পরিবর্তে বাজারে বেশি টাকা থাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাদাগ হিসাব বলছে, চলতি অর্থবছরে মানুষের হাতে নগদ টাকা রাখার প্রবণতা ছয়গুণ বেড়েছে। এর ওপর ঋণগ্রহীতাদের একটি বড় অংশই ঋণের অর্থ ফেরত দিচ্ছে না যা বাজারেই ঘোরেফেরা করছে। এর ওপর সরকার ব্যাংক থেকে আরও বিপুল অংকের ঋণ নিলে সেটা মূল্যস্ফীতিকে আরও মারাত্মকভাবে উষ্কে দেবে। যে কারণে সরকারের দুটি বড় লক্ষ্যই বাস্তবায়ন অসাধ্য হয়ে দাঁড়াবে।
প্রস্তাবিত বাজেটে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হয়েছে। আর ৬ শতাংশের মধ্যে মূল্যস্ফীতি বেধে রাখার প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়েছে। কোনও কারণে বৈশ্বিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে মূল্যস্ফীতি সিঙ্গেল ডিজিটে বেধে রাখাই কষ্টকর হয়ে যাবে। আর জিডিপি প্রবৃদ্ধি যেহেতু মূল্যস্ফীতি বাদ দিয়েই হিসাব করা হয়, তাই কাঙিক্ষত প্রবৃদ্ধিও অর্জন সম্ভব হবে না বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
বাজেটের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক এসব বিষয় নিয়ে মুঠোফোনে আলাপকালে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম জুমবাংলা’কে বলেন, আমার ধারনা কিছু বিষয়ে অনুমানের ওপর ভিত্তি করে বাজেটে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রাগুলো নির্ধারণ করা হয়েছে। হয়তো ধরে নেয়া হয়েছে আগামী অর্থবছরে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে। আন্তর্জাতিক বাজার স্থিতিশীল হবে। জ্বালানি তেলের বাজারে স্থিতিশীলতা ফিরবে। এসব অনুমানে নিয়েই হয়তো প্রবৃদ্ধির হিসাব করা হয়েছে। এই বিষয়গুলোর নেতিবাচকতা ধরে নিলে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা আরও কমানো হতো।
বিপুল খেলাপি ঋণ ও খেলাপি সংস্কৃতি অর্থমন্ত্রীর প্রত্যাশিত স্মার্ট সোসাইটি ও স্মার্ট ইকোনমি গড়ার প্রত্যয়কে বাধাগ্রস্ত করবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। কারণ ইচ্ছাকৃত খেলাপিরা সমাজে অসাম্য পরিস্থিতি তৈরি করছে। এর ভুক্তভোগী হতে হচ্ছে ভাল ঋণগ্রহীতা ও সাধারণ মানুষকে। অন্যদিকে অর্থনীতিকে মারাত্মকভাবে সমস্যাসংকুল করে তুলেছে। খেলাপি ঋণ আদায় না করে উল্টো ব্যাংকের ব্যয় সামনালোর অজুহাতে ছয়-নয় সুদহার তুলে দেয়ার চাপের কাছে নতি স্বীকার করে আগামি মুদ্রানীতিতে সুদহার বাজারভিত্তিক করা হচ্ছে।
আর এই সকল সংকটের দায়ভার বর্তায় তদারকি প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের ওপর এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ আর্থিক খাতের রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান হিসেবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ওপর। যে কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান হিসেবে যেমন গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের নৈতিক দায় রয়েছে, একইভাবে অর্থমন্ত্রী হিসেবে সার্বিক দায় রয়েছে আ হ ম মুস্তফা কামালের ওপর।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেয়ার পর ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে মুস্তফা কামাল ঘোষণা দিয়েছিলেন, ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ আর একটি টাকাও বাড়বে না। ওই সময় ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৯৩ হাজার ৯১১ কোটি টাকা। এই ঘোষণার পর খেলাপি বেড়েছে ৩৭ হাজার ৭০৯ কোটি টাকা। তাই আর্থিক খাতে নজর না দিয়ে স্মার্ট ইকোনমি গড়াকে দুঃসাধ্য বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন জুমবাংলা’কে বলেন, স্মার্ট ইকোনমি গড়তে হলে অবশ্যই ব্যাংক কিংবা যে কোনও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণসহ যে কোনও দুবৃত্তায়নের বিষয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোকে কঠোর হতে হবে। এক্ষেত্রে কোনও ধরনের আপস করা যাবে না।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।