মো. রাকিবুল ইসলাম : বিশ্বজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব প্রতিরোধের লক্ষ্যে জাতিসংঘের আয়োজনে প্রতি বছর “কনফারেন্স অব দ্য পার্টিস” (COP) সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে বিভিন্ন দেশের নেতৃবৃন্দ, বিজ্ঞানী, গবেষক এবং পরিবেশবাদীরা একত্রিত হয়ে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বিভিন্ন কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেন।
এবারের কপ-২৯ আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে অনুষ্ঠিত হচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম।
এছাড়া এবারের কপ সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন বিশ্বখ্যাত অর্থনীতিবিদ, সমাজকর্মী বর্তমান সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুস। তিনি বিশ্ব-নেতাদের কাছে অত্যন্ত শ্রদ্ধ্বা ও সম্মানের পাত্র।
ড. ইউনূস কপ-২৯ সম্মেলনে তার উদ্ভাবনী উদ্যোগ, সামাজিক ব্যবসা এবং টেকসই উন্নয়ন মডেল নিয়ে আলোচনা করার পাশাপাশি বিশ্ব-নেতাদের সাথে আলাদা-আলাদা বৈঠক করেছেন। এর মধ্যে আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিয়েভ –এর সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি বাংলাদেশ-আজারবাইজান সম্পর্কের নতুন দিগন্ত উন্মোচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন দুই দেশের সংশ্লিষ্ট মহল।
কপ এমন একটি আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্ম যেখানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ, সংস্থা এবং সংগঠনগুলি জলবায়ু পরিবর্তন, পরিবেশগত সংকট এবং টেকসই উন্নয়ন নিয়ে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত নেয়। এই সম্মেলন বাংলাদেশের জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি দেশের জলবায়ু অভিযোজন এবং প্রতিরোধ কৌশলকে বিশ্বব্যাপী পরিচিতি দেওয়ার একটি সুযোগ। বাংলাদেশের জন্য জলবায়ু পরিবর্তন একটি গুরুতর সমস্যা। বঙ্গোপসাগরের উপকূলীয় অঞ্চলে বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, ভূমিক্ষয়, জলস্তরের উচ্চতা বৃদ্ধি—এসব কারণে বাংলাদেশের কৃষি, অবকাঠামো এবং জনগণের জীবিকা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। বিশ্বব্যাপী এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় পূর্ব থেকেই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ড. মোহাম্মদ ইউনুসের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ড. মোহাম্মদ ইউনুস ২০০৬ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার বহু আগে থেকেই বিশ্বের অন্যতম অগ্রগামী সমাজকর্মী এবং অর্থনীতিবিদ। তার সবচেয়ে বড় অবদান হলো মাইক্রোক্রেডিট (ক্ষুদ্রঋণ) ব্যবস্থা, যা তিনি গ্রামীণ ব্যাংকের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি সবসময় মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে উন্নয়নের কথা বলেছেন এবং তার কাজের মধ্যে তিনি জলবায়ু পরিবর্তন ও দারিদ্র্য দূরীকরণের পাশাপাশি টেকসই ব্যবসা মডেলের প্রচার করেছেন।
ড. ইউনুস এবারের কপ-২৯ সম্মেলনেও সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা ও টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে বিভিন্ন পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি বিশ্বাস করেন, ব্যবসার মূল লক্ষ্য শুধু মুনাফা অর্জন নয়, বরং সমাজের কল্যাণ এবং পরিবেশের উন্নতি নিশ্চিত করা। তার “সোশ্যাল বিজনেস” ধারণা জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় অত্যন্ত কার্যকরী হতে পারে, যেখানে পরিবেশবান্ধব উদ্যোগগুলো লাভজনক এবং সমাজের কল্যাণে কাজ করবে।
তিনি আশা করেন যে, কপ ২৯ সম্মেলনটি তার ধারণাকে বাস্তবে রূপ দিতে এবং বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তন, দারিদ্র্য এবং বৈষম্য নিরসনের জন্য একটি নতুন পথ উন্মোচন করবে।
বাংলাদেশ-আজারবাইজান সম্পর্ক: এক নতুন দিগন্ত
বাংলাদেশ ও আজারবাইজান দেশ-দুটি ভৌগলিকভাবে একে অপর থেকে বেশ দূরে, তবুও তাদের মধ্যে সম্পর্ক ক্রমবর্ধমান। কপ-২৯ সম্মেলন এই সম্পর্কের নতুন একটি দিক উন্মোচন করেছে, যেখানে বাংলাদেশ এবং আজারবাইজান একে অপরের সঙ্গে অর্থনৈতিক, পরিবেশগত এবং সামাজিক উদ্যোগে পারস্পরিক সহযোগিতা বাড়ানোর সুযোগ পাবে।
আজারবাইজান একটি শক্তিশালী তেল-গ্যাস রপ্তানিকারক দেশ, যার অর্থনৈতিক ভিত্তি শক্তিশালী। অপরদিকে বাংলাদেশ তার কৃষি, শ্রমশক্তি এবং মানবসম্পদ উন্নয়নের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়েছে। বাংলাদেশ আজারবাইজানকে তার গ্রামীণ উন্নয়ন মডেল এবং সামাজিক ব্যবসা উদ্যোগের মাধ্যমে সহায়তা প্রদান করতে পারে। পাশাপাশি, আজারবাইজান বাংলাদেশের জ্বালানি ও পরিবহন খাতে বিনিয়োগ করার সুযোগ খুঁজতে পারে।
আজারবাইজানের তেল ও গ্যাস খাতের শক্তিশালী অবস্থান রয়েছে, এবং এটির ক্রেতা-দেশ হিসেবে বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ বাজার হতে পারে। পাশাপাশি, আজারবাইজান বাংলাদেশের তৈরি পোশাক, চামড়া শিল্প ও কৃষিপণ্য আমদানি করতে আগ্রহী হতে পারে। চলমান কপ-২৯ সম্মেলনে দুই দেশের মধ্যে এই খাতগুলোর মাধ্যমে পারস্পরিক সহযোগিতা বাড়ানোর প্রচেষ্টা করা যেতে পারে।
জলবায়ু পরিবর্তন প্রতিরোধে বাংলাদেশ-আজারবাইজান এর মধ্যে যে সহযোগিতা হতে পারে, তা হবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আজারবাইজান একটি তেল-গ্যাস শক্তিধর দেশ হওয়া সত্ত্বেও, তারা বর্তমানে নবায়নযোগ্য শক্তি এবং পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দিচ্ছে। বাংলাদেশের জন্য এই সহযোগিতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ বাংলাদেশ তার নিজস্ব শক্তি খাত এবং জলবায়ু অভিযোজন কৌশল শক্তিশালী করার জন্য নতুন প্রযুক্তি এবং উদ্ভাবনী ধারণা চায়।
আজারবাইজান বাংলাদেশকে তার নবায়নযোগ্য শক্তির উন্নয়ন, বিশেষ করে সৌরশক্তি, বায়ুশক্তি এবং বায়োএনার্জি খাতে সহায়তা করতে পারে। বাংলাদেশের জন্য এই সহযোগিতা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কমানোর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। একইভাবে, বাংলাদেশ তার অভিজ্ঞতা ও প্রযুক্তি, যেমন গ্রামীণ মাইক্রোফিন্যান্স মডেল, স্থানীয় উদ্যোগ, এবং পরিবেশবান্ধব কৃষি প্রযুক্তি শেয়ার করতে পারে।
বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে ড. মুহাম্মদ ইউনুসের উপস্থিতি এবং বাংলাদেশ-আজারবাইজান সম্পর্কের বিকাশ জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার পাশাপাশি দুই দেশের অর্থনৈতিক সম্পর্কেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। কপ-২৯ সম্মেলনটি বাংলাদেশের জন্য একটি বিশেষ সুযোগ, যেখানে তারা বৈশ্বিক জলবায়ু সমস্যা সমাধানে অংশগ্রহণের পাশাপাশি দুই দেশের মধ্যে নতুন ধরনের অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত সহযোগিতা তৈরি করতে পারে।
বাংলাদেশের জলবায়ু অভিযোজন কৌশল এবং আজারবাইজানের শক্তিশালী প্রযুক্তি ও গবেষণা ক্ষেত্র একত্রিত হলে, দুই দেশেই জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার ক্ষেত্রে বিপুল সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে। এ ছাড়া, ড. ইউনুসের সামাজিক ব্যবসা মডেল এবং টেকসই উন্নয়ন উদ্যোগগুলো এই নতুন সম্পর্কের ভিত্তি হিসেবে কাজ করবে, যা শুধু দুই দেশের জন্য নয়, বিশ্বব্যাপী পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় একটি মাইলফলক হতে পারে।
বাংলাদেশে স্যাটেলাইট ইন্টারনেট চালু করতে যাচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।