মো. রাকিবুল ইসলাম : জাতিসংঘের তথ্যমতে মিয়ানমারের রাখাইনে আরাকান আর্মি ও ক্ষমতাসীন জান্তা বাহিনীর প্রবল সংঘাতের মুখে নতুন করে এ পর্যন্ত রাজ্যটির প্রায় ৪৫ হাজার রোহিঙ্গা বাড়িঘর ছেড়ে বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী এলাকায় আশ্রয় নিয়েছে।
এ তথ্য জানিয়েছেন জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক কার্যালয়ের মুখপাত্র এলিজাবেথ থ্রসেল।
অব্যাহত সংঘাতে সেখানকার বেসামরিক লোকজনকে হত্যা এবং তাদের বাড়িঘরে আগুন দেওয়ার
অভিযোগও পাওয়া যাচ্ছে। খবরটি খুবই উদ্বেগজনক ও দুশ্চিন্তার এবং জান্তা সরকারের মানবাধিকার
লঙ্ঘনের ধারাবাহিক ঘটনার উদাহরণ। তাছাড়া বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী হওয়ায় পূর্ববর্তী সময়ের মতো নতুন
করে বিপদগ্রস্ত রোহিঙ্গারা আশ্রয়ের সন্ধানে ভবিষ্যতেও বাংলাদেশে চলে আসার সম্ভাবনা জোরালো হচ্ছে।
এ বিষয়ে সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় এলিজাবেথ থ্রসেল সাংবাদিকদের বলেন, মিয়ানমারে চলমান সংঘাতের
কারণে সম্প্রতি রাখাইনের বুথিডং ও মংডুর কয়েক হাজার বেসামরিক মানুষ বাড়িঘর ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছে।
নিরাপদ আশ্রয়ের আশায় বাড়িঘর ছেড়ে বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী নাফ নদ সংলগ্ন একটি এলাকায় আশ্রয়
নিয়েছে আনুমানিক ৪৫ হাজার রোহিঙ্গা। সহিংসতার মাত্রা আরও বাড়তে পারে বলে সতর্ক করেছেন জাতিসংঘ মানবাধিকার সংস্থার এ মুখপাত্র। তিনি বলেছেন, মংডুতে লড়াই চলছে। সেখানে সামরিক বাহিনীর একাধিক চৌকি আছে। এছাড়া এলাকাটিতে রোহিঙ্গাদের একটা বড় অংশ বাস করে। আতঙ্কজনক এ পরিস্থিতিতে সেখানকার বেসামরিক নাগরিকেরা আরও একবার হত্যা, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের শিকার হচ্ছে। তাদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিতে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না। তাই তারা বাড়িঘর ছেড়ে পালাতে বাধ্য হচ্ছে।
এ অবস্থায় রোহিঙ্গাদের সুরক্ষার ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে আহ্বান জানিয়েছেন এলিজাবেথ থ্রসেল। তিনি
বলেছেন, ইতোমধ্যে বাংলাদেশে ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গা রয়েছে। এর আগের সহিংসতার সময় বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে তারা। জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক প্রধান ফলকার টুর্ক বাংলাদেশসহ অন্য দেশগুলোকে আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে ‘যারা সুরক্ষা খুঁজছেন তাদের তা দেওয়ার’ অনুরোধ করেছেন।
একই সঙ্গে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়ায় বাংলাদেশের প্রতি আন্তর্জাতিক সংহতি
নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছেন।
শুধু জাতিসংঘই নয়, মিয়ানমারের সংঘাত পরিস্থিতির অবনতি নিয়ে সতর্ক করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), যুক্তরাষ্ট্রসহ আরও কয়েকটি দেশ। এক যৌথ বিবৃতিতে দেশগুলো বলছে, ‘সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা অধ্যুষিত রাখাইন রাজ্যে চলমান সহিংসতার মুখে হাজারো বেসামরিক নাগরিক বাড়িঘর ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছে। বেসামরিক নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিতে বিবাদমান সব পক্ষের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি আমরা।’
নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিতে দেশগুলো আহ্বান জানিয়েছে- এটি অত্যন্ত ইতিবাচক দিক। তবে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও দেশসমূহের এ ধরনের আহ্বানকে অনেকাংশে একপক্ষীয় বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তাঁরা মনে করছেন, যাদের জন্য রোহিঙ্গারা আরাকান থেকে প্রতিনিয়ত বিতাড়নের মুখোমুখি হচ্ছে, তাদের ব্যাপারে স্পষ্টত কোনো নির্দেশনা কিংবা বার্তা কেউই প্রদান করছে না। কয়েকবার প্রত্যাবাসনের দিনক্ষণ নির্ধারিত হলেও শেষাবধি প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া চালু হয়নি। বর্তমান সময়ে এসেও জাতিগত বিরোধের জের ধরে একটি জাতিকে দেশ থেকে জোরপূর্বক তাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, কিন্তু এর কোনো প্রতিকার হচ্ছে না। আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনগুলোর ব্যর্থতার কারণেই মিয়ানামরের সামরিক জান্তা সরকার এ ধরনের জঘন্য কাজ করার সাহস পেয়েছে।
দীর্ঘকাল ধরে রোহিঙ্গারা আরাকান রাজ্যে বসবাস করে আসছে। মিয়ানমারের সরকারে রোহিঙ্গা থেকে
নির্বাচিত এমপি, মন্ত্রীদের দায়িত্ব পালনের ইতিহাসও রয়েছে। এ দিয়েই প্রমাণ হয় রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের
আদি জাতি। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের হিসাবের তুলনায় অধিক সংখ্যক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে বসবাস করছে। উখিয়া উপজেলায় অসংখ্য ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে। পরিবেশ ও প্রকৃতির ওপর যে নির্যাতন করা হয়েছে তার ক্ষতি কোনোভাবেই পূরণ করা সম্ভব নয়। গাছপালা, পাহাড় কেটে এলাকাটিকে একেবারে বিরানভূমিতে পরিণত করা হয়েছে। তাছাড়া রোহিঙ্গাদের শিশু জন্মের হার ব্যাপক আকারে বৃদ্ধি পেয়েছে। যে হারে শিশু জন্মগ্রহণ করছে এর ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে অদূর ভবিষ্যতে রোহিঙ্গা জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করা দুঃসহ হয়ে পড়বে।
তাছাড়াও রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি হয়ে থাকে বিভিন্ন সময়। যা
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ। কক্সবাজারে সাম্প্রতিককালে সন্ধ্যার
পরে কিংবা রাতে বিশেষ করে যেখানে পর্যটকগণ অবস্থান করেন সেখানে ছিনতাইয়ের ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে।
যেখানে এক সময় নিরাপদ পরিবেশ বজায় ছিল সেখানে পর্যটকরা প্রতিনিয়ত অনিরাপদ পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছেন। উখিয়া ক্যাম্প থেকে রোহিঙ্গারা কক্সবাজার সদরে এসে চুরি, ছিনতাই করে আবার ক্যাম্পে ফেরত চলে যায় বলে অভিযোগ রয়েছে। এর ফলশ্রুতিতে অদূর ভবিষ্যতে কক্সবাজারে দেশী-বিদেশী পর্যটকদের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে কমে আসতে পারে বলে অভিমত স্থানীয়দের। যার প্রভাব পড়বে পর্যটন শিল্প ও এর সাথে সম্পৃক্ত সকল ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর।
এছাড়াও কক্সবাজারের ক্যাম্পগুলোতে মাদকের সরবরাহ ও মাদকসেবীদের আনাগোনা বৃদ্ধি পেয়েছে। সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর তৎপরতা দেখা গেছে। কয়েকটি এনজিওর বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদে অর্থায়নের অভিযোগ এসেছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো পর্যায়ক্রমে অপরাধ ও অপরাধীদের অভয়াশ্রমে পরিণত হচ্ছে। ক্যাম্পে যারা বসবাস করে তাদের তেমন কোনো কাজকর্ম নেই। সে কারণেই তারা বিভিন্ন ধরনের অপকর্মের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। রোহিঙ্গারা ইতোমধ্যে বুঝতে পেরেছে যে, বাংলাদেশেই তারা নিরাপদ। যা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে অন্তরায় হিসেবে কাজ করছে।
সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া দ্রুত সম্পাদন করে বাংলাদেশের ওপর থেকে অযাচিত চাপ কমিয়ে আনার জন্য দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। প্রকৃত অর্থে বিধিনিষেধ, স্যাংশন আরোপ করে জান্তা সরকারকে রোহিঙ্গাদের অধিকার নিশ্চিতে বাধ্য করতে বিশ্বনেতাদের জোরালোভাবে এগিয়ে আসতে হবে। তা না হলে রোহিঙ্গা সমস্যা বাংলাদেশের গলার কাঁটা হয়ে যুগ যুগ ধরে ঝিইয়ে থাকবে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।