নিজস্ব প্রতিবেদক : পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে ব্যর্থ, ধারাবাহিক মার্কেট দরপতন ও অযোগ্যতার দায় নিয়ে বিএসইসির চেয়ারম্যানের পদত্যাগের দাবি জানিয়েছেন বিনিয়োগকারীদের সংগঠন বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী সম্মিলিত পরিষদ (বিসিএমআইইউএ)।
শনিবার (২৮ সেপ্টেম্বর) দুপুরে পুঁজিবাজার নিয়ে কাজ করা সাংবাদিকদের সংগঠন ক্যাপিটাল মার্কেট জার্নালিস্ট ফোরামের (সিএমজেএফ) নিজস্ব কার্যালয়ে বিসিএমআইইউএ কর্তৃক আয়োজিতে এক সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে এ দাবি তুলেন ধরেন বিনিয়োগকারীদের সংগঠনটির সভাপত আ ন ম আতাউল্লাহ নাঈম।
এসময় বিসিএমআইইউএ সাধারণ সম্পদক শেখ আতিক ইখতিয়ার, সিএমজেএফ সভাপতি গোলাম সামদানী ভূঁইয়া ও সাধারণ সম্পাদক আবু আলীসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমের সংবাদকর্মী এবং বিনিয়োগকারীরা উপস্থিত ছিলেন।
পুঁজিবাজারে ২০১০ সাল থেকে সৃষ্ট মহাধসে ক্ষতিগ্রস্থ বিনিয়োগকারীরা এখনো মানবেতর জীবন যাপন করছে। এরপর অতিবাহিত হওয়া দীর্ঘ ১৫ বছরে পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে বিভিন্ন সময়ে অন্তত ১১ জন বিনিয়োগকারী আত্মহত্যা কিংবা হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন। অনেকে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফিরে আসতে সক্ষম হয়েছেন। সারা জীবনের সঞ্চয় বিনিয়োগ করে পথে বসে গেছেন কেউ কেউ। এমন ক্ষতিগ্রস্থদের ৫০ শতাংশ পুঁজির যোগান দিতে কর্তৃপক্ষকে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহনের দাবি করে (বিসিএমআইইউএ)।
একইসঙ্গে সংগঠনটি পুঁজি হারিয়ে আত্মহত্যা কিংবা হার্ট অ্যাটাকে মারা যাওয়া বিনিয়োগকারীদের পরিবার থেকে ১ জনকে চাকুরীর সু-ব্যবস্থা করে দেওয়াসহ মোট ১২ দফা দাবি জানান সংগঠনটি।
সংবাদ সম্মেলনে বিসিএমআইইউএ সভাপতি আ ন ম আতাউল্লাহ নাঈম বলেন, ‘গণমাধ্যমে বিভিন্ন সময়ে পুঁজি হারিয়ে যে আত্মহত্যার খবর এসেছ, বাস্তবে এর সংখ্যা আরো বেশি হবে।
কিছু ব্যক্তি ও গোষ্ঠির স্বার্থে কারসাজির কারণে সৃষ্ট পতনে বিনিয়োগকারীদের এমন মৃত্যু যাওয়াকে কিছুতেই মানতে পারছেন না বিনিয়োগকারীরা। এ অবস্থায় এই মুহুত্বে সামগ্রিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় দেশের অর্থনীতির অন্যতম মেরুদন্ড পুঁজিবাজারকে একটি টেকসই ও গতিশীল বাজার হিসেবে গড়ে তোলার কোন বিকল্প নেই।’
তিনি বলেন, ‘পুঁজিবাজার সংক্রান্ত বিষয়ে সকল স্টেকহোল্ডারদের সুচিন্তিত মতামত গ্রহণ করে পারস্পরিক অনাস্থা দূর করে বিনিয়োগকারীদেরকে আস্থায় নেওয়ার কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। অন্যাথায় ধারাবাহিক মার্কেট পতন ও অযোগ্যতার দায়ভার বিএসইসির চেয়ারম্যানকে নিতে হবে।’
বিসিএমআইইউ এর লিখিত দাবিগুলোতে উল্লেখ করা হয়- সম্প্রতি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ২৮টি কোম্পানিকে জেড ক্যাটাগরিতে পাঠানোর কারণে শেয়ারধারীরা মূলধন হারাচ্ছে। এই ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টকোম্পানিগুলোকে নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দেয়া যেতে পারে। পাশাপাশি কোম্পানিগুলোর পরিচালকদের দেশ ত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেয়া যেতে পারে। কোম্পানি সম্পর্কিত নন-কমপ্ল্যায়েন্স এর জন্য পরিচালকদের ব্যাক্তিগত অ্যাকাউন্ট জব্দ করে কমপ্ল্যায়েন্স ঠিক করতে হবে। তাহলে লভ্যাংশ বিতরণের অনিয়ম দূর হবে। পুঁজিবাজার সংক্রান্ত সকল স্টেকহোল্ডারদের সুচিন্তিত মতামত গ্রহণ করে পারস্পরিক অনাস্থা দূর করে বিনিয়োগকারীদের আস্থায় নেয়ার কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। অন্যথায় ধারাবাহিক মার্কেট পতন ও অযোগ্যতার দায়ভার নিয়ে বিএসইসি চেয়ারম্যানকে তার দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করতে হবে। পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীদের জন্য পুঁজির নিরাপত্তা বিধানের লক্ষ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ন্যায় আমাদের দেশে ‘পুঁজি বিনিয়োগ আইন’ প্রণয়ন কার্যকর করতে হবে। এর মাধ্যমে বিনিয়োগকারীরা প্রকৃত লভ্যাংশ না পেলে কিংবা কোম্পানিগুলো প্রতারণার আশ্রয় নিলে যেন আইনী সুযোগ নেয়া যায় তার নিশ্চয়তা থাকতে হবে। বিএসইসিকে পুঁজিবাজারের স্বচ্ছতা বাড়াতে আইনের সময়োপযোগী সংশোধন করতে হবে।
বিগত ১৫ বছর কারসাজির কারণে সৃষ্ট পতনে সর্বস্ব হারিয়ে যে সব বিনিয়োগকারী আত্মহত্যা ও হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন তাদের পরিবার থেকে ১ জনকে চাকুরীর সু-ব্যবস্থা করে দেওয়ার জন্য কর্তৃপক্ষকে উদ্যোগ নিতে হবে। এছাড়া ২০১০ সালের ধসের পর থেকে আজ অবদি পুঁজিহারা বিনিয়োগকারীদের ৫০ শতাংশ পুঁজির যোগান দিতে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। চিহ্নিত কারসাজিকারীদের কারণে মহাধসের পর থেকে যেসকল পুঁজি হারানো বিনিয়োগকারী তাদের পুঁজির রক্ষায় আন্দোলন করতে গিয়ে হয়রানিমূলক মিথ্যা মামলার স্বীকার হয়েছেন তাদের মামলা নিঃশর্ত প্রত্যাহার করতে হবে। মিথ্যা মামলা চালাতে গিয়ে যত টাকা খরচ হয়েছে তার ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করতে হবে।
লিখিত বক্তব্যে আরো দাবি করা হয়- পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোতে স্বেচ্ছাচারিতার কারণে বিনিয়োগকারীদের সঠিক তথ্য না দেওয়া, প্রকৃত লভ্যাংশ থেকে বিনিয়োগকারীদের বঞ্চিত করা, কোম্পানীর বিভিন্ন অনিয়ম তুলে ধরে কথা বলার সুযোগ না দেওয়া এবং দুর্নীতি ও অপকর্মের মাধ্যমে এজিএম সম্পন্ন করে কোম্পানির এজেন্ডা পাশ করানোর মধ্য দিয়ে বিনিয়োগকারীদের সর্বপ্রকার অধিকার হরণ করা হচ্ছে। পাশাপাশি আইপিওতে আসা কোম্পানিগুলোতে গিয়ে বিভিন্ন সংস্থার নামে চাঁদা আদায় ও এজিএমকে ঘিরে চলমান অনিয়ম দুর্নীতি অনুসন্ধান করে প্রকৃত দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে অবিলম্বে মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। পুঁজিবাজারের বর্তমান সংকটকালে ব্যাংকগুলোকে সংকট উত্তরণে এগিয়ে আসতে হবে। কারণ রাইট শেয়ার ছেড়ে সুবিধামতো সময়ে ব্যাংকগুলো পুঁজিবাজার থেকে হাজার-হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করেছিল। তাই পুঁজিবাজারে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ নিশ্চিত করার কার্যকর ভূমিকা ও উদ্যোগগ্রহণ করতে হবে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংককে পলিসি সাপোর্ট দিতে হবে। সবকিছু শুধু আইন দিয়েই হয় না, মানবিক বিষয়টি অনেক সময় আইনের উর্ধ্বে উঠে যায়। কারণ আইন যেহেতু মানুষের জন্যই। বর্তমান ধারাবাহিক দরপতনে বিনিযোগকারীরা নিঃস্ব। সুতরাং মানবিক কারণে ফোর্সসেল আপাতত বন্ধ রাখতে হবে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে পুঁজিবাজারকে অব্যাহতভাবে গতিশীল রাখার স্বার্থে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী ও বড় বিনিয়োগকারীদের বাজারে সক্রিয় করতে উদ্যোগ গ্রহণ করলেই ইক্যুইটি মাইনাস একাউন্টগুলো দ্রুত লেনদেনের আওতায় আসবে। এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় আইনী কাঠামোয় মার্চেন্ট ব্যাংক ও ব্রোকার হাউজগুলোকে তহবিল বৃদ্ধির জন্য তাদেরকে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় অর্থ সংগ্রহের সুযোগ দেওয়া যায় কিনা সে বিষয়ে বিএসইসির উদ্যোগ নিতে হবে। এছাড়া অতিদ্রুত বাইব্যাক আইন করতে হবে। কারণ সেকেন্ডারি মার্কেটে মৌলভিত্তি সম্পন্ন অনেক শেয়ারের মূল্য ফেসভ্যালুর কাছাকাছি। এমতাবস্থায় প্রিমিয়ামসহ ইস্যু মূল্যের নিচে শেয়ার দর নামলে তা সংশ্লিষ্ট কোম্পানি অথবা মালিককে বাইব্যাক করতে হবে ।
আইনি নির্দেশনা থাকা সত্বেও ইস্যু ম্যানেজাররা মৌলভিত্তি সম্পন্ন ইস্যু না এনে, নাম সর্বস্ব কোম্পানীর শেয়ার ছেড়ে অধিক প্রিমিয়ামসহ আইপিওএর মাধ্যমে অর্থ উত্তোলন করার পর আর কোন দায়বদ্ধতা নিতে চায় না। অথচ তালিকাভূক্তির ৩ বা ৬ মাসের মাথায় অনেক কোম্পানী বিভিন্ন অজুহাতে বিনিয়োগকারীদের অর্থ বছরের পর বছর আটকে যায়। এর জন্য দায়ী ইস্যু ম্যানেজারদের চিহ্নিত করে জরিমানা আদায় পূর্বক লাইসেন্স বাতিল ও আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। নতুন কোম্পানির সেকেন্ডারী মার্কেটে তালিকাভূক্তির পর তাদের সার্বিক কার্যক্রম সঠিক মনিটরিংএর আওতায় আনতে হবে।
এর বাইরে সংবাদ সম্মেলনে ‘পুঁজিবাজার বিষয়ক তথ্য ব্যাংক’ গঠন করে বিনিয়োগকারীদের জন্য পুঁজিবাজার সংক্রান্ত সকল প্রকার তথ্য নির্দিষ্ট স্থান থেকে সংগ্রহ করার সহজ সুবিধা নিশ্চিত করতে বিএসসিইকে ডিএসই ও সিএসই সমন্বয়ে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানানো হয়।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।