হেদায়েত উল্লাহ সৌখিন ও রঞ্জু খন্দকার, গাইবান্ধা থেকে : গাইবান্ধার একমাত্র ভারী শিল্প ‘রংপুর চিনিকল’ খোলার আশ্বাস যেন শুধুই মরীচিকা। ২০২০ সালে এটি বন্ধ হয়ে যায়। এরপর আধুনিকায়ন করে এটি খোলার আশ্বাস দেওয়া হলেও তা আজও কার্যকর হয়নি।
চিনিকল সূত্রে জানা যায়, ২০১৯-২০২০ মৌসুমে চিনিকলটির আখ মাড়াইয়ের হার ছিল ৬৬ দশমিক ৬৫ শতাংশ। চিনি আহরণের হার ছিল ৬৮.৭১ ভাগ। ২০২০-২১ মৌসুমেও কলটির মাড়াই ক্ষমতা ছিল সর্বোচ্চ। তবু মাড়াই কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয় কলটির।
কলের কর্মচারী ও স্থানীয় লোকজন জানান, ২০২০ সালে এটিসহ দেশের ৬টি চিনিকল বন্ধ করে দেওয়া হয়। এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে শ্রমিক-কর্মচারী, আখচাষী ও স্থানীয় লোকজন ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলে। এর পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প সংস্থার পক্ষ হতে জানানো হয়, আধুনিকায়ন করে ৬টি কলই চালু করা হবে। কিন্তু আজ পর্যন্ত তা আশ্বাসেই রয়ে গেছে।
জানতে চাইলে এ চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসুমা আক্তার জানান, বন্ধ থাকা অবস্থায় স্থায়ী ও অস্থায়ী কর্মকর্তা ও কর্মচারীর বেতন বাবদ এখনো ১৭ লাখ টাকা গুনতে হচ্ছে সরকারকে। ১৯২৫ একর জায়গার ওপর প্রতিষ্ঠিত এ চিনিকল ও সাহেবগঞ্জ বাগদাফার্ম দেশের অনেক বড় একটি সম্পদ।
তিনি বলেন, চিনিকলটিকে আধুনিকায়নের মাধ্যমে লাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসাবে ফেরাতে পারলে একদিকে যেমন ঘুরবে অর্থনীতির চাকা অপরদিকে নিজেদের ভাগ্য ফিরে পেতে পারে কলের সাথে জড়িত লক্ষাধিক মানুষ।
চিনিকল সূত্রে জানা যায়, গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার মহিমাগঞ্জ এলাকায় অবস্থিত কলটিতে ১১শ শ্রমিক-কর্মচারী-কর্মকর্তা ও কয়েহাজার হাজার আখচাষী ছিলেন। সম্পৃক্ত ছিলেন বিভিন্ন শ্রেণীপেশার মানুষ। তাঁদের জীবিকার একমাত্র অবলম্বন ছিল এই চিনিকল।
চিনিকলের সাবেক সুইচবোর্ড এটেনডেন্ট মোঃ রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘চিনিকলটি সাময়িকভাবে বন্ধ হওয়ার পর কাজ নাই, মজুরি নাই চুক্তিতে এবং সম্পূর্ণ বন্ধ হওয়ার আগপর্যন্ত আমি এই চিনিকলে কর্মরত ছিলাম। বর্তমানে কর্মহীনতায় মানবেতর জীবনযাপন করছি। মহিমাগঞ্জের উন্নয়নে অবদান রাখা একমাত্র ভারী শিল্পপ্রতিষ্ঠানটি পুনরায় চালু করা হলে আমিসহ কর্ম হারানো অনেকের মানবেতর জীবনের অবসান হবে।’
সুগার মিলটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট লোকজন বলেন, কলটি চালু না করে বরং এখানকার স্থায়ী কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের অন্য জায়গায় পদায়ন করা হয়েছে। এখানকার বিভিন্ন মালামাল, ট্রলি ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতিও সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। এতে আরো হতাশ হয়ে পড়েছেন তাঁরা।
মহিমাগঞ্জ ইউনিয়নের সোনার পাড়া এলাকার জিন্নাত আলী চিনিকলের একমাত্র চাকরি হারিয়ে ভ্যান চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন। তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, ‘চাকরি হারিয়ে অনাহারে-অর্ধাহারে দীর্ঘদিন অতিবাহিত করার পর পরিবারের মুখে দুমুঠো খাবার যোগাতে আমি ভ্যানচালকের পেশা বেছে নিতে বাধ্য হই। আমার মত আরো অনেক শ্রমিক কর্মচারী অবর্ণনীয় কষ্টে দিন যাপন করছেন। কলটি চালু হবে– এমন আশায় এখনো রয়েছেন।’
কল সূত্র জানায়, ২০০৩-২০০৪ মৌসুমের পর চিনিকলটি প্রথমে লে-অফ ও পে-অফ করা হয়। তবে ব্যাপক আন্দোলনের মুখে ২০০৭-২০০৮ মৌসুমে আবার আখ মাড়াই শুরু করা হয় কলটিতে। কিন্তু বর্তমানে চালু থাকা অন্যান্য চিনিকলের থেকে অধিক মাড়াই ক্ষমতাসম্পন্ন হওয়ার পরেও ২০২০ সালে এটি বন্ধ করে দেওয়া হয়।
কয়েকজন শ্রমিক বলেন, কাজ হারানো চুক্তিভিত্তিক শ্রমিকেরা এখন খেয়ে না খেয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। এটি চালু না করায় এখানকার কয়েক হাজার শ্রমিক-কর্মচারীসহ আখ চাষী দিন-দিন ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছেন।
আখচাষী মো: আতোয়ারুল ইসলাম নান্নু বলেন, রংপুর চিনিকল চলাকালে ১৫ বিঘা জমিতে তিনি আখ চাষ করতেন। কল চালু না থাকায় এখন আখ চাষ পুরাপুরি বন্ধ করে দিয়েছেন। এতে তাঁরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
বর্তমানে জঙ্গলে পরিপূর্ণ চিনিকল চত্ত্বরটি দেখলে বোঝার উপায় নেই এক সময় এটি ছিল এই এলাকার একমাত্র ভারীশিল্প এলাকা। শ্রমিক-কর্মচারীসহ বিভিন্ন রকম মানুষের পদচারণায় মুখর থাকত জায়গাটি।। খোলা আকাশের নিচে অযত্নে অবহেলায় পড়ে থাকা মূল্যবান বিভিন্ন যন্ত্রপাতি ও আখ পরিবহনে ব্যবহৃত যানবাহনগুলো দেখে বোঝার উপায় নেই, সেগুলো কখনো ব্যবহৃত হতো। সব মিলিয়ে চত্বরটিতে বিরাজ করছে ভূতুড়ে নীরবতা।
কল সূত্রে জানা যায়, ১৯৫৪ সালে তৎকালীন রংপুর জেলার গাইবান্ধা মহকুমার গোবিন্দগঞ্জ থানার মহিমাগঞ্জ ইউনিয়নে ২৬১ কোটি টাকা ব্যয়ে ৩৫ একর জমির উপর গড়ে তোলা হয় এই ভারী শিল্প প্রতিষ্ঠানটি। ১৯৫৭-৫৮ মৌসুম থেকে আখ মাড়াই কার্যক্রম শুরু হয় চিনিকলটিতে। অবশেষে ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রায়াত্ব প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃতি পায় চিনিকলটি। কলটিতে কর্মকর্তাদের জন্য আবাসিক স্থাপনা, পুকুর, ইক্ষু ক্রয়কেন্দ্র ও আটটি সাব জোন রয়েছে। দৈনিক ১৫০০ মেট্রিক টন মাড়াই ক্ষমতাসম্পন্ন কলটির ছিল নিজস্ব বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থা। আখ পরিবহনের জন্য ছিল নিজস্ব রেলপথ।
চিনিকল শ্রমিকনেতা ফারুক হোসেন ফটু বলেন, এ চিনিকলে স্টিম ইঞ্জিনের পরিবর্তে ইলেকট্রনিক ইঞ্জিন বসানোসহ আধুনিকীকরণের মাধ্যমে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা সম্ভব। শুধু চিনিকল এলাকায় ৩৯০০ একর আখচাষ যোগ্য জমিসহ সাহেবগঞ্জ বাগদাফার্ম ইক্ষু খামারের ১৮৪২ একর জমিতে চাষাবাদ সারা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিতে পারে। শুধু চিনিকল থেকেই মহিমাগঞ্জে প্রতি মাসে এক কোটি টাকা ট্রানজেকশন হতো। যা এখন শুধুই স্মৃতি। চিনিকলের সাথে মহিমাগঞ্জের ঐতিহ্যও আজ বিলীন হওয়ার পথে। তাঁরা অবিলম্বে এটি চালু করার ঘোষণা চান।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে রংপুর চিনিকলের মহাব্যবস্থাপক (জিএম- ফাইনান্স) মো: রুহুল আমিন বলেন, ‘রংপুর চিনিকলের রিপেয়ারিং কস্ট হতে পারে দুই থেকে আড়াই কোটি টাকা।
নতুন যন্ত্রাংশ স্থাপনের মাধ্যমে চিনিকলটিকে সুব্যবস্থাপনায় মাড়াই কাজে ফেরাতে পারলে তা দেশ ও জনগণের জন্য মঙ্গলজনক হতে পারে বলে তিনি মনে করেন।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।