বিমানবন্দরের গেটে দাঁড়িয়ে। পিছনে ফেলে আসা প্রিয়জনের করুণ দৃষ্টি। সামনে অপেক্ষমাণ অচেনা ভূখণ্ডের রোমাঞ্চ। বিদেশ যাত্রার এই মুহূর্তগুলো কতটা আবেগঘন, কতটা স্বপ্নিল! কিন্তু হঠাৎই মনে পড়ে যায় – পাসপোর্টটা তো চেক করিনি শেষবারের মতো? ভিসার তারিখ ঠিক আছে তো? ওষুধের প্রেসক্রিপশন গুছিয়ে নিয়েছি তো? হৃদয়ে তখন উৎসবের বদলে নামে এক ধরনের অনিশ্চিত আতঙ্ক। কারণ, বিদেশ ভ্রমণের আগে করণীয় বিষয়ে সামান্য একটু অবহেলা, একটু অসতর্কতাই আপনার বহু কষ্টার্জিত স্বপ্নভ্রমণটিকে দুঃস্বপ্নে পরিণত করতে পারে। সারা বছর, কখনো বা সারা জীবনের সঞ্চয় ঢেলে দেওয়া সেই অভিজ্ঞতাকে সত্যিকার অর্থে স্মরণীয়, নিরাপদ ও অনাবিল আনন্দে ভরিয়ে তুলতে যা কিছু জরুরি, সবকিছুরই একটি পুঙ্খানুপুঙ্খ গাইডলাইনই এই লেখার উদ্দেশ্য। শুধু টিকিট কাটা বা ব্যাগ গোছানো নয়, ভ্রমণ সত্যিকার অর্থে সফল করতে গেলে যা কিছু অত্যাবশ্যক, চলুন ডুব দেই সেই প্রস্তুতির গভীরে।
বিদেশ ভ্রমণের আগে করণীয়: কাগজপত্রের নিরবিচ্ছিন্ন প্রস্তুতি (The Non-Negotiables: Documents)
কাগজপত্র – এটাই আপনার বিদেশ যাত্রার সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র এবং সবচেয়ে বড় দুর্বলতার জায়গাও বটে। একটু ভুল, একটু অসতর্কতা, এবং আপনি আটকে যেতে পারেন বিমানবন্দরেই, স্বপ্নভঙ্গের গ্লানি নিয়ে ফিরে আসতে হতে পারে বাড়িতে। তাই এই বিভাগে কোন আপস নেই, কোন ছাড় নেই।
- পাসপোর্ট: আপনার পরিচয়ের মূল ভিত্তি: এটি শুধু একটি বই নয়, এটি আপনার জাতীয়তার প্রতীক, বিদেশে আপনার একমাত্র আইনি পরিচয়পত্র।
- মেয়াদ শেষ হওয়ার তারিখ: এটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ! শুধু ভ্রমণের সময়টুকু নয়, অনেক দেশই চায় যে আপনার পাসপোর্টের মেয়াদ ফেরত আসার পরিকল্পিত তারিখের অন্তত ৬ মাস অবশিষ্ট থাকবে। উদাহরণস্বরূপ, আপনি যদি ৩০ জুন, ২০২৫ তারিখে বাংলাদেশে ফিরে আসার পরিকল্পনা করেন, তাহলে আপনার পাসপোর্টের মেয়াদ অন্তত ৩১ ডিসেম্বর, ২০২৫ বা তার পরের কোন তারিখ পর্যন্ত থাকতে হবে। এই নিয়মের ব্যতিক্রম খুবই কম। মেয়াদ শেষ হওয়ার কাছাকাছি থাকলে অবিলম্বে পাসপোর্ট নবায়নের জন্য আবেদন করুন। ঢাকা বা আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে যেতে হবে। প্রক্রিয়া সময়সাপেক্ষ হতে পারে, তাই দেরি করবেন না। বাংলাদেশ পাসপোর্ট অফিসের ওয়েবসাইট (https://www.passport.gov.bd/) থেকে সর্বশেষ তথ্য ও আবেদন পদ্ধতি জেনে নিন।
- পর্যাপ্ত ফাঁকা পৃষ্ঠা: অনেক দেশের ভিসার জন্য নির্দিষ্ট সংখ্যক ফাঁকা পৃষ্ঠা (সাধারণত দুটি) প্রয়োজন হয়। ইমিগ্রেশনে স্ট্যাম্প লাগার জায়গাও দরকার। পুরনো পাসপোর্টে জায়গা না থাকলে নবায়ন জরুরি।
- দশা পরীক্ষা: পাসপোর্টটি ভালোভাবে পরীক্ষা করুন। কোন পৃষ্ঠা ছিঁড়ে গেছে, পানিতে ভিজে নষ্ট হয়েছে, গুরুত্বপূর্ণ তথ্য অস্পষ্ট হয়েছে কিনা? এমন কোন ক্ষতি থাকলে তা ভিসা বা ইমিগ্রেশনে সমস্যার কারণ হতে পারে। মূল পাসপোর্টের কয়েকটি ফটোকপি (হালনাগাদ) এবং সফট কপি (ইমেইল/ক্লাউডে সংরক্ষিত) রাখুন অত্যাবশ্যক। কপিগুলো ভিন্ন ব্যাগে রাখুন। এটা হারালে বা চুরি গেলে উদ্ধারে সহায়ক হবে।
- ভিসা: প্রবেশের অনুমতিপত্র: পাসপortের পরেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আইটেম।
- ধরন ও বৈধতা: আপনি যে ধরনের ভিসা পেয়েছেন (ট্যুরিস্ট, স্টুডেন্ট, বিজনেস, মেডিকেল ইত্যাদি) তা নিশ্চিত করুন। ভিসার শুরু হওয়ার তারিখ (Valid From) এবং শেষ হওয়ার তারিখ (Valid Until) বারবার চেক করুন। অনেকের ভুল হয় শুধু শেষ তারিখ দেখে, কিন্তু ভিসা কার্যকর হওয়ার আগে গেলে প্রবেশে সমস্যা হবে।
- প্রবেশের সংখ্যা (Entries): ভিসায় লেখা থাকে Single Entry (একবার প্রবেশ), Double Entry (দুইবার প্রবেশ), বা Multiple Entry (একাধিকবার প্রবেশ)। আপনার ভ্রমণ পরিকল্পনা এর সাথে মিলছে তো? যদি একবার দেশ থেকে বের হয়ে আবার ফিরে আসার প্রয়োজন পড়ে (যেমন, প্রতিবেশী দেশ ভ্রমণ), তাহলে Multiple Entry ভিসা না থাকলে সমস্যা হবে।
- বাসস্থানের শর্ত: কিছু ভিসায় (বিশেষ করে শেঙেন ভিসা) আপনার গন্তব্য দেশে থাকার প্রথম ঠিকানা জমা দিতে হয়। পরে পরিবর্তন করলেও, আগে উল্লেখিত হোটেল বা হোস্টের ঠিকানা এবং যোগাযোগের নম্বর হাতে রাখুন, ইমিগ্রেশনে জিজ্ঞাসা হতে পারে।
- ভিসা প্রিন্টআউট: ই-ভিসা বা ভিসা স্টিকার ফটোকপি সহ মূল কাগজটি খুব যত্নে রাখুন। অনেক এয়ারলাইন্স চেক-ইন বা বোর্ডিংয়ের সময় ভিসা দেখতে চায়।
- এয়ার টিকিট ও থাকার বুকিং: শুধু টিকিট কাটলেই হয় না, নিশ্চিত করতে হবে:
- নামের বানান: টিকিটে আপনার নাম পাসপোর্টে উল্লিখিত নামের সাথে হুবহু মিলছে কিনা? সামান্য ভুল (যেমন, ‘Rahman’ এর জায়গায় ‘Rahaman’) বিমানে উঠতে বাধা সৃষ্টি করতে পারে। সঙ্গে থাকুন বুকিং কনফার্মেশন (ইমেইল বা প্রিন্ট)।
- ফেরতের টিকিট (Return Ticket/Onward Ticket): অধিকাংশ দেশের ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ প্রমাণ চাইবে যে আপনি দেশ ছেড়ে যাবেন। আপনার ফেরতের টিকিট বা পরবর্তী গন্তব্যের টিকিট (যদি থাকে) হাতের কাছে রাখুন, প্রিন্ট কপি ভালো। অনেকেই শুধু ইমেইলে রাখেন, কিন্তু মোবাইল ব্যাটারি ফুরিয়ে গেলে বা নেটওয়ার্ক সমস্যায় পড়তে পারেন।
- বাসস্থানের প্রমাণ: হোটেল বুকিং কনফার্মেশন বা হোস্টের আমন্ত্রণপত্র (যেখানে ঠিকানা ও যোগাযোগের নম্বর স্পষ্ট) প্রিন্ট করে রাখুন। ইমিগ্রেশনে জিজ্ঞাসা করা খুবই সাধারণ।
- অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র:
- ভ্রমণ বীমা: শুধু ভিসার জন্য নয়, আপনার নিরাপত্তার জন্য অপরিহার্য। পলিসি নম্বর, কভারেজের বিবরণ (বিশেষ করে মেডিকেল ইমার্জেন্সি, রিপ্যাট্রিয়েশন), এবং জরুরি যোগাযোগের নম্বর সহ প্রিন্ট কপি সবসময় সঙ্গে রাখুন। বীমা সার্টিফিকেটের কপি ভিসা আবেদনের সময়ও প্রায়ই চাওয়া হয়।
- ভ্যাকসিন সার্টিফিকেট (যদি প্রযোজ্য): ইয়েলো ফিভার বা অন্য কোন নির্দিষ্ট রোগের ভ্যাকসিন সার্টিফিকেট (প্রায়শই ‘ইয়েলো বুক’ বা আন্তর্জাতিক সনদপত্র) গন্তব্য দেশের আইনে বাধ্যতামূলক হতে পারে। কোভিড-১৯ সংক্রান্ত সর্বশেষ নিয়ম (ভ্যাকসিনেশন প্রুফ, টেস্ট রিপোর্ট) গন্তব্য দেশ, এয়ারলাইন এবং ট্রানজিট দেশের ওয়েবসাইট থেকে যাত্রার ঠিক আগেই নিশ্চিত করুন, নিয়ম দ্রুত বদলায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) ট্রাভেল অ্যাডভাইজরি (https://www.who.int/emergencies/diseases/novel-coronavirus-2019/travel-advice) এবং IATA ট্র্যাভেল সেন্টার (https://www.iatatravelcentre.com/world.php) ভালো রিসোর্স, তবে সর্বশেষ তথ্য সরাসরি সংশ্লিষ্ট দেশের দূতাবাস/ইমিগ্রেশন সাইট থেকে নিন।
- ড্রাইভিং লাইসেন্স ও আন্তর্জাতিক ড্রাইভিং পারমিট (IDP): যদি বিদেশে গাড়ি চালানোর পরিকল্পনা থাকে, তাহলে আপনার বাংলাদেশী ড্রাইভিং লাইসেন্সের সাথে আন্তর্জাতিক ড্রাইভিং পারমিট (IDP) প্রয়োজন হবে। IDP বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (BRTA) থেকে সংগ্রহ করতে হয়। আগে থেকে আবেদন করুন।
- জরুরি যোগাযোগ তথ্য: বাংলাদেশ দূতাবাস/হাইকমিশনের ফোন নম্বর, স্থানীয় জরুরি নম্বর (পুলিশ, অ্যাম্বুলেন্স, ফায়ার সার্ভিস), ভ্রমণ বীমার জরুরি নম্বর, এবং দেশে ও বিদেশে যোগাযোগের জন্য দু’জন জরুরি যোগাযোগের ব্যক্তির নাম ও নম্বর (ফোন ও ইমেইল) একটি কাগজে লিখে এবং ফোনে সংরক্ষণ করুন।
- প্রাসঙ্গিক চিঠিপত্র: শিক্ষার্থীদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের অফার লেটার, কর্মীদের জন্য নিযুক্তিপত্র বা ব্যবসায়িক আমন্ত্রণপত্র – যা আপনার ভ্রমণের উদ্দেশ্য প্রমাণ করে, তার কপি রাখুন।
সব কাগজপত্র একটি ওয়াটারপ্রুফ/শক্ত ফোল্ডারে গুছিয়ে রাখুন। মূল কাগজপত্র (পাসপোর্ট, ভিসা, টিকিট) সবসময় আপনার ব্যাগের নিরাপদ পকেটে (পাসপোর্ট হোল্ডারে) রাখুন। কপিগুলো আলাদাভাবে প্যাক করুন এবং একটি সেট আপনার সাথী (যদি থাকে) বা চেক-ইন ব্যাগে রাখুন। ডিজিটাল কপি ইমেইল করুন নিজের ঠিকানায় এবং একজন বিশ্বস্ত ব্যক্তির কাছে।
বিদেশ ভ্রমণের আগে করণীয়: স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও ওষুধপত্রের প্রস্তুতি (Health is Wealth)
বিদেশে অসুস্থ হওয়ার চিন্তাই যথেষ্ট ভয়ানক, বিশেষ করে যখন ভাষা, সংস্কৃতি এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থা আপনার অচেনা। সামান্য সর্দি-কাশিও যাত্রাকে দুর্বিষহ করে তুলতে পারে। তাই স্বাস্থ্য প্রস্তুতি কোনোভাবেই অবহেলা করার বিষয় নয়।
- চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ (Pre-Travel Consultation): যাত্রার কমপক্ষে ৪-৬ সপ্তাহ আগে একজন ট্রাভেল মেডিসিন বিশেষজ্ঞ বা আপনার পারিবারিক চিকিৎসকের সাথে দেখা করুন। কেন?
- গন্তব্যভিত্তিক ভ্যাকসিন: আপনার গন্তব্য দেশে কোন কোন রোগের প্রাদুর্ভাব আছে (যেমন: টাইফয়েড, হেপাটাইটিস-এ ও বি, জাপানিজ এনকেফালাইটিস, র্যাবিস, মেনিনজাইটিস ইত্যাদি), সে অনুযায়ী কোন ভ্যাকসিন নেওয়া প্রয়োজন বা বর্তমান ভ্যাকসিনগুলো হালনাগাদ করা দরকার কিনা তা নির্ধারণ করবেন ডাক্তার। কিছু ভ্যাকসিন (যেমন র্যাবিস বা ইয়েলো ফিভার) কয়েক ডোজে দেওয়া হয় এবং কাজ শুরু হতে সময় লাগে।
- স্বাস্থ্য সমস্যার পর্যালোচনা: আপনার কোন ক্রনিক রোগ (ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, অ্যাজমা, অ্যালার্জি ইত্যাদি) থাকলে, বিদেশে এর ব্যবস্থাপনা কী হবে, তা আলোচনা করুন। ডাক্তারের কাছ থেকে ইংরেজিতে একটি চিকিৎসা সংক্রান্ত সারাংশ (Medical Summary) নিন, যাতে রোগের বিবরণ, বর্তমান ওষুধের তালিকা (সাধারণ ও ব্র্যান্ড নাম, মাত্রা), এবং জরুরি অবস্থায় কী করা উচিত তা উল্লেখ থাকবে।
- ম্যালেরিয়া প্রতিরোধ: যদি ম্যালেরিয়া প্রবণ অঞ্চলে যাচ্ছেন, তাহলে প্রোফাইল্যাক্সিস (প্রতিরোধমূলক ওষুধ) সম্পর্কে জেনে নিন – কোন ওষুধ, কখন শুরু করতে হবে, কতদিন চলবে ইত্যাদি। মশা প্রতিরোধের ব্যবস্থাও (কীটনাশক, মশারি) জরুরি।
- ভ্রমণকালীন ডায়রিয়া ও অন্যান্য সাধারণ সমস্যা: ডাক্তার আপনাকে কিছু জরুরি ওষুধ (যেমন: ডায়রিয়ার ওষুধ, ইলেকট্রোলাইট পাউডার, ব্যথানাশক, জ্বরের ওষুধ, অ্যান্টিহিস্টামিন, মোশন সিকনেসের ওষুধ, অ্যান্টাসিড) প্রেসক্রাইব করতে পারেন এবং এর ব্যবহারবিধি বলে দেবেন।
- ওষুধপত্রের প্রস্তুতি:
- পর্যাপ্ত মজুদ: আপনার নিয়মিত যেসব ওষুধ খান, তার ভ্রমণের সময়ের চেয়ে অন্তত ৭-১০ দিন বেশি পরিমাণ নিয়ে নিন। ফ্লাইট বাতিল, ভিসা জটিলতা বা অন্য কোন কারণে দেরি হলে যেন সমস্যায় না পড়েন। ওষুধের মেয়াদও ভালোভাবে চেক করুন।
- মূল প্যাকেট ও প্রেসক্রিপশন: ওষুধগুলো মূল ফার্মেসির প্যাকেটে রাখুন, যাতে ওষুধের নাম, মাত্রা, ম্যানুফ্যাকচারারের নাম ইত্যাদি স্পষ্ট থাকে। সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশনের ফটোকপি বা ইংরেজি চিকিৎসা সারাংশ অবশ্যই রাখুন। এটি ইমিগ্রেশন বা কাস্টমস অফিসারদের জিজ্ঞাসাবাদের সময় খুবই গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে যদি ইনজেকশন বা কন্ট্রোল্ড সাবস্ট্যান্স (যেমন: কিছু ব্যথানাশক, সাইকিয়াট্রিক ওষুধ) নিয়ে যান। কিছু দেশে নির্দিষ্ট ওষুধ নিয়ে যাওয়া নিষিদ্ধ বা কঠোর নিয়ন্ত্রিত, আগে থেকে জেনে নিন (দেশের দূতাবাস বা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট চেক করুন)।
- হাতে-ব্যাগে রাখুন: অত্যাবশ্যকীয় ওষুধ (যেমন: হার্টের ওষুধ, ইনসুলিন, ইনহেলার) এবং জরুরি ওষুধ (ব্যথানাশক, অ্যান্টিহিস্টামিন, ডায়রিয়ার ওষুধ ইত্যাদি) হাতে-ব্যাগে (হ্যান্ড লাগেজে) রাখুন। চেক-ইন ব্যাগ হারিয়ে গেলেও যেন এগুলো হাতের কাছে থাকে।
- তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ: ইনসুলিন বা অন্য কোন ওষুধ যদি রেফ্রিজারেটরে রাখার প্রয়োজন হয়, তাহলে ভ্রমণের সময় তার ব্যবস্থা করুন (যেমন: ইনসুলিন কুলার ব্যাগ)। বিমানে হাতে-ব্যাগে রাখা যায় এমন কুলার ব্যাগ ব্যবহার করুন।
- প্রথম চিকিৎসা বাক্স (First Aid Kit): একটি ছোট, পোর্টেবল ফার্স্ট এইড কিট অমূল্য হতে পারে। এতে কী কী রাখবেন?
- প্লাস্টার (বিভিন্ন সাইজ), স্টেরিলাইজড গজ, ব্যান্ডেজ, অ্যান্টিসেপটিক ক্রিম/লোশন (যেমন: স্যাভলন, বিটাডিন)
- কাঁচি, টুইজার, থার্মোমিটার (ডিজিটাল)
- পেইন কিলার (প্যারাসিটামল, আইবুপ্রোফেন), অ্যান্টিহিস্টামিন ট্যাবলেট ও ক্রিম (অ্যালার্জির জন্য)
- ইলেকট্রোলাইট স্যালাইন (ওরস্যালাইন পাউডার), ডায়রিয়ার ওষুধ (লোপেরামাইড)
- মোশন সিকনেসের ওষুধ, অ্যান্টাসিড ট্যাবলেট
- মশা প্রতিরোধক ক্রিম/স্প্রে (ডিইইটিযুক্ত), সানস্ক্রিন (উচ্চ এসপিএফ), অ্যালোভেরা জেল (সানবার্নের জন্য)
- পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট (যদি প্রয়োজন মনে করেন)
- স্বাস্থ্যবিমা পুনঃনিশ্চিতকরণ: আপনার ভ্রমণ স্বাস্থ্যবিমার কভারেজ কী কী অন্তর্ভুক্ত করে, বিশেষ করে:
- ইমার্জেন্সি মেডিকেল ট্রিটমেন্টের সীমা কত?
- মেডিকেল ইভাকুয়েশন বা রিপ্যাট্রিয়েশন কভার করে কিনা?
- প্রি-এক্সিস্টিং কন্ডিশন (আপনার পূর্বের রোগ) কভার হয় কিনা? (অনেক পলিসিতে হয় না বা অতিরিক্ত প্রিমিয়াম লাগে)
- দন্ত চিকিৎসার জরুরি অবস্থা কভার করে কিনা?
- জরুরি নম্বরটি কোথায় কল করতে হবে? (২৪/৭ হেল্পলাইন)
পলিসি ডকুমেন্ট ভালো করে পড়ুন এবং প্রয়োজনীয় নম্বর ও ক্লেইম প্রসেস হাতের কাছে রাখুন।
স্বাস্থ্যই সম্পদ, বিদেশে তা আরও বেশি সত্য। সামান্য অসুস্থতাও যাতে বড় সমস্যায় না রূপ নেয়, তার জন্য এই প্রস্তুতিগুলো অপরিহার্য।
বিদেশ ভ্রমণের আগে করণীয়: আর্থিক প্রস্তুতি ও নিরাপত্তা (Managing Money & Security)
বিদেশে অর্থের যোগান ও নিরাপত্তা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। কারেন্সি বদল থেকে শুরু করে কার্ডের নিরাপত্তা – সবকিছুই আগে থেকে গুছিয়ে নেওয়া দরকার।
- কারেন্সি এক্সচেঞ্জ ও নগদ অর্থ:
- স্থানীয় মুদ্রার প্রাথমিক জোগান: গন্তব্যে পৌঁছানোর পরপরই আপনার কিছু খরচ হবে (যেমন: ট্যাকি, বাস, হালকা খাবার, টিপ)। তাই কিছু স্থানীয় নগদ মুদ্রা সঙ্গে নিয়ে যাওয়া জরুরি। বাংলাদেশে বৈধ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলার বা ব্যাংক থেকে বদল করুন। রিসিট রাখুন (কিছু দেশে এন্ট্রি/এক্সিটে বড় অংকের টাকা নিয়ে আসা-নেওয়ার রিসিট দেখাতে হতে পারে)।
- বিনিময় হার ও কমিশন: কোথায় বদল করলে ভালো রেট ও কম কমিশন পাওয়া যায়, তা খোঁজ নিন। বিমানবন্দরে এক্সচেঞ্জ কাউন্টারে রেট সাধারণত খারাপ হয়। কিছুটা বদল করুন এখানে, বাকিটা গন্তব্যে ভালো রেট পেলে বদলাবেন।
- নগদ সংরক্ষণ: সব নগদ এক জায়গায় রাখবেন না। বিভিন্ন ব্যাগে, মানিবেল্টে (waist pouch), বা নিরাপদ পকেটে ভাগ করে রাখুন। বড় অংকের নগদ সঙ্গে রাখা ঝুঁকিপূর্ণ।
- ডেবিট/ক্রেডিট কার্ড ও ট্রাভেল কার্ড:
- ব্যাংককে জানান: আপনি বিদেশ যাচ্ছেন এবং কোন কোন দেশে, কত তারিখ পর্যন্ত থাকবেন – এই তথ্য আগে থেকেই আপনার ব্যাংকে (ডেবিট/ক্রেডিট কার্ড ইস্যুকারী) জানিয়ে দিন। না জানালে তারা বিদেশী লেনদেন সন্দেহ করে কার্ড ব্লক করে দিতে পারে!
- আন্তর্জাতিক লেনদেন সক্ষমতা: নিশ্চিত করুন আপনার কার্ডটি বিদেশে এটিএম থেকে টাকা তোলা (Withdrawal) এবং পয়েন্ট অফ সেল (POS) মেশিনে পেমেন্টের জন্য সক্ষম (International Usage Enabled) আছে। এটিএম থেকে টাকা তোলার ফি এবং বিদেশী লেনদেন ফি (Foreign Transaction Fee – সাধারণত ২-৪%) কত, তা জেনে নিন। কিছু ক্রেডিট কার্ডে এই ফি ওয়েভ করা হয়, খোঁজ নিন।
- ট্রাভেল কার্ডের বিকল্প: প্রিপেইড ট্রাভেল কার্ড (যেমন: ট্রাভেলেক্স, ক্যালভার্ট, বা ব্যাংক ইস্যু করা কার্ড) একটি ভালো বিকল্প। নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা লোড করে নেওয়া যায়। হারালে বা চুরি গেলে মূল ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নিরাপদ থাকে। ফি কাঠামো বুঝে নিন।
- ব্যাকআপ কার্ড: অন্তত দুটি ভিন্ন ব্যাংকের কার্ড (একটি ক্রেডিট, একটি ডেবিট) বা একটি কার্ড ও একটি ট্রাভেল কার্ড নিন। সবকিছু এক কার্ডে নির্ভর করবেন না। আলাদা ব্যাগে রাখুন।
- কার্ডের জরুরি নম্বর: কার্ড হারালে বা চুরি গেলে ব্লক করার জন্য ব্যাংকের আন্তর্জাতিক কল-ফ্রি জরুরি নম্বর (সাধারণত কার্ডের পিছনে থাকে) নোট করে রাখুন বা ফোনে সেভ করুন। মূল কার্ড থেকে আলাদা রাখুন।
- অনলাইন/মোবাইল ব্যাংকিং প্রস্তুতি:
- অ্যাকাউন্ট অ্যাক্সেস: বিদেশ থেকে আপনার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট চেক করতে বা লেনদেন ট্র্যাক করতে মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাপ বা ইন্টারনেট ব্যাংকিং সেটআপ করুন। নিশ্চিত করুন লগইন ক্রেডেনশিয়ালস ঠিক আছে।
- মোবাইল ওয়ালেট: পেপ্যাল, স্ক্রিল বা অন্যান্য আন্তর্জাতিক ডিজিটাল ওয়ালেটে অ্যাকাউন্ট থাকলে, তা হালনাগাদ ও ফান্ডেড রাখুন। কিছু দেশে এগুলো ব্যবহার সহজ।
- মূল্যবান জিনিসপত্র ও নিরাপত্তা:
- অপ্রয়োজনীয় অলংকার: বিদেশ ভ্রমণে মূল্যবান গয়না পরা বা নিয়ে যাওয়া বুদ্ধিমানের কাজ নয়। এগুলো চুরির লক্ষ্যবস্তু হয়। খুব প্রয়োজনীয় হলে সস্তার বা সেন্টিমেন্টাল ভ্যালুর জিনিস রাখুন।
- ইলেকট্রনিক্স: ল্যাপটপ, ক্যামেরা, স্মার্টফোন – এগুলো বীমার আওতায় আছে কিনা চেক করুন। সিরিয়াল নম্বর নোট করে রাখুন। ফোন ও ল্যাপটপে পাসওয়ার্ড/পিন/বায়োমেট্রিক লক দিন।
- ব্যাগ নির্বাচন: শক্ত, কাটা-প্রতিরোধী (slash-proof) স্ট্র্যাপযুক্ত ব্যাকপ্যাক বা ক্রসবডি ব্যাগ নিরাপত্তার জন্য ভালো। চোরেরা সহজে কেটে নিতে পারবে না। জিপার সবসময় বন্ধ রাখুন।
- মানিবেল্ট বা নেক ওয়ালেট: পাসপোর্ট, নগদ অর্থ, কার্ড – এই অত্যাবশ্যকীয় জিনিসগুলো শরীরের সাথে লুকিয়ে রাখার জন্য মানিবেল্ট বা নেক ওয়ালেট খুব কার্যকর, বিশেষ করে ভিড় বা পাবলিক ট্রান্সপোর্টে।
- ফটোকপি ও ডিজিটাল ব্যাকআপ: পাসপোর্ট, ভিসা, টিকিট, বীমা, জরুরি যোগাযোগ নম্বর – সবকিছুর ফটোকপি আলাদা ব্যাগে রাখুন। ডিজিটাল কপি সুরক্ষিত ক্লাউড স্টোরেজে (গুগল ড্রাইভ, ড্রপবক্স) এবং নিজের ইমেইলে সেভ করুন।
- সচেতনতা: ভিড় এড়িয়ে চলুন। অপরিচিত কাউকে খুব বেশি বিশ্বাস করবেন না। ট্যাকি বা রাইড-শেয়ারিং সার্ভিস ব্যবহারে সতর্ক থাকুন (অফিশিয়াল অ্যাপ ব্যবহার করুন, গাড়ির নম্বর ম্যাচ করছে কিনা দেখুন)। আপনার পানীয় কখনও অ্যাটেন্ডেড রাখবেন না। হোটেলের সেফটি ডিপোজিট বক্স ব্যবহার করুন।
টাকা-পয়সা ও নিরাপত্তার বিষয়ে সামান্য অসতর্কতাই বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতি বা নিরাপত্তাহীনতার কারণ হতে পারে। সতর্কতা ও প্রস্তুতিই সুরক্ষার মূল চাবিকাঠি।
বিদেশ ভ্রমণের আগে করণীয়: যোগাযোগ, গ্যাজেট ও প্যাকিং (Stay Connected, Powered & Packed Smart)
আজকের ডিজিটাল যুগে বিদেশে যোগাযোগ ও গ্যাজেট চার্জ রাখা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। আর প্যাকিং তো এক বিজ্ঞান!
- মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেট:
- আন্তর্জাতিক রোমিং: আপনার বাংলাদেশী সিমের আন্তর্জাতিক রোমিং চালু আছে কিনা এবং তার খরচ কত (কল, এসএমএস, ডেটা) জেনে নিন। সাধারণত এটা খুব ব্যয়বহুল। বেশিরভাগ ভ্রমণকারীর জন্য এটি প্র্যাকটিক্যাল নয় শুধু জরুরি কলের ব্যাকআপ হিসেবে রাখা যায়।
- স্থানীয় সিম কার্ড: সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং সাশ্রয়ী উপায়। গন্তব্য দেশের বিমানবন্দরেই সাধারণত সিম বিক্রির কাউন্টার থাকে। পাসপোর্ট দেখিয়ে রেজিস্ট্রেশন করে নিতে হয়। বিভিন্ন ডেটা-কল প্যাকেজ পাওয়া যায়। আপনার প্রয়োজন অনুযায়ী নিন। আনলকড (SIM-free) ফোন নিশ্চিত করুন, নাহলে স্থানীয় সিম কাজ করবে না।
- ই-সিম (eSIM): আপনার ফোন যদি eSIM সাপোর্ট করে (নতুন আইফোন, পিক্সেল, গ্যালাক্সি মডেলগুলো করে), তাহলে আগে থেকেই একটি আন্তর্জাতিক ডেটা প্ল্যান কিনে নিতে পারেন (Airalo, Holafly ইত্যাদি অ্যাপ/ওয়েবসাইট থেকে)। বিমানবন্দরে পৌঁছেই ইন্টারনেট পেয়ে যাবেন, সিম বদলানোর ঝামেলা নেই। খুবই সুবিধাজনক।
- ওয়াই-ফাই ও অফলাইন ম্যাপস: হোটেল, ক্যাফে, পাবলিক স্পেসে ফ্রি/পেইড ওয়াই-ফাই পাবেন। গুগল ম্যাপসে আপনার গন্তব্যের অফলাইন ম্যাপ আগেই ডাউনলোড করে নিন। এতে ডেটা ছাড়াই নেভিগেট করতে পারবেন।
- পাওয়ার অ্যাডাপ্টার ও কনভার্টার:
- ভোল্টেজ ও সকেট: বাংলাদেশে আমরা ২২০-২৪০ ভোল্ট, টাইপ C, D, G, K সকেট ব্যবহার করি। গন্তব্য দেশে ভোল্টেজ (১১০ভি বা ২২০ভি) এবং সকেটের ধরন (যেমন: USA টাইপ A/B, UK টাইপ G, ইউরোপ টাইপ C/F, অস্ট্রেলিয়া টাইপ I) কী, তা জেনে নিন।
- অ্যাডাপ্টার: ভিন্ন ধরনের সকেটে প্লাগ লাগানোর জন্য ট্রাভেল অ্যাডাপ্টার প্রয়োজন। এটি শুধু প্লাগের ফর্ম ফ্যাক্টর বদলায়, ভোল্টেজ কনভার্ট করে না।
- কনভার্টার/ট্রান্সফরমার: যদি আপনার ডিভাইস শুধু ১১০-১২০ভোল্ট সাপোর্ট করে (চেক করুন ডিভাইসের লেবেলে – ‘Input: 100-240V’ লেখা থাকলে ইউনিভার্সাল, কোন কনভার্টার লাগবে না), এবং আপনি ২২০-২৪০ভোল্টের দেশে যান, তাহলে স্টেপ-ডাউন ভোল্টেজ কনভার্টার/ট্রান্সফরমার লাগবে। না হলে ডিভাইস পুড়ে যাবে! ল্যাপটপ, ফোন চার্জার, ক্যামেরা চার্জার সাধারণত ইউনিভার্সাল (১০০-২৪০ভি)। হেয়ার ড্রায়ার, স্ট্রেইটনার, ইলেকট্রিক শেভার প্রায়ই ১১০ভি বা ২২০ভি নির্দিষ্ট হয়, সতর্ক থাকুন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শুধু ট্রাভেল অ্যাডাপ্টারই যথেষ্ট, ভোল্টেজ কনভার্টার লাগে না যদি ডিভাইস ইউনিভার্সাল হয়।
- পাওয়ার ব্যাংক: দীর্ঘ দিনের ট্যুরে বা বাইরে থাকার সময় ফোন চার্জ রাখতে একটি ভালো ক্যাপাসিটির পাওয়ার ব্যাংক অপরিহার্য। বিমানে হাতে-ব্যাগে নেওয়া যায় (সাধারণত ১০০Wh বা ২৭০০০mAh পর্যন্ত অনুমোদিত, এয়ারলাইনের নিয়ম চেক করুন)।
- স্মার্ট প্যাকিং:
- ব্যাগেজ অ্যালাউন্স: আপনার এয়ারলাইনের চেক-ইন ব্যাগেজ ও হ্যান্ড ব্যাগেজের অনুমোদিত ওজন ও সাইজ লিমিট জেনে নিন। ওভারওয়েটের জন্য অনেক বেশি চার্জ দিতে হয়। একটি ছোট ভাঁজ করা ট্রলি ব্যাগ বা অতিরিক্ত টোট বাগ নিন (ফেরার সময় শপিংয়ের জন্য কাজে লাগবে)।
- পোশাক: গন্তব্যের আবহাওয়া, সংস্কৃতি এবং আপনার প্ল্যানড অ্যাক্টিভিটির কথা ভেবে পোশাক নির্বাচন করুন। লেয়ারিং সবচেয়ে ভালো কৌশল – হালকা জ্যাকেট, সোয়েটার, স্কার্ফ সহজে পরা-খোলা যায়। আরামদায়ক জুতো (হাঁটার জন্য) ভুলবেন না। কিছু দেশে ধর্মীয় স্থান বা রেস্টুরেন্টে নির্দিষ্ট ড্রেস কোড (যেমন: স্কার্ট/প্যান্ট নীচে হাঁটু ঢাকা, কাঁধ ঢাকা) মানতে হয়। “Less is more” নীতি মেনে চলুন। প্রয়োজন হলে ধুয়ে ফেলা যাবে।
- প্রয়োজনীয় জিনিস হাতে-ব্যাগে: অত্যাবশ্যকীয় ওষুধ, জরুরি কাগজপত্রের ফটোকপি, ১ সেট জামাকাপড়, টুথব্রাশ-পেস্ট, মেকআপের প্রয়োজনীয় সামগ্রী, ফোন চার্জার, পাওয়ার ব্যাংক, ইয়ারপ্লাগ, আইমাস্ক, হালকা স্ন্যাকস – এগুলো হাতে-ব্যাগে রাখুন। চেক-ইন ব্যাগ হারালে বা দেরি করলেও যেন আপনি প্রথম কয়েক ঘন্টা বা দিন কাটাতে পারেন।
- লিকুইড নিয়ম: হাতে-ব্যাগে লিকুইড, জেল, ক্রিম, স্প্রে ইত্যাদি ১০০মিলি/১০০গ্রামের ছোট ছোট বোতলে এবং সবকিছু এক লিটার আকারের ট্রান্সপারেন্ট জিপলক ব্যাগে রাখতে হবে। এটা এভিয়েশন সিকিউরিটির স্ট্যান্ডার্ড নিয়ম।
- লেবেল লাগানো: আপনার প্রতিটি ব্যাগের বাইরে এবং ভিতরে আপনার নাম, ফোন নম্বর, ইমেইল এবং বাংলাদেশের ঠিকানা (হোটেলের ঠিকানা নয়) লেখা লেবেল লাগান। ভিতরের লেবেলটা গুরুত্বপূর্ণ – বাইরেরটা ছিঁড়ে গেলেও।
স্মার্ট প্যাকিং মানে শুধু কম জিনিসপত্র নিয়ে যাওয়া নয়, বরং সঠিক জিনিসগুলো সঠিক জায়গায় গুছিয়ে নিয়ে যাওয়া।
বিদেশ ভ্রমণের আগে করণীয়: মানসিক ও সাংস্কৃতিক প্রস্তুতি (The Mindset & Cultural Bridge)
কাগজপত্র, স্বাস্থ্য, অর্থ – এসবের প্রস্তুতি নেওয়ার পাশাপাশি মানসিক ও সাংস্কৃতিক প্রস্তুতিও সমান গুরুত্বপূর্ণ। এটি আপনার অভিজ্ঞতাকে গভীরতর ও সমৃদ্ধ করবে।
- গবেষণা করুন (Do Your Homework):
- দেশ ও সংস্কৃতি: গন্তব্য দেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি, রীতিনীতি, ধর্মীয় বিশ্বাস, সামাজিক রীতি সম্পর্কে মৌলিক ধারণা নিন। স্থানীয় মানুষ কী পছন্দ করেন, কী অপছন্দ করেন? কোন আচরণ বা কথাবার্তা অশোভন বা অপমানজনক বলে গণ্য হতে পারে? (যেমন: থাইল্যান্ডে মাথা স্পর্শ করা, জাপানে প্রকাশ্যে জোরে নাক ঝাড়া, আরব দেশে বাম হাতে খাওয়া, অনেক দেশে জুতা পরে মন্দির/মসজিদে প্রবেশ)। সম্মান দেখানো শিখুন।
- স্থানীয় আইন: প্রতিটি দেশের নিজস্ব আইন-কানুন আছে। যা বাংলাদেশে সাধারণ বা গ্রহণযোগ্য, তা অন্য দেশে গুরুতর অপরাধ হতে পারে (যেমন: সিঙ্গাপুরে চুইংগাম বিক্রি/ব্যবহার নিষিদ্ধ, কিছু দেশে প্রকাশ্যে মদ্যপান নিষিদ্ধ, ড্রাগ সম্পর্কে কঠোর শাস্তি, জেব্রা ক্রসিং ছাড়া রাস্তা পারাপার, পাবলিক প্লেসে ধূমপান নিষেধ ইত্যাদি)। আইন অমান্যের পরিণতি ভয়াবহ হতে পারে। অজ্ঞতা কোনো অজুহাত নয়।
- স্থানীয় ভাষার কিছু শব্দ: “হ্যালো”, “ধন্যবাদ”, “দুঃখিত”, “কেমন আছেন?”, “কত টাকা?” – এ ধরনের মৌলিক বাক্য ও শব্দ শিখে নিলে স্থানীয় মানুষের সাথে যোগাযোগ সহজ হবে এবং তারা আপনার প্রচেষ্টার প্রশংসা করবে। একটি ছোট ফ্রেজবুক বা অ্যাপ রাখতে পারেন।
- বাস্তব প্রত্যাশা গড়ে তুলুন:
- ভ্রমণ গাইড বনাম বাস্তবতা: গাইডবুক বা ইনস্টাগ্রামে দেখানো ছবিগুলো সবসময় পুরো গল্প বলে না। প্রতিটি জায়গার নিজস্ব গতিবিধি, সমস্যা, এবং অগোছালো দিক আছে। বাস্তবতার সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়ার মানসিকতা রাখুন।
- নমনীয়তা: ভ্রমণে সবকিছু সবসময় পরিকল্পনা মতো হয় না। ফ্লাইট বাতিল, আবহাওয়া খারাপ, জায়গা বন্ধ পাওয়া – এসব ঘটতে পারে। নমনীয় হোন, বিকল্প পরিকল্পনা রাখুন এবং ছোটখাটো সমস্যায় মন খারাপ না করে সামনে এগিয়ে যান। মনে রাখবেন, অনেকসময় অপ্রত্যাশিত ঘটনাই সেরা স্মৃতির জন্ম দেয়!
- সহনশীলতা: ভিন্ন সংস্কৃতি, ভিন্ন খাদ্যাভ্যাস, ভিন্ন কাজের গতি – এসবের সাথে খাপ খাওয়াতে কিছুটা সময় লাগবে। ধৈর্য ধরুন। ভিন্নতাকে সম্মান করুন এবং শিখতে চেষ্টা করুন।
- নিরাপত্তা সচেতনতা (পুনর্ব্যক্ত): কোন এলাকা নিরাপদ, কোন এলাকায় রাতে যাওয়া ঠিক না, কোন ধরনের স্ক্যাম (যেমন: অতিরিক্ত দাম চাওয়া, জাল টিকিট, ‘ফ্রি’ গিফটের নামে ফাঁদ) চালু – তা সম্পর্কে ধারণা নিন। ট্রাভেল ফোরাম, ব্লগ বা সরকারি ট্রাভেল অ্যাডভাইজরি (যেমন: বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট) থেকে তথ্য সংগ্রহ করুন। গুটেন ইনস্টিংক্ট (অন্তর্দৃষ্টি) বিশ্বাস করুন – কিছু অস্বস্তিকর মনে হলে সেখান থেকে সরে আসুন।
- পরিবেশ ও স্থানীয়দের প্রতি শ্রদ্ধা: টেকসই ভ্রমণ (Sustainable Travel) চর্চা করুন। প্লাস্টিক বর্জন করুন, পানি অপচয় রোধ করুন, পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবহার করুন, স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সমর্থন করুন (স্থানীয় হোটেল, রেস্তোরাঁ, গাইড), ঐতিহাসিক স্থাপনা বা প্রাকৃতিক পরিবেশের ক্ষতি করবেন না, স্থানীয় রীতিনীতি মেনে চলুন। আপনি অতিথি, সেই অনুভূতি বজায় রাখুন।
মানসিক ও সাংস্কৃতিক প্রস্তুতি ছাড়া বিদেশ ভ্রমণ অসম্পূর্ণ। এটি আপনাকে শুধু পর্যটক নয়, একজন সম্মানিত অতিথি এবং বিশ্ব নাগরিক হিসেবে গ্রহণযোগ্য করে তুলবে।
বিদেশ ভ্রমণের আগে করণীয় বিষয়ক এই গভীর অনুসন্ধান কেবলমাত্র একটি চেকলিস্টের চেয়ে অনেক বেশি কিছু। এটি আপনার কষ্টার্জিত স্বপ্নভ্রমণটিকে ট্র্যাজেডিতে পরিণত হওয়া থেকে রক্ষা করার একটি সুরক্ষা বলয়, একে স্মরণীয় ও উজ্জ্বল করে তোলার একটি রোডম্যাপ। আপনার পাসপোর্ট, ভিসা, স্বাস্থ্য প্রস্তুতি, আর্থিক নিরাপত্তা, এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে, সাংস্কৃতিক সংবেদনশীলতা ও মানসিক প্রস্তুতির প্রতি সামান্যতম অবহেলা আপনার পুরো অভিজ্ঞতাকে ম্লান করে দিতে পারে। প্রতিটি ধাপে সতর্কতা ও পরিপূর্ণ প্রস্তুতিই আপনাকে অনাবিল আনন্দ ও নিরাপত্তার সাথে সেই বহুল প্রতীক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছে দেবে। এই পরামর্শগুলো কেবল গাইডলাইন নয়, অভিজ্ঞ ভ্রমণকারীদের কষ্টার্জিত জ্ঞান। তাই, আপনার ব্যাগ গোছানোর আগে, আপনার মানচিত্র দেখার আগে, একটু থামুন। এই জরুরি পরামর্শগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়ুন, প্রয়োজনে নোট করুন। আপনার যাত্রা হোক ঝামেলামুক্ত, নিরাপদ এবং ভরপুর আনন্দে সিক্ত। এখনই শুরু করুন আপনার প্রস্তুতি, আপনার অনন্য অভিযাত্রার জন্য একধাপ পা বাড়ান। শুভ যাত্রা!
জেনে রাখুন (FAQs)
প্রশ্ন: বিদেশ ভ্রমণের আগে পাসপোর্টে কতদিন মেয়াদ থাকা আবশ্যক?
- উত্তর: অধিকাংশ দেশের জন্য আপনার পাসপোর্টের মেয়াদ ফেরত আসার পরিকল্পিত তারিখের অন্তত ৬ মাস অবশিষ্ট থাকা বাধ্যতামূলক। উদাহরণস্বরূপ, ১লা ডিসেম্বর ফেরার পরিকল্পনা থাকলে পাসপোর্টের মেয়াদ অন্তত ১লা জুন বা তার পরের কোনো তারিখ পর্যন্ত থাকতে হবে। ভ্রমণের আগে অবশ্যই আপনার গন্তব্য দেশের দূতাবাস বা ইমিগ্রেশন ওয়েবসাইটে এই নিয়মটি ডবল-চেক করে নিন, খুব অল্প কিছু দেশে ভিন্ন নিয়ম থাকতে পারে।
প্রশ্ন: বিদেশ যাওয়ার আগে কী ধরনের ভ্যাকসিন নেওয়া উচিত?
- উত্তর: প্রয়োজনীয় ভ্যাকসিন নির্ভর করে আপনার গন্তব্য দেশ, সেখানকার বর্তমান স্বাস্থ্য পরিস্থিতি, আপনার আগের ভ্যাকসিনেশনের ইতিহাস এবং স্বাস্থ্যের উপর। সাধারণত টাইফয়েড, হেপাটাইটিস-এ ও বি, টিটেনাস-ডিপথেরিয়া গুরুত্বপূর্ণ। আফ্রিকা বা দক্ষিণ আমেরিকার কিছু অংশে ইয়েলো ফিভার ভ্যাকসিন বাধ্যতামূলক। ম্যালেরিয়া প্রতিরোধের ওষুধও লাগতে পারে। যাত্রার ৪-৬ সপ্তাহ আগে একজন ট্রাভেল মেডিসিন বিশেষজ্ঞের সাথে পরামর্শ করে নেওয়াই সবচেয়ে ভালো।
প্রশ্ন: বিদেশে টাকা নিয়ে যাওয়ার সেরা উপায় কী?
- উত্তর: সবচেয়ে সুবিধাজনক এবং নিরাপদ উপায় হলো ডেবিট/ক্রেডিট কার্ড বা প্রিপেইড ট্রাভেল কার্ড ব্যবহার করা। বিমানবন্দর বা শহরে এটিএম থেকে স্থানীয় মুদ্রা তোলা যায়। সাথে সীমিত পরিমাণ স্থানীয় নগদ মুদ্রা (প্রাথমিক খরচের জন্য) এবং কিছু ইমার্জেন্সি ইউএস ডলার রাখুন। নগদ টাকা বিভিন্ন জায়গায় (মানিবেল্ট, ব্যাগ) ভাগ করে রাখুন। ভ্রমণের আগে আপনার ব্যাংককে বিদেশ যাওয়ার তথ্য জানাতে ভুলবেন না।
প্রশ্ন: বিদেশে ফোন ও ইন্টারনেট ব্যবহারের সাশ্রয়ী উপায় কী?
- উত্তর: বাংলাদেশী সিমের রোমিং সাধারণত খুব ব্যয়বহুল। সবচেয়ে সাশ্রয়ী উপায় হলো গন্তব্যে পৌঁছে স্থানীয় প্রিপেইড সিম কার্ড কেনা (পাসপোর্ট দিয়ে রেজিস্ট্রেশন প্রয়োজন)। যদি আপনার ফোন eSIM সাপোর্ট করে, তাহলে Airalo বা Holafly এর মতো সার্ভিস থেকে আগে থেকেই ই-সিম (eSIM) কিনে নিতে পারেন। হোটেল বা ক্যাফেতে ফ্রি/পেইড ওয়াই-ফাই ব্যবহার করুন। গুগল ম্যাপসের অফলাইন ম্যাপ আগে ডাউনলোড করে নিন।
প্রশ্ন: বিদেশ ভ্রমণের স্বাস্থ্য বীমা কতটা জরুরি?
- উত্তর: অত্যন্ত জরুরি, এবং অনেক দেশের ভিসার জন্যও বাধ্যতামূলক। বিদেশে চিকিৎসা ব্যয় অত্যন্ত উচ্চ হয়। ভালো ভ্রমণ স্বাস্থ্য বীমা জরুরি চিকিৎসা, হাসপাতালে ভর্তি, মেডিকেল ইভাকুয়েশন (প্রয়োজন হলে অন্য দেশে স্থানান্তর), এবং মেডিকেল রিপ্যাট্রিয়েশন (দেশে ফেরত আনা) কভার করে। পলিসির কভারেজ, বিশেষ করে প্রি-এক্সিস্টিং কন্ডিশন (আগের রোগ) কভার হয় কিনা, তা ভালো করে পড়ে নিন। বীমার জরুরি হেল্পলাইন নম্বর হাতের কাছে রাখুন।
- প্রশ্ন: বিদেশে কোন ধরনের ওষুধ নিয়ে যাওয়া যায়?
- উত্তর: আপনার ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য নিয়মিত ওষুধ নেওয়া যায়, তবে তা মূল প্যাকেটে এবং সংশ্লিষ্ট ইংরেজি প্রেসক্রিপশন বা চিকিৎসা সারাংশ সঙ্গে রাখতে হবে। বিশেষ করে পেইন কিলার, স্লিপিং পিল, বা সাইকিয়াট্রিক ওষুধের মতো কন্ট্রোল্ড সাবস্ট্যান্সের ক্ষেত্রে এটি অপরিহার্য। কিছু দেশে নির্দিষ্ট ওষুধ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। ভ্রমণের আগে গন্তব্য দেশের দূতাবাস বা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে ওষুধ সংক্রান্ত নিয়ম চেক করে নিন। ওষুধের মেয়াদও চেক করুন এবং প্রয়োজনের চেয়ে কিছু বেশি নিন।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।