মানুষ হিসেবে কেমন ছিলেন আলফ্রেড নোবেল? যিনি একাধারে একের পর এক বিস্ফোরক ও যুদ্ধাস্ত্রের উপাদান আবিষ্কার করেছেন, সারা ইউরোপে বিরাট বিরাট কারখানা গড়ে তুলে কাড়ি কাড়ি অর্থ উপার্জন করেছেন, কিন্তু জীবন-যাপন করেছেন একাকি, নিরাসক্ত। জীবনে কোনোদিন ধূমপান করেননি, মদ পান করেননি, এমন কি বিয়েও করেননি। তেমন কোনো বন্ধুবান্ধবও ছিল না আলফ্রেড নোবেলের।
প্রথম জীবনে কবি হতে চেয়েছিলেন—অনেক কবিতাও লিখেছিলেন। প্রেম ছিল সেসব কবিতায়, ক্ষোভও ছিল। কিন্তু কোনো রচনাই তিনি প্রকাশ করেননি। অন্তর্মুখী এই মানুষটি একদিকে শক্তহাতে ইন্ডাস্ট্রি ও ব্যবসা সামলেছেন, অন্যদিকে নিরলস গবেষণায় আবিষ্কার করেছেন একের পর এক নতুন বিস্ফোরক। কিন্তু তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের চারপাশে একটা অদৃশ্য দেয়াল তুলে রেখেছিলেন—যে দেয়াল ভেদ করে তাঁর মনের খোঁজ পাওয়া সম্ভব ছিল না কারোরই। হাতে গোনা যে কজন মানুষের কাছে কিছু ব্যক্তিগত চিঠিপত্র লিখেছিলেন, তাও তাঁর মৃত্যুর পর প্রায় পঞ্চাশ বছর পর্যন্ত গোপন করে রেখেছিল নোবেল ফাউন্ডেশন।
আলফ্রেড নোবেল তাঁর প্রত্যেকটি চিঠির কপি রাখতেন, একান্ত ব্যক্তিগত চিঠিরও। নোবেল ফাউন্ডেশনের আর্কাইভে আছে তাঁর হাতে লেখা অনেক চিঠি। প্রত্যেকটি চিঠিতে তাঁর নিজের হাতে ক্রমিক নম্বর দেওয়া। ১৯৫০ সালে তাঁর ব্যক্তিগত চিঠিপত্রগুলো প্রকাশ্যে আসার পর আলফ্রেড নোবেলের ব্যক্তিগত ভাবনা-চিন্তাগুলোর কিছু দিক উন্মোচিত হয়। ফরাসি লেখক ভিক্টর হুগো আলফ্রেড নোবেলের নাম দিয়েছিলেন ‘দি ওয়েলদিয়েস্ট ভ্যাগাবন্ড ইন ইউরোপ’। নোবেলের চিঠিগুলো থেকে কিছুটা হলেও দেখা যায় তৎকালীন ইউরোপের সবচেয়ে ধনী এই চিরকুমার ‘ভবঘুরে’র ব্যক্তিগত জীবনের কিছু দিক।
নোবেলদের পূর্বপুরুষরা ছিলেন নোবেলিয়াস পদবীভুক্ত দরিদ্র কৃষক। আলফ্রেডের ঠাকুরদা নিজের চেষ্টায় নাপিতের কাজ শিখেছিলেন। ক্ষৌরকর্মের পাশাপাশি তিনি ছোটখাটো অস্ত্রোপচারও করতেন। ১৭৭৫ সালে নিজের পদবী নোবেলিয়াসের অর্ধেক ছেঁটে ফেলে ‘নোবেল’ করে নেন। তাঁর বড় ছেলে ইমানুয়েল—আলফ্রেড নোবেলের বাবা।
আলফ্রেড নোবেল জীবনে কখনো কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়েননি। বাড়িতেই তাঁর লেখাপড়া। অন্তর্মুখী হওয়ার কারণে বেশির ভাগ সময় পড়াশোনাতেই কাটে। রাসায়নিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার প্রতি রয়েছে বিশেষ আগ্রহ। বাবার কারখানায় নানারকম পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণ দেখতে দেখতে বেড়ে ওঠার পাশাপাশি নিজেরও অনেক নতুন আইডিয়া দানা বাঁধতে শুরু করেছে। কিন্তু তার চেয়েও বেশি ভালো লাগে সাহিত্য। সতের হবার আগেই সুইডিশ, রাশিয়ান, জার্মান, ইংরেজি ও ফরাসি ভাষায় অনর্গল কথা বলতে ও লিখতে শিখে গেলেন আলফ্রেড। লিখতে শুরু করলেন কবিতা। মনে মনে ঠিক করে ফেলেছেন, লেখকই হবেন।
এদিকে তরুণ আলফ্রেড নিজের পড়াশোনা, কারখানার ল্যাবরেটরিতে নাইট্রোগ্লিসারিন নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষায় ব্যস্ত। মাঝে মাঝে কবিতা লিখতে চেষ্টা করেন। কবিতায় প্রেম আর স্বপ্নের মাখামাখি। অন্তর্মুখী আলফ্রেড ভালোবেসে ফেলেছেন একজন ফার্মাসিউটিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট রাশিয়ান তরুণীকে।
কিন্তু ভালোবাসার কথা কবিতায় প্রকাশ পেলেও মুখ ফুটে বলতে পারেন না ভালোবাসার মানুষকে। দুর্বল স্বাস্থ্য, মাঝারি উচ্চতার আলফ্রেডের দুঃখী দুঃখী মুখ দেখে ভালোবাসা বোঝা সহজ নয়। আলফ্রেডের ভালোবাসা ঠিকমতো গতি পাবার আগেই এক দুঃখজনক পরিণতিতে পৌঁছে যায়। যক্ষারোগে ভুগে মেয়েটি মারা যায়। গভীর অবসাদে ডুবে যান তেইশ বছর বয়সী আলফ্রেড নোবেল।
ব্যক্তিগত ও সামাজিক অনুষ্ঠান বলতে কিছুই নেই তাঁর। যা আছে সবই ব্যবসায়িক। এত কাজ করেন কাজের তাগিদেই। যেমন ব্যবসার কাজে উকিলের সঙ্গে কথা বলতে হয়। কিন্তু উকিল সম্প্রদায়ের প্রতি তাঁর ব্যক্তিগত শ্রদ্ধা শূন্যের কোঠায়। তিনি মনে করেন, উকিলরা তাঁদের পেশার খাতিরে পৃথিবীর সবাইকেই অসৎ ভাবেন।
প্যারিসে বাস করলেও ফ্রান্সকে নিজের দেশ ভাবতে পারেন না আলফ্রেড। কোনো নির্দিষ্ট দেশকেই তাঁর নিজের দেশ বলে মনে হয় না। পৃথিবীর অনেক দেশেই তাঁর বাড়ি থাকলেও কোনো বাড়িকেই নিজের বাড়ি মনে করতে পারেন না। তিনি মনে করেন, ‘আমার বাড়ি হলো সেখানেই, যেখানে বসে আমি কাজ করি। আর আমি সবখানেই কাজ করি।’
কাজের সাফল্যে আলফ্রেড নোবেলকে উচ্ছ্বসিত হতে যেমন কেউ কখনো দেখেননি, ব্যর্থতায় ভেঙে পড়তেও কখনো দেখা যায়নি। এ যেন কাজের জন্যই কাজ করা। বন্ধুহীন, সঙ্গীহীন, একাকি জীবনযাপনে অভ্যস্ত আলফ্রেড পুরো পৃথিবীর প্রতিই এক ধরনের বিতৃষ্ণভাব পোষণ করতেন। রাজনৈতিকভাবে সমাজতন্ত্রের প্রতি সামান্য সমর্থন থাকলেও নিজের ধনবাদী অবস্থান থেকে নড়তে রাজি ছিলেন না কখনোই।
রাজনৈতিক গণতন্ত্রের প্রতিও বিশ্বাস ছিল না তাঁর। জনগণ সমষ্টিগতভাবে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে বলে মনে করতেন না তিনি। নিজের পড়াশোনা ও ভাবনা-চিন্তার গভীরতার ওপর যথেষ্ট বিশ্বাস ছিল। তিনি যে প্রচুর সম্পদের মালিক এবং এ সম্পদ যে তাঁকে অনেক বেশি ক্ষমতাবান করে তুলেছে তা তিনি ভালো করেই জানতেন। জানতেন বলেই সাধারণ মানুষের সঙ্গে একটা দূরত্ব তিনি বরাবরই রক্ষা করে চলতেন।
শরীর তাঁর কোনোদিনই খুব ভাল ছিল না। সারাক্ষণই কোনো না কোনো শারীরিক সমস্যা লেগেই থাকে। নিজের ভেতর একধরনের হীনমন্যতা বাসা বেঁধেছে। নিজেকে খুবই অনাকর্ষণীয় মনে করেন। ভালোবাসাহীন শারীরিক সম্পর্কের প্রতি কোনো আকর্ষণ নেই তাঁর। সেই প্রথম যৌবন থেকে অপেক্ষা করছেন, কখন তাঁর ভালোবাসার মানুষের সঙ্গে দেখা হবে।
যে রাশিয়ান মেয়েটির প্রেমে পড়েছিলেন, সেই প্রেম বিকশিত হবার আগেই মেয়েটির মৃত্যু হয়েছে। তারপর কেটে গেছে ২৩ বছর। আলফ্রেড সেরকম আর কোনো মেয়ের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করেননি এত বছরেও। অবশ্য ভালোবাসা পাবার জন্য যেটুকু সময় সামাজিক মেলামেশায় কাটানো দরকার, তার কিছুই করেননি তিনি। মনের মধ্যে তিনি একটা ধারণা ক্রমাগত বাড়িয়ে চলেছেন—তাঁকে কোনো মেয়ে ভালবাসবে না, কারণ মেয়েদের আকৃষ্ট করার মতো কোনোকিছুই নেই তাঁর মধ্যে।
১৮৭৬ সালে আলফ্রেড ভিয়েনায় গিয়েছিলেন কাজে। শহরটাকে বেশ ভালোই লাগে তাঁর। ভিয়েনার হোটেলে বসেই কিছুদিন কাজকর্ম চালিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। কাজ করতে করতে নিজেকে বড় একাকি বড় বুড়ো মনে হচ্ছে তাঁর। নিজের কাজকর্মে সাহায্য করার জন্য একজন লোক রেখেছেন কিছুদিন হলো। কিন্তু তাঁকে দিয়ে সবকিছু সামলানো যাচ্ছে না। মনে হলো এই ভিয়েনায় থেকে এমন কাউকে খুঁজে নেওয়া যায় যে তাঁর ব্যক্তিগত সহকারী থেকে বন্ধুও হয়ে যেতে পারে কোনো এক সময়।
অনেক ভেবেচিন্তে সংবাদপত্রের ‘আবশ্যক’ পাতায় একটা বিজ্ঞাপন দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। ভিয়েনার সংবাদপত্রে প্রকাশিত হলো সেই বিজ্ঞাপন—‘প্যারিসে বসবাসরত ধনী, উচ্চশিক্ষিত, সংস্কৃতিবান, বয়স্ক ভদ্রলোকের প্যারিসের বাড়ির তত্ত্বাবধায়ক এবং ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে কাজ করার জন্য একাধিক ভাষায় পারদর্শী বয়স্কা মহিলা আবশ্যক।’
আলফ্রেড নোবেলের এই কথায় আর যাই হোক, যুদ্ধ বন্ধের জন্য তাঁর কারখানা বন্ধ করে দেওয়ার কোনো ইঙ্গিত ছিল না। মারণাস্ত্র তৈরি করাই যে উচিৎ নয়, তা তিনি উপলব্ধি করেননি কখনো। তাই তো তিনি ব্যবসা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ১৮৯৩ সালে ৬০ বছর বয়সে সুইডেনের বোফোর্স অস্ত্র কারখানা কিনে নেন। রেগনার সলম্যান নামে এক প্রকৌশলীকে দায়িত্ব দেন এই অস্ত্র কারখানার তত্ত্বাবধান করার জন্য। এই রেগনার সলম্যানই ছিলেন নোবেলের মৃত্যুর পর তাঁর উইলের নির্বাহী ব্যবস্থাপক।
নোবেল পুরষ্কার চালু হবার পর কেটে গেছে একশ বছরেরও বেশি। এই একশ বছরে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নোবেল পুরষ্কারের চেয়েও বেশি অর্থমূল্যের আরও অনেক পুরষ্কার চালু হয়েছে পৃথিবীতে, কিন্তু মর্যাদার দিক থেকে নোবেল পুরষ্কারকে ছাড়িয়ে যেতে পারেনি কোনোটিই। নোবেল পুরষ্কার এখন শুধু ব্যক্তিগত নয়, অনেক দেশের রাষ্ট্রীয় মর্যাদারও প্রতীক। আলফ্রেড নোবেলকে কেউ আর ‘মৃত্যুর কারবারি’ মনে করেন না। যে নোবেল নিজেকে ভালোবাসার অযোগ্য মনে করতেন, নোবেল পুরষ্কারের মধ্য দিয়ে তিনি সবার ভালোবাসা পেয়েই চলেছেন।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।