ফারুক তাহের, চট্টগ্রাম: বন্ড সুবিধায় আনা পণ্যের অপব্যবহার, খোলা বাজারে বিক্রি ও পাচার কোনোটাই থামছে না। এই অপব্যবহার রোধে সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করলেও ফলপ্রসু কিছু হচ্ছে না। ফলে প্রকৃত ব্যবসায়ীরা আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন।
তৈরি পোশাকশিল্পের কাঁচামাল মিথ্যে ঘোষণায় অতিরিক্ত আমদানি এবং ঘোষণাকৃত পণ্যের অনুপাতে উৎপাদিত পণ্য রপ্তানি না করে খোলা বাজারে বিক্রির ফলে বন্ড সুবিধার অপব্যবহার বেশি হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এর বাইরে পেপার, প্যাকেজিং, এগ্রোপ্রসেসিং, কেমিক্যাল এসব ক্ষেত্রেও এই অপব্যবহার অহরহ হচ্ছে বলে জানা গেছে।
চলতি বছরের ৪ জানুয়ারি এবং ২২ ফেব্রুয়ারিতেও চট্টগ্রামে বন্ড সুবিধায় আনা দুটি বড় চালান আটক করেছে শুল্ক গোয়েন্দা সংস্থা। এর একটিতে প্রায় সাড়ে ১১ কোটি টাকার আমদানি শুল্ক ফাঁকি দেওয়া হয় বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।
চলতি বছরের মে মাসে বন্ড সুবিধার অপব্যবহার, দীর্ঘদিন নিরীক্ষা সম্পাদন না করা ও সরকারি পাওনা পরিশোধে ব্যর্থতাসহ বিভিন্ন অভিযোগের ফলে দেশের ৮৭টি প্রতিষ্ঠানের বন্ড লাইসেন্স স্থগিত করেছে চট্টগ্রাম কাস্টম বন্ড কমিশনারেট।
এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অন্যান্য অভিযোগের মধ্যে- রপ্তানিতে ব্যর্থ হওয়ায় দাবিকৃত অর্থ পরিশোধ না করা, বন্ড সুবিধায় আমদানিকৃত কাঁচামাল দিয়ে পণ্য তৈরি করে রপ্তানিতে ব্যর্থ হওয়া, বার্ষিক নিরীক্ষা কাজে অসহযোগিতা, বন্ডিং মেয়াদ উত্তীর্ণ পণ্যের ওপর প্রযোজ্য শুল্ককর পরিশোধ না করা, সরেজমিন পরিদর্শনে প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব খুঁজে না পাওয়া, চাহিত দলিলাদি দাখিল না করা, বন্ড সুবিধার অপব্যবহার করা, বন্ডের মাধ্যমে আমদানিকৃত কাঁচামাল অবৈধ অপসারণ ও ২০১৪ সাল থেকে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম বন্ধ থাকায় এ পদক্ষেপ নিয়েছে কমিশনারেট।
এর মধ্যে বন্ডিং মেয়াদ উত্তীর্ণ পণ্যের ওপর প্রযোজ্য শুল্ককর পরিশোধ না করায় আম্বিয়া নিটিং, হিরা ভ্যাকুয়াম ইভা করপোরেশন সল্ট ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের লাইসেন্স স্থগিত করা হয়েছে। দাবিনামাভুক্ত রাজস্ব পরিশোধ না করায় ওমর সুলতান ডায়িং, চিটাগাং প্লাস্টিক, ইডেন ফ্যাশন লিমিটেডের লাইসেন্স স্থগিত করা হয়েছে।
বার্ষিক নিরীক্ষা কাজে অসহযোগিতা, দীর্ঘদিন নিরীক্ষা সম্পাদন না করা, নিরীক্ষা অনিস্পন্ন, নিরীক্ষায় অসহযোগিতায় অসম্পূর্ণ, হালনাগাদ নিরীক্ষা না থাকা ও সিস্টেম অডিট সম্পন্ন করায় ওজিকো এপারেল, রিদওয়ান ফ্যাশন, গ্রীন এন্ড হোয়াইট লিমিটেড, জেসএল এপারেল, আলিফ নিট ফ্যাশন, মোমেন এপারেল, প্রিমিয়ার ফ্যাশন ওয়্যার, লেমন্ড এপারেল, ফিতওয়াল সোয়েটার, বিটমন্ড এপারেল, সাদাফ ফ্যাশন, আরজেন্টা গার্মেন্টস, মদিনা এস্টাবলিশমেন্ট, সিলেকশন ফ্যাশন ওয়্যার, ইমতি পলি প্যাকেজিং, সৈয়দ নিটওয়ারস, কেনস বিডি লিমিটেড, কেন্ট ফ্যাশন, শ্যারন চৌ লিমিটেড, জিন্স গার্মেন্টস, ম্যাক্স ব্রাইট লিমিটেড, আইএফসিও গার্মেন্টস, আমিরজা এপ লিমিটেড, সিএন্ডএ টেক্সটাইল, একেবি এক্সেসরিজ, নিটেক্স এপারেল, ফ্যাশন নেক্সট, জবা গার্মেন্টস, এম এস চিটাগাং ফ্যাশনস, প্রমিলা অ্যাপেরেল লিমিটেড, বন্দর নিটিং, এ এন সোয়েটার ক্রাউন অ্যারো লিমিটেড ও ইনজিনাস নিটিংওয়্যারের লাইসেন্স স্থগিত হয়েছে।
অন্যদিকে সরকারি পাওনা পরিশোধ না করা, অডিট কার্যক্রম সম্পন্ন না করায় হারভিস কনভার্টিং লিমিটেড, কে ওয়াই স্টিল মিলস লিমিটিড, হংকং ডেনিম লিমিটিড, পিআরএম ফ্যাশল লিমিটিড, ভেলটেক্স ইন্টারন্যাশনাল, জিনিয়ান কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি, তাকওয়া ফ্যাশন প্রাইভেট লিমিটেডের লাইসেন্স স্থগিত করা হয়েছে।
আবেদনের প্রেক্ষিতে ইফা এপারেল, আনজা টেক্সটাইল লিমিটেড, দীর্ঘদিন আমদানি-রপ্তানি বন্ধ থাকায় নূর আলম ফুটওয়্যার, পলিজোন, নুরানী ডায়িং, ইছাকপুর, টিএইচ পেপার অ্যান্ড প্যাকেজিংয়ের লাইসেন্স স্থগিত করা হয়েছে।
মেয়াদ উত্তীর্ণ পণ্যের ওপর প্রযোজ্য শুল্কাদি পরিশোধ না করায় সুগার পলি লিমিটেড, মাসকান জিন্স ও প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব খুঁজে না পাওয়ায় প্রোগ্রেসিভ থ্রেডের লাইসেন্স স্থগিত করা হয়েছে। এছাড়া অডিট সম্পন্নের জটিলতায় রুবী কার্টন লিমিটেড, লাক্স লিংজরী, জিন্স এক্সপ্রেস লিমিটেড, ওয়েস্টার ফ্যাশন লিমিটেড, সিএন্ড এ ফ্যাশন লিমিটেডের বন্ড লাইসেন্স স্থগিত করা হয়েছে।
এনবিআর সূত্র জানায়, বন্ড সুবিধার আওতায় শুল্কমুক্ত সুবিধায় শুল্কমুক্ত কাঁচামাল আমাদনি করে বন্ডেড ওয়্যারহাউসে রাখার সুবিধাও দেওয়া হয়। তবে বন্ডের অপব্যবহার দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বন্ডের অপব্যবহারের ফলে আমদানিকৃত কাপড় ও সুতা তুলনামূলকভাবে সস্তায় পাওয়া যায়। সেজন্য দেশে তৈরি কাপড়ের মিল ও স্পিনিং মিলের তৈরি সামগ্রী বিক্রি হচ্ছে না বা প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারছে না।
কাস্টম বন্ড কমিশনারেট চট্টগ্রামের কমিশনার এ কে এম মাহবুবুর রহমান জুমবাংলাকে বলেন, ‘মূলতঃ দেশের রপ্তানি বাড়ানোর জন্য এ সুবিধা দেওয়া হলেও এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী ও সিএন্ডএফ এজেন্টের যোগসাজসে সরকার কোটি কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে। ঢাকা উত্তর বন্ড কমিশনারেট, ঢাকা দক্ষিণ বন্ড কমিশনারেট ও চট্টগ্রাম বন্ড কমিশনারেটকে এ বিষয়ে কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কোনো ধরনের অনিয়ম পেলে বন্ড লাইসেন্স বাতিল করে দেওয়ার আদেশ দেওয়া হয়েছে। তাই আমরা এখন কঠোরভাবে তা দমনের ব্যবস্থা নিয়েছি।’
তিনি বলেন, ‘বন্ড ম্যানেজমেন্ট অটোমেশন প্রকল্পটি চালু হলে সারাদেশের প্রায় ৬ হাজার বন্ড লাইসেন্স ব্যবহারকারি একটি নজরদারিতে চলে আসবে। এতে তাদের অপব্যবহার ও অন্যান্য অনিয়ম রোধ করা যাবে।’
মূলতঃ গত শতাব্দীর আশির দশকে বাংলাদেশ ব্যাংক ও এনবিআরের যৌথ কার্যক্রম ও পদক্ষেপ অর্থাৎ সরকারের নীতি সহায়তার কারণে পোশাক খাত বর্তমান অবস্থানে আসতে পেরেছে। যে দুটি সরকারি নীতি সহায়তা তৈরি পোশাক খাতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে সেগুলো হচ্ছে-শুল্কমুক্ত কাঁচামাল আমদানি করে বন্ডেড ওয়্যারহাউজে রাখার সুবিধা এবং বিলম্বে দায় পরিশোধসহ ব্যাক-টু-ব্যাক এলসি সুবিধা।
এ দুটি সুবিধা প্রাপ্তির কারণে বড় অঙ্কের পুঁজি ছাড়াই গার্মেন্ট কারখানা প্রতিষ্ঠা করে উৎপাদনে যাওয়া সম্ভব হয়েছে, ফলে বিপুলসংখ্যক শিক্ষিত উদ্যোক্তা সৃষ্টি হয়েছে, যারা রপ্তানি বাজার খোঁজার ক্ষেত্রেও পারদর্শিতা দেখিয়েছে। এ শিল্প উদ্যোক্তাদের করহারও তুলনামূলকভাবে অন্যান্য শিল্পের চেয়ে কম। যেখানে ন্যূনতম কর্পোরেট করহার ৩০ শতাংশ, সেখানে এ শিল্পের করহার ১০-১২ শতাংশ। এ শিল্পে রয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে নগদ সহায়তা এবং ব্যাংক কর্তৃক স্বল্প সুদে ঋণ সহায়তা। বন্দর ব্যবহারের ক্ষেত্রেও রয়েছে অগ্রাধিকার।
এতসব নীতি-সহায়তা ভোগ করা সত্ত্বেও একশ্রেণির গার্মেন্ট উদ্যোক্তা বন্ড সুবিধার অপব্যবহার করে আসছে। তারা বিনা শুল্কে বিদেশ থেকে কাপড় এনে খোলাবাজারে বিক্রি করে দিচ্ছে।
‘বন্ড ম্যানেজমেন্ট অটোমেশন’ প্রকল্পের সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রকল্পের মেয়াদ গত জুনের ৩০ তারিখ শেষ হয়েছে। ইতোমধ্যে মেয়াদ বাড়ানোর জন্য এনবিআরের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে (আইআরডি) প্রস্তাবনা দেয়া হয়েছে। তবে এখনো অনুমোদন পাওয়া যায়নি। তবে সফটওয়্যারের কাজ চলমান রয়েছে। এ বছরের শেষের দিকে পুরোপুরি অটোমেশন চালু হবে আশা করা যাচ্ছে।
জানা গেছে, বর্তমানে সারাদেশে সাড়ে ৬ হাজারের কাছাকাছি বন্ড লাইসেন্স প্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এই বিশাল সংখ্যক প্রতিষ্ঠানকে অটোমেশনের আওতায় আনা সম্ভব হলে বন্ড সুবিধায় আমদানিকৃত পণ্য খোলা বাজারে বিক্রি ঠেকানো যাবে। এছাড়া পুরোপুরি অটোমেশন চালু হলে বন্ড কাস্টমসের কর্মকর্তারা বন্ডের রেজিস্টার মডিউলে কোন প্রতিষ্ঠানের গুদামে কি পরিমাণ পণ্য আছে সেটি দেখতে পারবেন। এছাড়া কি পরিমাণ পণ্য রপ্তানি হয়েছে, সেটিও যাচাই করতে পারবেন।
চট্টগ্রাম কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের কর্মকর্তারা বলছেন, বন্ড ব্যবস্থাপনায় অটোমেশন চালু হয়ে গেলে কাজের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বৃদ্ধি পাবে। প্রায় সময় বিভিন্ন বন্ডেড প্রতিষ্ঠানের গুদাম পরিদর্শন করে অনিয়ম চিত্র দেখা যায়। দেখা যায়, বন্ড সুবিধায় আমদানি করা পণ্য গুদামে পাওয়া যায় না। প্রায় সময় প্রতিষ্ঠান মালিক পণ্য অন্যত্র সরিয়ে নেন কিংবা খোলা বাজারে বিক্রি করে দেন। ফলে সরকারও প্রচুর রাজস্ব হারায়। এছাড়া কাস্টমস বন্ড অফিসেও জনবলের সংকট রয়েছে। তাই নিয়ম করে সকল প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করা সম্ভব হয় না। এক্ষেত্রে বন্ড ব্যবস্থাপনা পুরোপুরি অটোমেশন করা গেলে কম্পিউটারে বসেই কোন প্রতিষ্ঠান বন্ড সুবিধায় কি পরিমাণ পণ্য আমদানি করেছে, মজুদ কত এবং তা রপ্তানি করেছে তা সহজেই নজরদারি করা সম্ভব হবে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।