সাইয়েদা আক্তার, বিবিসি বাংলা : নামে কি-ই বা আসে যায়! মনীষীরা এ কথাই বলে এসেছেন বটে যে নামের চেয়ে কর্মের গুরুত্ব বেশি, তা সে মানুষের হোক কি স্থানের। কিন্তু নামে আসলেই এসে যায়- অন্তত তেমনটাই দেখা গেছে সম্প্রতি।
বিশেষ করে কোন জায়গার নাম যদি হয় কিছুটা বিব্রতকর, কিংবা তার যদি দ্বৈত মানে থাকে, অর্থাৎ অন্য কোন অঞ্চলে ঐ একই শব্দের হয়ত ভিন্ন অর্থ প্রচলিত থাকতে পারে।
এজন্যই হয়ত বাংলায় আরেকটি প্রবচন চালু আছে, ”এক দেশের বুলি আরেক দেশের গালি।”
সামজিক মাধ্যমে আলোচনা
বাংলাদেশে বেশ কিছু স্থানের নাম আছে এমন দ্বৈত অর্থের বা বিব্রতকর শব্দবন্ধ দিয়ে, সেগুলো নিয়ে সম্প্রতি সামাজিক মাধ্যমে আলোচনা শুরু হয়েছে।
এই আলোচনা শুরু হয়েছে, উত্তরাঞ্চলীয় জেলা নীলফামারীতে সম্প্রতি একটি স্কুলের নাম ”মানুষ-মারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়” থেকে পরিবর্তন করে ”মানুষ-গড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়” করার পর।
এ বিষয়ে একটি পোষ্ট বিবিসি বাংলার ফেসবুক পাতায় দেয়ার পর, দেড় হাজারের বেশি মানুষ সেখানে মন্তব্য করেছেন। অনেকে লিখেছেন, বাংলাদেশের অনেক স্থানের নামই কিছুটা অস্বস্তি তৈরি করে, যে কারণে সেসব নাম পাল্টে দেবার দাবি তুলেছেন অনেকে।
যদিও অনেকেই আবার কোন নাম পরিবর্তনের আগে সেসব জায়গার ইতিহাস জেনে পরিবর্তনের পক্ষে মন্তব্য দিয়েছেন।
কেউ কেউ আবার নাম পরিবর্তনের পুরোপুরি বিপক্ষে।
যেসব নাম নিয়ে দুশ্চিন্তা
বিবিসির ফেসবুক পাতায় উল্লেখিত কমেন্টে যেসব জায়গার নাম নিয়ে বেশি আপত্তি উঠেছে, তার মধ্যে পঞ্চগড়ের বোদা, নওগাঁর পত্নীতলা, খুলনার সোনাপোতা, রাঙ্গামাটির চুমোচুমি, ঝিনাইদহের চুলকানি বাজার, চাঁদপুরের ল্যাংটার হাট, টাঙ্গাইলের মহিষমারা, ফেনীর ছাগল নাইয়া থানা, গাইবান্ধা জেলা, পটুয়াখালী জেলার গলাচিপা, এবং ঢাকার ভূতের গলি উল্লেখযোগ্য।
পঞ্চগড়ের বোদা
উত্তরাঞ্চলীয় জেলা পঞ্চগড়ের একটি উপজেলার নাম বোদা। বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় এই শব্দটি নারীর প্রজনন অঙ্গের প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ফলে স্বাভাবিকভাবেই এই নামটি নিয়ে অস্বস্তি রয়েছে অনেকের।
সেখানকার বাসিন্দা ও বাইরে থেকে সেখানে থাকতে যান এমন অনেকেরই আপত্তি রয়েছে, জায়গাটির ব্যাপারে। বিবিসির ফেসবুক পাতায় যারা মন্তব্য করেছেন, তাদের একটি বড় অংশ এই উপজেলার নাম নিয়ে নিজেদের অস্বস্তির কথা উল্লেখ করেছেন।
চাকুরী সূত্রে বোদায় কয়েক বছর অবস্থান করেছেন এমন একজন লিখেছেন, “কিছু কিছু উপজেলার নাম বলতে অনেকে লজ্জা পায়। যেমন ধরুন পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলা। ব্র্যাকে চাকুরি কালীন ঐ উপজেলায় পোস্টিং হলে প্রথম প্রথম লজ্জায় বলতে পারতাম না।”
তবে, বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়নে উপজেলা পরিচিতি অংশে লেখা আছে, এক সময় বোদা উপজেলায় ‘বদেশ্বরী’ নামে একটি মন্দির ছিল, যার নামানুসারে ঐ এলাকার নামকরণ হয়।
পত্নীতলা
পত্নীতলা বাংলাদেশের নওগাঁ জেলার একটি উপজেলা।
পত্নী শব্দটি স্ত্রী শব্দের একটি প্রতিশব্দ, যে কারণে এই উপজেলাটি নিয়েও অনেকে হাস্যরস করে থাকেন। সে কারণে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকেই এই জায়গাটির নাম পরিবর্তন করা যায় কিনা কর্তৃপক্ষকে তা বিবেচনার দাবি জানিয়েছেন।
কিন্তু বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়নে পত্নীতলা উপজেলা পরিচিতি অংশে লেখা আছে, নামটি এসেছে পত্তনীতোলা, পাঠানতোলা কিংবা পাটনীতোলা শব্দ থেকে।
সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, পাঠান রাজত্বকালে বরেন্দ্র এলাকার অনেক পরগণা পাঠান জমিদারদের অধীন ছিল। পাঠান নৃপতি বা রাজ কর্মচারীরা বর্তমান পত্নীতলা বাজারে অবস্থান করে জমি পত্তন দেওয়ার কাজ সমাধা করতেন।
সেই পত্তন শব্দ থেকে পত্তনী এবং ক্রমে পত্তনীতোলা বা পাঠানতোলা নামকরণ হয়, সেখান থেকে ক্রমে আসে পত্নীতলা নামটি।
চুমাচুমি প্রাথমিক বিদ্যালয়
রাঙ্গামাটি জেলার জুরাছড়ি উপজেলার একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নাম, চুমাচুমি প্রাথমিক বিদ্যালয়। ১৯৬৬ সালে প্রতিষ্ঠিত স্কুলটি নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে অনেক তামাশা প্রচলিত রয়েছে। নাম নিয়ে বিড়ম্বনার অভিজ্ঞতা বিবিসির সঙ্গে শেয়ার করেছেন কেউ কেউ।
কিন্তু সেখানকার বাসিন্দারা বলছেন, এই নামটি এসেছে সেখানকার একটি নদী থেকে। জুরাছড়ি উপজেলার ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য বিরো চাকমা বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, সুবলং নদীটির চাকমা নাম শলক নদী। সেই দুইটি উপনদী মুখোমুখি হয়েছে জুরাছড়িতে।
মুখোমুখি শব্দটিকে চাকমা ভাষায় বলা হয় ‘সুমোসুমি’, যা দুইটি উপনদীর মুখোমুখি হবার সংযোগস্থলকে নির্দেশ করে। কালক্রমে সুমোসুমি শব্দটি বিকৃত হয়েই এই চুমোচুমি বা চুমাচুমি নামটি এসেছে।
সোনাপোতা
খুলনা জেলা শহরে অবস্থিত একটি জায়গায় নাম সোনাপোতা। সোনা বিশ্বের সবচেয়ে মূল্যবান ধাতব পদার্থের নাম, সন্দেহ নেই। কিন্তু বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় এ শব্দটি আঞ্চলিক পরিমণ্ডলে পুরুষ জননাঙ্গের প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
খুলনা জেলা শহরে এই নামে বেশ কয়েকটি স্কুল এবং অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ফলে নিঃসন্দেহে নামটি নিয়ে অনেকেরই অস্বস্তি রয়েছে। কিন্তু খুলনা শহরের পুরনো বাসিন্দারা জানিয়েছেন, শহরের যে অংশের নাম সোনাপোতা, আগে সেই জায়গাটির নাম ছিল ময়লাপোতা।
কারণ সেখানে একটি বড় ময়লার ডিপো ছিলো, পরবর্তীতে আশির দশকে ঐ জায়গার নামকরণ করা হয় সোনাপোতা।
ল্যাংটার হাট
চাঁদপুর জেলার মতলব উপজেলার একটি বাজারের নাম ল্যাংটার হাট। এটি নিয়েও ব্যাপক অস্বস্তি দেখা গেছে সামাজিক মাধ্যমে মন্তব্যকারীদের পোস্টে। তবে বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়নের তথ্য অনুযায়ী মতলব জেলার বদরপুরে একটি মাজার রয়েছে যার নাম সোলেমান ল্যাংটার মাজার।
সেখান থেকেই মূলত বাজারের নামকরণ করা হয়েছে।
পরিবর্তনের বিপক্ষে যুক্তি
বিবিসির সামাজিক মাধ্যমে দেয়া পোস্টের ওপর যেসব কমেন্ট পড়েছে, তার একটি বড় অংশ জায়গার নাম পরিবর্তনের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। তাদের যুক্তি ওইসব এলাকায় যারা জন্মেছেন ও বেড়ে উঠেছেন, তাদের কাছে হয়ত নামগুলো আলাদা করে বিব্রতকর নয়, যে কারণে তাদের কাছে নামগুলো স্বাভাবিক শোনায়।
এছাড়া তাদের আরেকটি যুক্তি হচ্ছে, প্রতিটি নামের পেছনে একটি ইতিহাস থাকে, যা সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান না থাকার কারণেই নামগুলো বিকৃত করে মানুষ।
ফলে নাম পরিবর্তন না করে তাদের প্রস্তাব হচ্ছে প্রতিটি নামের সঠিক ইতিহাস তরুণ প্রজন্মের কাছে উপস্থাপন করা হোক্।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।