বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর সম্প্রতি বিআইবিএম আয়োজিত বার্ষিক ব্যাংকিং সম্মেলনে যে কঠোর বার্তা দিয়েছেন, তা দেশের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রকে এক নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার সুযোগ করে দিয়েছে। ব্যাংক খাতের দুর্বলতা, অর্থ পাচার, এবং ইসলামী ব্যাংকিং খাতে সংস্কারসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তিনি যে স্পষ্ট অবস্থান নিয়েছেন, তা শুধু বর্তমান নয়, ভবিষ্যতের নীতিনির্ধারণেও গভীর প্রভাব ফেলবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুরের বার্তা ও প্রেক্ষাপট
সম্মেলনের শুরুতেই গভর্নর বলেন, “যারা টাকা পাচার করেছে, তাদের জীবন কঠিন করে ফেলা হবে।” এই বক্তব্যের মাধ্যমে তিনি স্পষ্ট করেছেন যে, অবৈধভাবে বিদেশে অর্থ পাঠানো ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ও নৈতিক পদক্ষেপ নেওয়া হবে। স্বর্ণের বাজার পরিবর্তন কিংবা বিশ্ববাজারের প্রভাব—এমন আলোচনায় যেমন অর্থনৈতিক বিষয়গুলো গুরুত্ব পায়, তেমনি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই ধরনের হস্তক্ষেপ নৈতিক প্রতিশ্রুতির প্রতীক।
তিনি জানান, বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে মিলে পাচার করা অর্থ উদ্ধারে কাজ করছে। বিদেশি সহযোগিতার পাশাপাশি দেশীয় নীতিমালাও কঠোর করা হচ্ছে। ব্যাংক কোম্পানি আইনে পরিবর্তন এনে বোর্ড মেম্বারদের যোগ্যতা নির্ধারণ এবং পরিচালনায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা হচ্ছে।
এই কঠোর বার্তার পাশাপাশি গভর্নর বলেন, “বাংলাদেশ ব্যাংক নিজেও ব্যাংক খাতের দুর্বলতার একটি অংশ।” এটি একটি বিরল স্বীকারোক্তি, যা একটি প্রতিষ্ঠানকে আরও জবাবদিহিমূলক ও সংস্কারমুখী করে তোলে।
ইসলামী ব্যাংক একীভূতকরণ ও ব্যাংক কোম্পানি আইনের সংস্কার
ড. মনসুর ইসলামী ব্যাংকিং খাতকে ঢেলে সাজানোর ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, “বর্তমানে বড় একটি ইসলামী ব্যাংক ও অনেক ছোট ছোট ইসলামী ব্যাংক রয়েছে। এর মধ্যে অনেকগুলো সমস্যাগ্রস্ত।” তাই তিনি প্রস্তাব দেন ছোটগুলো একীভূত করে দুটি বড় ইসলামী ব্যাংক তৈরি করা হবে।
এই একীভূতকরণের লক্ষ্য হলো ব্যাংকিং কার্যক্রমে দক্ষতা আনা, সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং গ্রাহক সেবার মান উন্নয়ন। এ বিষয়ে গভর্নর বলেন, “ইসলামী ব্যাংকের জন্য পৃথক আইন ও তদারকির ব্যবস্থা চালু করা হবে।” আন্তর্জাতিক রীতিনীতি অনুসরণ করে এসব ব্যবস্থা কার্যকর করা হবে, যাতে ইসলামী ব্যাংকিং খাতের প্রতি আস্থা ফিরে আসে।
গভর্নর এ সময় আরও উল্লেখ করেন, “ব্যাংক কোম্পানি আইনে পরিবর্তন আনা হচ্ছে। কারা পরিচালনা পর্ষদে থাকবেন, তাদের যোগ্যতা কী হবে—সবকিছু নির্ধারণ করা হচ্ছে।” এই উদ্যোগ ব্যাংকিং ব্যবস্থায় একটি নীতি ও কাঠামোগত পরিবর্তন আনবে বলে আশা করা যায়।
তিনি আরও বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিপোর্টিং সিস্টেম পুরোপুরি স্বয়ংক্রিয় করা হবে, যাতে ব্যাংকগুলোর কর্মকাণ্ড দ্রুত ও নির্ভুলভাবে মূল্যায়ন করা যায়।
দ্বৈত শাসনের সমস্যা ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসন
ড. মনসুর তাঁর বক্তব্যে ব্যাংক খাতে “দ্বৈত শাসন” বা দ্বৈত তদারকি ব্যবস্থার সমস্যার কথাও তুলে ধরেন। একটি ব্যাংক যখন একাধিক কর্তৃপক্ষের অধীন পরিচালিত হয়, তখন তদারকি ও জবাবদিহি বিঘ্নিত হয়। এজন্য তিনি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসন জোরদারের ওপর জোর দেন।
তিনি বলেন, “আমরা চাই না কেন্দ্রীয় ব্যাংক দৈনন্দিন ব্যাংক পরিচালনায় হস্তক্ষেপ করুক, তবে তদারকি যাতে কার্যকর হয়, সে ব্যবস্থায় জোর দেওয়া হচ্ছে।” তিনি আরও বলেন, “সমস্যা হওয়ার আগেই আমরা যেন তা জানতে পারি, সেই লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কাজ করছে।”
বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসন রক্ষায় রাজনৈতিক সমর্থনের প্রয়োজনীয়তাও তুলে ধরেন গভর্নর। রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যেও যাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কার্যক্রম ধারাবাহিক থাকে, সে দিকেও গুরুত্ব দেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
এজেন্ট ব্যাংকিং ও ডিজিটাল ব্যাংকিং-এর প্রসার
গভর্নর বলেন, “এজেন্ট ব্যাংকিংকে আরও শক্তিশালী করা হচ্ছে এবং নারীদের অংশগ্রহণ ৫০% নিশ্চিত করতে হবে।” এটি দেশের অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তিকে এগিয়ে নেওয়ার একটি মহৎ উদ্যোগ।
তিনি জানান, বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন করে ডিজিটাল ব্যাংকিং লাইসেন্স দেওয়ার বিষয়ে কাজ শুরু করেছে। বিশেষ করে ক্ষুদ্রঋণ প্রদানে এসব ব্যাংকের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হবে।
মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হয়েছে বলে তিনি জানান। “নগদ”-এ প্রশাসক নিয়োগের পরও রেকর্ড লেনদেন হয়েছে। তিনি বলেন, “এখন প্রতিদিন ৫ হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয়, এবং আমরা আশা করছি সামনে তা ৬ হাজার কোটি ছাড়িয়ে যাবে।”
ব্যাংকিং খাতের সংস্কারে করণীয় ও ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের মতে, যেসব ব্যাংক মূলধনের ঘাটতিতে রয়েছে, তাদের সংস্কার করতে সময় লাগবে। তিনি বলেন, “কয়েক বছর লাগবে এসব ব্যাংক ঠিক করতে।” তবে এ সময় তিনি রাজনৈতিক সহযোগিতার গুরুত্বও পুনর্ব্যক্ত করেন।
ব্যাংক কোম্পানি আইন এবং পরিচালনা পর্ষদের গঠনে যে ধরনের পরিবর্তন আসছে, তা ভবিষ্যতের জন্য ইতিবাচক ইঙ্গিত দেয়। এটি ব্যাংকিং খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বাড়াবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর যেসব বিষয় তুলে ধরেছেন, তা শুধু অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলায় নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদী স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতেও সহায়ক হবে। তাঁর সাহসী অবস্থান ও পরিকল্পিত সংস্কার প্রস্তাবনা দেশের ব্যাংকিং খাতকে এক নতুন দিগন্তে নিয়ে যেতে পারে।
FAQs: বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর সম্পর্কিত সাধারণ জিজ্ঞাসা
বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান গভর্নর কে?
বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন ড. আহসান এইচ মনসুর।
গভর্নরের সাম্প্রতিক বক্তব্যের মূল বার্তা কী?
তিনি অর্থ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেওয়ার কথা বলেছেন এবং ব্যাংক খাতে স্বচ্ছতা ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে বিভিন্ন সংস্কারমূলক উদ্যোগ নিয়েছেন।
ইসলামী ব্যাংক একীভূতকরণ কীভাবে বাস্তবায়িত হবে?
একাধিক ছোট ইসলামী ব্যাংককে একীভূত করে দুটি বড় ব্যাংক গঠন করা হবে, যাতে ব্যাংকিং কার্যক্রমে সুশাসন ও দক্ষতা আসে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসন কতটা জরুরি?
স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত না হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কার্যকরভাবে কাজ করতে পারে না। এটি নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং তদারকিতে বাধা সৃষ্টি করে।
এজেন্ট ব্যাংকিং ও ডিজিটাল ব্যাংকিং-এর ভূমিকা কী?
এজেন্ট ব্যাংকিং গ্রামীণ ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে আর্থিক সেবার আওতায় আনে, আর ডিজিটাল ব্যাংকিং দ্রুত ও সহজ লেনদেন নিশ্চিত করে।
ব্যাংক কোম্পানি আইনে কী ধরনের পরিবর্তন আসছে?
পরিচালনা পর্ষদে কারা থাকবেন, তাঁদের যোগ্যতা কী হবে—এসব বিষয় স্পষ্টভাবে আইনে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। এটি স্বচ্ছতা নিশ্চিত করবে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।