জুমবাংলা ডেস্ক : মজুরি বাড়ানোর দাবিতে চলমান শ্রমিক বিক্ষোভে শুধু গাজীপুরেই ১২৩ কারখানা ভাঙচুর করা হয়েছে। এসব ঘটনায় মামলা হয়েছে ২২টি। গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৮৮ জনকে। পুলিশ জানায়, গতকাল শনিবার পর্যন্ত আশুলিয়া, গাজীপুর ও উত্তরায় ১৩৭ পোশাক কারখানায় ‘বন্ধের’ নোটিশ দেওয়া হয়েছে।
গতকাল মিরপুরে রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করেছে শ্রমিকরা। দুপুর ২টা থেকে বিকেল সাড়ে ৩টা পর্যন্ত মিরপুর-১৩ ও ১৪ নম্বর এলাকায় শ্রমিকরা সড়কের দু’পাশেই অবরোধ করে। এ সময় আশপাশের বিভিন্ন পোশাক কারখানায় ইটপাটকেল নিক্ষেপ করা হয়। পরে পুলিশ এসে পরিস্থিতি শান্ত করে তাদের সড়ক থেকে সরিয়ে দেয়। নতুন মজুরি কাঠামো ঘোষণার পরও শ্রমিক বিক্ষোভ চলমান থাকায় সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আজ সংবাদ সম্মেলন করবে বিজিএমইএ।
গত মঙ্গলবার সরকারের মজুরি বোর্ড মালিকপক্ষের প্রস্তাবের সঙ্গে সংগতি রেখে ন্যূনতম মজুরি সাড়ে ১২ হাজার টাকা নির্ধারণ করে দেয়। তবে এ সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করে কয়েকটি শ্রমিক সংগঠন। মজুরি আরও বাড়ানোর দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত রেখেছে কিছু কারখানার শ্রমিকরা।
সার্বিক পরিস্থিতির বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সহসভাপতি শহীদ উল্লাহ আজিম বলেন, শ্রম আইনের ১৩ (১) ধারায় বলা আছে, ‘নো ওয়ার্ক নো পে’। এর অর্থ হলো, কাজ নেই তো মজুরি নেই। এই ধারার ভিত্তিতে ১৩০টি কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেন মালিকরা। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত সেগুলো বন্ধ থাকবে। পোশাক খাতে উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে ১ নভেম্বর বিজিএমইএর বৈঠকে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য মালিকদের পরামর্শ দেওয়া হয়। এর ভিত্তিতেই মালিকরা পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। কারখানা ভাঙচুর করলে কিংবা বেআইনি ধর্মঘট করলে যতদিন কারখানা বন্ধ থাকবে, ততদিন মজুরি পাবেন না শ্রমিকরা– আইনের ধারায় সে কথা বলা আছে।
এদিকে শিল্প পুলিশের কর্মকর্তারা গতকাল গাজীপুর শিল্পাঞ্চল এলাকা পরিদর্শন করেছেন। কোনাবাড়ীর তুসুকা গার্মেন্টের সামনে সংবাদ সম্মেলনে শিল্প পুলিশের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) জাকির হোসেন খান বলেছেন, শ্রমিকদের যারা উস্কে দিচ্ছে তাদের খুঁজে বের করার চেষ্টা চলছে। শুরু থেকে একটি পক্ষ আন্দোলনে ইন্ধন দিচ্ছে। তাদেরও আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। সাধারণ শ্রমিকদের আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। শুধু যারা দোষী, তাদেরই গ্রেপ্তার করা হবে। এ ছাড়া শ্রমিকদের সঙ্গে বহিরাগত কিছু লোক আছে, তাদেরও গ্রেপ্তার করা হবে।
নিহত তিন শ্রমিকের পরিবারকে আর্থিক সহায়তা প্রদান অনুষ্ঠানে গতকাল বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান বলেছেন, তৈরি পোশাক শিল্পের সাফল্যের পেছনে প্রত্যেক শ্রমিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। শিল্পকে আজকের সম্মানজনক অবস্থানে নিয়ে আসার পেছনে লাখো শ্রমিকের অপরিসীম অবদান অস্বীকার করা যাবে না। শ্রমিকদের অধিকার ও স্বার্থ সমুন্নত রাখতে আমাদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। শিল্প ভালো থাকলে শ্রমিক ভালো থাকবে। শ্রমিক ও উদ্যোক্তা একসঙ্গে মিলে শিল্পকে এগিয়ে নিতে হবে। বিজিএমইএর সহসভাপতি শহীদ উল্লাহ আজিম, সহসভাপতি মোঃ নাসির উদ্দিন, পরিচালক ইনামুল হক খান (বাবলু) ও পরিচালক হারুন অর রশীদ এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
পোশাক খাতে শ্রম পরিস্থিতির ওপর নজর রাখছেন ব্র্যান্ড ক্রেতারা। সময়মতো পণ্য হাতে পাওয়া নিয়ে তাদেরও উদ্বেগ আছে। এ পরিস্থিতিতে আজ রাজধানীর উত্তরায় বিজিএমইএ ভবনে সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেবেন সংগঠনের সভাপতি।
গতকাল সকালে অনেক শ্রমিক কারখানায় গিয়ে বন্ধের নোটিশ দেখে বাসায় ফিরে গেছেন। শিল্পাঞ্চলের কাঠগড়া জিরাব, জামগড়া, নরসিংহপুরসহ কয়েকটি এলাকায় কারখানার প্রধান ফটকে বন্ধের নোটিশ ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। বিভিন্ন এলাকায় কারখানার সামনে অনেক শ্রমিককে দাঁড়িয়ে নোটিশ পড়তে দেখা যায়। তবে তারা বিক্ষোভ করেননি। কয়েকটি স্থানে শ্রমিকরা জড়ো হওয়ার চেষ্টা করলেও পুলিশ তাদের বুঝিয়ে বাসায় পাঠিয়ে দেয়।
সকাল ৮টার দিকে আশুলিয়ার জামগড়া, ছয়তলা, বেরন ও নরসিংহপুর এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, কারখানাগুলোর সামনে অনির্দিষ্টকালের বন্ধের নোটিশ টানানো হয়েছে। কয়েক দিন ধরে পোশাক খাতে চলমান শ্রমিক অসন্তোষ নিরসনে মজুরি বাড়ানোসহ নানা উদ্যোগ নিয়েছিল মালিকপক্ষ। কিন্তু শ্রমিকরা কারখানায় ঢুকে হাজিরা দিয়ে কর্মবিরতি চালিয়ে আসছিল।
জানা যায়, জামগড়া এলাকার দি রোজ ড্রেসেস লিমিটেড, পাইওনিয়ার ক্যাজুয়াল ওয়্যার লিমিটেড, বেরন এলাকার এনভয় গ্রুপের মানটা অ্যাপারেলস লিমিটেড, স্টারলিংক অ্যাপারেলস লিমিটেড, হলিউড গার্মেন্ট লিমিটেড, বড় রাঙ্গামাটিয়া এলাকার টেপটাউন লিমিটেড ও অরনেট নিট গার্মেন্ট ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, কাঠগড়া এলাকার এআর জিন্স ও অ্যাপারেলস লিমিটেডসহ অধিকাংশ কারখানায় বন্ধের নোটিশ টানিয়েছে কারখানা কর্তৃপক্ষ। নোটিশে বলা হয়, ৯ নভেম্বর সকাল ১০টায় এবং বিগত কয়েক দিন ধরে সকাল ১০টা ও বিকেল ৩টার সময় মজুরি বাড়ানোর দাবিতে বহিরাগত পোশাক শ্রমিকরা বেআইনিভাবে কারখানার ভেতর ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে ভাঙচুর, কাজ বন্ধ রাখাসহ কর্মস্থলে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি করায় উৎপাদন কাজ ব্যাপকভাবে ব্যাহত হয়। এ অবস্থায় বাধ্য হয়ে ১০ নভেম্বর থেকে শ্রম আইন, ২০০৬-এর ১৩ (১) ধারা মোতাবেক কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হলো।
এনভয় পোশাক কারখানার শ্রমিক হিমেল আহম্মেদ বলেন, বৃহস্পতিবার কারখানায় এসে কাজ যোগ দেওয়ার পরপরই ছুটি দেওয়া হয়। এর পর শ্রমিকরা সবাই বাসায় ফিরে যান। শুক্রবার সাপ্তাহিক বন্ধ ছিল। শনিবার সকালে কারখানায় এসে অনির্দিষ্টকালের ছুটির নোটিশ দেখতে পেয়েছেন।
নাসা গ্রুপের পোশাক কারখানার শ্রমিক বিউটি আক্তার জানান, ‘আমরা চাই গার্মেন্ট খুলে দিক। টাকা-পয়সার সিদ্ধান্ত না নিয়ে হুট করে অনির্দিষ্টকালের জন্য ফ্যাক্টরি বন্ধ করে দিচ্ছে। এতে আমাদের সবারই ক্ষতি হচ্ছে। সরকার সুষ্ঠু সমাধান করে দিক, মীমাংসা করে দিক। হেলপারদের বেতনের যে সিদ্ধান্ত দিয়েছে, তা তো আমরা মেনে নিয়েছি। কিন্তু আয়রনম্যান, অপারেটর, কোয়ালিটি কন্ট্রোলারদের কারও কথা বলে নাই। এ জন্যই তো সমস্যা।’
আশুলিয়া শিল্প পুলিশ-১-এর পুলিশ সুপার মোহাম্মদ সারোয়ার আলম বলেন, আশুলিয়া ও ধামরাইয়ে তাদের আওতাধীন ১ হাজার ৭৯২টি কারখানা আছে। এর মধ্যে ১৩০টি কারখানা গতকাল থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। তবে এ সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। বেশ কিছু কারখানা ছুটিও দেওয়া হয়েছে। সকালে কিছু শ্রমিক জড়ো হওয়ার পাশাপাশি সড়কে অবস্থান নেওয়ার চেষ্টা করলেও পারেনি। নাশকতা ঠেকাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পর্যাপ্ত সংখ্যক সদস্য শিল্পাঞ্চলে মোতায়েন রয়েছেন।
গাজীপুর শিল্প পুলিশের পরিদর্শক মোঃ রেজাউল বলেন, গাজীপুরে ২ হাজার ২৩১টি পোশাক কারখানা আছে। এর মধ্যে ১৪টি কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেছে কর্তৃপক্ষ। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তারা হয়তো কারখানা চালু করবে।
গত বৃহস্পতিবারের তাণ্ডবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কোনাবাড়ীর তুসুকা কারখানা। কারখানাটির সামনে অনির্দিষ্টকালের বন্ধের বিজ্ঞপ্তি টানানো হয়েছে। এতে বলা হয়, ‘তুসুকা জিনস লি., তুসুকা ট্রাউজার্স লি., তুসুকা প্রসেসিং লি., তুসুকা প্যাকেজিং লি. ও নিডেল আর্ট এমব্রয়ডারি লিমিটেডের কর্মকর্তা, কর্মচারী ও শ্রমিকদের জানানো যাচ্ছে যে অজ্ঞাতনামা কিছু উচ্ছৃঙ্খল শ্রমিক অযৌক্তিক দাবিতে বেআইনিভাবে কর্মবিরতি পালন করে কর্মকর্তাদের মারধর করে। কারখানার ভেতরে ব্যাপক ভাঙচুর ও ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। এমতাবস্থায় কারখানা ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয়ে কর্মকর্তা, কর্মচারী ও শ্রমিকদের নিরাপত্তা এবং কারখানার সম্পত্তি রক্ষার স্বার্থে সব কার্যক্রম অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’
তুসুকা কারখানার পরিচালক মোঃ তারেক বলেন, ‘কারখানায় ভাঙচুর করে প্রায় সাড়ে ৫ কোটি টাকার ক্ষতি করা হয়েছে। এসব কাজে আমাদের শ্রমিকরা জড়িত ছিল না। অনেক বহিরাগত ছিল। সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে জড়িতদের চিহ্নিত করার চেষ্টা করছে প্রশাসন।’
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।