মনিরুল হায়দার পিনু: করোনার এ সময়ে পুরো বিশ্বের অর্থনীতির চাকা অনেকটাই গতি হারিয়েছে। সরকার বিভিন্নভাবে চেষ্টা করছে অর্থনীতির চাকাকে গতিশীল করার বিভিন্ন প্রণোদনা প্যাকেজ দিয়ে। একেবারে প্রান্তিক পর্যায়ে টাকা সরবরাহ বাড়িয়ে। এমনকি আমাদের সরকারও সরকারি চাকুরিজীবী ফ্রন্টলাইনারদের জন্য প্রণোদনা দিয়ে যাচ্ছে বাজারে টাকা সরবরাহ যতদূর সম্ভব স্বাভাবিক রাখা যায়। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান কর্মচারীদের নৈতিক মনোবল বাড়াতে বেতন বাড়িয়েছে। মুম্বাইভিত্তিক মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি এশিয়ান পেইন্টস তার একটি উদাহরণ।
গতকাল আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংক একসাথে পলিসি রেটে তিনটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এনেছে অর্থনীতির চাকাকে গতিশীল রাখতে, স্থবিরতা কাটিয়ে কীভাবে আরো চাঙা করা যায়। একেবারে সাধারণ ভাষায় পরিবর্তন তিনটি সম্পর্কে তুলে ধরার চেষ্টা করছি।
রেপো রেট মানে হলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো যে হারে টাকা ধার নেয়। গতকাল এটা ৫.২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৪.৭৫ শতাংশ করা হয়েছে। অর্থাৎ আগে যেখানে একশত টাকা ধার নেওয়ার জন্য পাঁচ টাকা পঁচিশ পয়সা লাগতো এখন সেটা নিতে আগের তুলনায় পঞ্চাশ পয়সা কম খরচ হবে। মানে হলো ব্যাংকগুলো কম মূল্যে টাকা ধার নিতে পারবে। এতে বাজারে নগদ টাকা সরবরাহ বাড়বে এবং সেটা পূর্বের তুলনায় কম মূল্যে।
রিভার্স রেপো মানে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো যে হারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে টাকা রাখবে। গতকাল এটা ৪.৭৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৪.০০ শতাংশ করা হয়েছে। অর্থাৎ আগে যেখানে ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকে একশত টাকা বিনিয়োগ করে চার টাকা পঁচাত্তর পয়সা পেতো এখন সেখানে পাবে চার টাকা। মানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বিনিয়োগ আগের তুলনায় কম লাভজনক হবে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর জন্য। ফলে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো তুলনামূলক বেশি লাভজনক বিনিয়োগ উৎস খুঁজে বের করবে যেখান বিনিয়োগ করে বেশি লাভ করা যাবে। এতেও বাজারে নগদ টাকা সরবরাহ বাড়বে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে যে হারে ঋণ দিয়ে থাকে সেটা হলো ব্যাংক রেট। ২০০৩ সালের পর থেকে গতকাল অব্দি এটা ছিলো ৫ শতাংশ। এক শতাংশ কমিয়ে এটা করা হয়েছে ৪ শতাংশ। মানে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো আগের তুলনায় এক শতাংশ কম সুদে ঋণ গ্রহণ করতে পারবে। এতেও বাজারে নগদ টাকার প্রবাহ বাড়বে।
এগুলো কী প্রভাব ফেলবে বাজার অর্থনীতিতে সেটা একবার দেখে নেওয়া যাক।
আপনার ক্রয়ক্ষমতা যখন বাড়ে অর্থাৎ যখন আপনার কাছে টাকার পরিমাণ বেশি থাকে তখন আপনি বেশি টাকা খরচ করেও পণ্য ক্রয় করতে দ্বিধাবোধ করেন না। এক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতি (ইনফ্লেশন) ঘটে থাকে। জিম্বাবুয়ের মূল্যস্ফীতির কথা অনেকেই জানেন। আবার আপনার কাছে যখন টাকার পরিমাণ কম থাকে তখন ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পায়। ফলে উৎপাদনকারী প্রকৃত মূল্য পায় না। এমনকি অনেক সময় উৎপাদন খরচও পায় না উৎপাদক। এক্ষেত্রে মূল্যসংকোচন (ডিফ্লেশন) ঘটে থাকে। একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ মূল্যস্ফীতি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য সহায়ক। স্থবির এ সময়ে বাজারে যদি টাকার পরিমাণ কমে যায় তাহলে মূল্যসংকোচন হবে যা প্রবৃদ্ধির অন্তরায়।
অনেকেই ভাবছেন অর্থনীতিতে টাকা সরবরাহ মূল্যস্ফীতি বাড়িয়ে দিতে পারে। মোটেও তা নয়। ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যেতে পারে।
১৯৩০-এর মহামন্দার কথা বিবেচনা করা যেতে পারে। অনেক অর্থনীতিবিদ ঐ মন্দাকে ভয়াবহ রূপ দেওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সমালোচনা করেছেন। তাদের মতে মন্দার কারণে যে মূল্যসংকোচন (ডিফ্লেশন) তৈরি হয়েছিল তা মোকাবিলা করার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকটি পর্যাপ্ত অর্থ বাজারে সরবরাহ করেনি। ১৯২৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যসংকোচন হয় ১ শতাংশের কাছাকাছি । ১৯৩২ সালে মূল্যসংকোচন গিয়ে ঠেকে প্রায় ১১ শতাংশে। অর্থাৎ, যে পণ্যটি উৎপাদন করতে ১০০ টাকা খরচ হয়েছে সেটির বাজারমূল্য ৮৯ টাকা।
এই মন্দা থেকে বের হয়ে আসার জন্য ১৯৩৩ সালে একজন ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ বাজারে ব্যাপকভাবে টাকা সরবরাহ করার পরামর্শ দেন। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। ১৯৩৪-৩৫ সালের দিকে যুক্তরাষ্ট্র সরকার বাজারে ব্যাপকভাবে টাকা সরবরাহ করার নীতি প্রয়োগ শুরু করে। ১৯৩৯ সালের দিকে মন্দার রেশ কমলেও এর প্রকোপ পুরোপুরি বন্ধ হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর। ২০০৭ সালে শুরু হওয়া মহামন্দার পরিস্থিতিতে মন্দা আক্রান্ত প্রত্যেকটি দেশও ব্যাপকভাবে বাজারে টাকা সরবরাহ করে।
আমাদের দেশের বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান তাদের এমপ্লয়িদের বেতন কমিয়েছে। এটা যেমন এমপ্লয়ির জন্য হতাশাজনক তেমনি বাজার অর্থনীতির জন্য মোটেও সুখকর নয়। আশা করি প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের এমপ্লয়িদের বেতন পূর্বের অবস্থানে ফিরিয়ে নিয়ে যাবেন বাজার অর্থনীতি যাতে সংকুচিত না হয়ে যায়। প্রতিষ্ঠান সবসময় লাভজনক থাকবে এমন তো নয়। মাঝে মাঝে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে লসও করতে পারে।
লেখক : মনিরুল হায়দার পিনু, জয়েন্ট ডিরেক্টর, বাংলাদেশ ব্যাংক।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।