জুমবাংলা ডেস্ক: জাতি হিসেবে বাঙালির খাদ্য তালিকায় বৈচিত্র্যের যেন কমতি নেই। যুগে যুগে এই ভূখণ্ডে যত জাতির আগমন ঘটেছে, তাদের প্রায় সবারই অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় বাঙালির খাদ্যাভাসে। মাছে-ভাতে বাঙালির খাদ্য সংস্কৃতিতে বাড়তি মাত্রা যুক্ত করেছে তুর্কি, আরব, আফগান, পর্তুগিজ, ইংরেজসহ নানান সংস্কৃতির খাবার; সময়ের বিবর্তনে যা এখন এদেশের রসনাবিলাসের অপরিহার্য অংশে পরিণত হয়েছে। এসব খাবার যদি রাজপ্রাসাদের অন্দরমহলে নবাবি রেওয়াজে পরিবেশন করা হয়, তার থেকে অভিনব অভিজ্ঞতা আর দ্বিতীয়টি হবে কি?
বিশ্বের সবচেয়ে বড় ডাইনিং টেবিলে বসে খাবার সুযোগ পেতে যেতে হবে খুব বেশি দূরে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের বুকেই এই বড় ডাইনিং টেবিল অবস্থিত।
১৮৯৩ সাল। হায়দরাবাদের ঠিক মাঝখানে ধীরে ধীরে মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে এক রাজপ্রাসাদ। প্রাসাদের চূড়া যেন আকাশের গায়ে চুমু এঁকে দিচ্ছে। প্রাসাদের গড়ন যেমন, তার নামও তেমন। ফলকনামা প্রাসাদ। ফলকনামা শব্দের অর্থ আকাশের মতো। নবাব বিকার-উল-উমরা ১৮৯৩ সালে ফলকনামা প্রাসাদ তৈরি করেন। নবাব যখন ইউরোপ ঘুরতে গিয়েছিলেন তখন সেখানকার রাজপ্রাসাদগুলোর আদলে ভারতেও একটি প্রাসাদ নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন।
ভারতে ফিরে এসে প্রাসাদের জন্য জায়গাও বেছে নিলেন বিকার-উল-উমরা। হায়দরাবাদ শহরের ঠিক মাঝখানে নির্মাণ করে ফেলেন ফলকনামা প্রাসাদ। সৌন্দর্যের দিক থেকে এই প্রাসাদ তাকলাগানো। তবে, ফলকনামা প্রাসাদের মূল আকর্ষণ ভিন্ন। এই প্রাসাদের অন্দরমহলেই রয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে লম্বা ডাইনিং টেবিল।
এই ডাইনিং টেবিল কারুকার্যের দিক থেকে যেমন অনন্য, ঠিক তেমনই তার আকারের জন্যও বিশ্বজোড়া নজির গড়েছে ফলকনামা প্রাসাদ। ফলকনামা প্রাসাদের অন্দরে থাকা এই ডাইনিং টেবিলটি ৮০ ফুট লম্বা। টেবিলটি মোট সাতটি টুকরোয় বিভক্ত। একসঙ্গে এই টেবিলে মোট ১০১ জন অতিথি বসতে পারেন। খাবার পরিবেশন করার জন্য ব্যবহার করা হয় শাহি থালাবাসন। প্রাসাদের নির্মাণের সময় নাকি রাজপরিবারের সদস্যদের একসঙ্গে বসে খাওয়ার নিয়ম ছিল। ১০১ জন অতিথি একসঙ্গে বসলে তো কথাবার্তা বলার সমস্যা হতে পারে। সেই সমস্যা সমাধানের জন্য এই টেবিলে বসার ব্যবস্থা এমনভাবে করা হয়েছে যে, টেবিলের যে কোনো প্রান্তে বসে নীচু স্বরে কথা বললেও তা দূর প্রান্তের আসনে বসা ব্যক্তি শুনতে পাবেন।
টেবিলের উপরে দেওয়াল থেকে ঝুলতে দেখা যায় নবাবি নকশা করা ঝাড়বাতি। ডাইনিং রুমের দেওয়ালে বিভিন্ন চিত্র আঁকা রয়েছে। সেই চিত্রগুলি যথেষ্ট অর্থবহ এবং খাবারের সঙ্গে সম্পর্কিত। দেওয়ালের গায়ে আঁকা ওই চিত্রগুলিতে আঁকা রয়েছে এক একটি খাবারের ছবি। অর্থাৎ সারা ঘরজুড়ে এক একটি খাবারের চিত্র দিয়ে দেওয়ালের মধ্যেই অভিনব তালিকা তৈরি করা হয়েছে।
ইতিহাসবিদদের মতে, নবাবরা যখন খেতে বসতেন, তখন দেওয়ালের ওই আঁকাগুলোর দিকে আঙুল দেখাতেন। নবাবের চিত্রের দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ অনুযায়ী তাকে সেই খাবার পরিবেশন করা হতো। ফলকনামা প্রাসাদের ডাইনিং রুমে মানব পরিচালিত পাইপ অরগ্যান রয়েছে। ইতিহাসবিদেরা জানিয়েছেন যে, সারা বিশ্বে মানব পরিচালিত পাইপ অরগ্যান মাত্র দু’টি রয়েছে। তার মধ্যে একটি রয়েছে ফলকনামা প্রাসাদের অন্দরমহলে।
শুধু দীর্ঘতম ডাইনিং টেবিলই নয়, অতিথিদের মনোরঞ্জনের জন্য ফলকনামা প্রাসাদের ভেতর রয়েছে একটি বিশাল গ্রন্থাগার। নবাব বিকার-উল-উমরা যখন ইউরোপ ভ্রমণে গিয়েছিলেন, তখন উইন্ডসর প্রাসাদের গ্রন্থাগার থেকে ঘুরে আসেন। উইন্ডসর প্রাসাদের গ্রন্থাগারটি দেখে তিনি এতই মুগ্ধ হন যে, অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি ফলকনামা প্রাসাদে অনুরূপ একটি গ্রন্থাগার নির্মাণ করেন।
ফলকনামা প্রাসাদের গ্রন্থাগারে ৬ হাজার বই রাখা রয়েছে। এই গ্রন্থাগার যেন বইপ্রেমীদের কাছে বহুমূল্য খনির সমতুল্য। শোনা যায়, ১৮০১ সালে প্রকাশিত বহু বইও রয়েছে এখানে। যে নবাবেরা এই প্রাসাদে ঘুরতে এসেছিলেন, তারা তাদের অভিজ্ঞতাও কাগজেকলমে লিখে রেখে গিয়েছিলেন। সেই প্রাচীন নথিও সংগ্রহ করা রয়েছে গ্রন্থাগারের ভিতর।
গ্রন্থাগারের কাছেই একটি ঘরে রয়েছে বিলিয়ার্ড খেলার বন্দোবস্ত। নবাব বিকার-উল-উমরা যখন বাকিংহাম প্রাসাদে ঘুরতে গিয়েছিলেন তখন বিশালাকার বিলিয়ার্ড টেবিল দেখেছিলেন। সেই অনুপ্রেরণায় তিনি ফলকনামা প্রাসাদের ভিতরেও হুবহু বাকিংহাম প্রাসাদের মতোই বিলিয়ার্ড খেলার বন্দোবস্ত করেন।
৩২ একর জমির উপর বানানো ফলকনামা প্রাসাদ নিজের শখে তৈরি করেছিলেন নবাব বিকার-উল-উমরা। সেই সময় ৪০ লাখ টাকা খরচ করে এই প্রাসাদ নির্মাণ করেছিলেন তিনি। তখনকার দিনে ৪০ লাখ টাকা বর্তমানে কত কোটি টাকার সমান, তা কল্পনাতীত।
ফলকনামা প্রাসাদ তৈরি করার পর দেউলিয়া হয়ে যান নবাব বিকার-উল-উমরা। হায়দরাবাদের ষষ্ঠ নিজাম মির মেহবুব আলি খান যখন এই প্রাসাদে সময় কাটাতে আসেন তখন প্রাসাদের কারুকার্য দেখে মুগ্ধ হয়ে পড়েন তিনি। নবাবকে আর্থিক সাহায্যের হাতও বাড়িয়ে দিয়েছিলেন নিজাম।
অধিকাংশের দাবি, ফলকনামা প্রাসাদ ভারতের সংসদ ভবনের চেয়েও প্রায় পাঁচ গুণ বড়। এই প্রাসাদ একসময় অতিথিনিবাস হিসাবেও ব্যবহৃত হত। তবে, কারুকার্য এবং নির্মাণের দিক থেকে যতই নজরকাড়া হোক না কেন, ফলকনামা প্রাসাদের অন্দরমহলে বিশ্বের দীর্ঘতম ডাইনিং টেবিলে বসে খাওয়াদাওয়া করার অভিজ্ঞতা যে উল্লেখযোগ্য, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
সূত্র: ডেইলি বাংলাদেশ
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।