আন্তর্জাতিক ডেস্ক : ভ্যাঙ্কুভার, ক্যালগারি ও টরন্টো- এ তিনটি শহরই বিশ্বের সবচেয়ে বসবাসযোগ্য শহর সূচক গ্লোবাল লিভেবিলিটি ইনডেক্স ২০২৩-এর শীর্ষ ১০-এ স্থান পেয়েছে। এগুলোর প্রতিটির বাসিন্দাদের সাথে কথা বলে বিবিসি জানার চেষ্টা করেছে সেখানে কোনো বিষয়গুলো জীবনকে মধুর করে তোলে।
যদিও ইউরোপীয় ও স্ক্যান্ডিনেভিয়ান গন্তব্যগুলো প্রায়শই বিশ্বের নানা সূচকের শীর্ষে স্থান পায়। যেমন বিশ্বের সবচেয়ে স্বাস্থ্যকর দেশ কিংবা শিশুদের লালন-পালনের জন্য সেরা দেশ, ইত্যাদি।
তবে এক্ষেত্রে কানাডা যেন নীরবেই এগিয়ে চলেছে, আর ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট পরিচালিত সাম্প্রতিক গ্লোবাল লিভেবিলিটি ইনডেক্স বা সবচেয়ে বসবাসযোগ্য শহর সূচকে এটি বিশেষভাবে স্পষ্ট।
এতে কানাডার তিনটি শহর শীর্ষ ১০-এ স্থান পেয়েছে, যা অন্য যেকোনো দেশের প্রতিনিধিত্বের চেয়ে বেশি।
শীর্ষ তিনটি কানাডিয়ান শহরগুলোর মধ্যে রয়েছে ভ্যাঙ্কুভার (পঞ্চম স্থানে), ক্যালগারি (জেনেভার সাথে সপ্তমতম স্থানে) ও টরন্টো (নবম স্থানে)। এগুলোর প্রতিটিই স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষায় নিখুঁত স্কোর পেয়েছে।
ভ্যাঙ্কুভারের বাসিন্দা সামান্থা ফক বলেন,‘আমাদের প্রগতিশীল রাজনীতি ও সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা কানাডাকে বসবাসের জন্য একটি চমৎকার জায়গা করে তুলেছে’।
তিনি বলেন, ‘আমি এমন একটি দেশে বাস করার কথা কল্পনাও করতে পারি না যেখানে আমাকে একজন ডাক্তার দেখাতে বা আমার সন্তানকে হাসপাতালে নেয়ার সামর্থ্য নিয়ে চিন্তা করতে হবে। কিংবা যেখানে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দেউলিয়া হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।’
গণ পরিবহন ও ট্রানজিট ব্যবস্থায় কানাডার বিনিয়োগ দেশটির বড় শহরগুলোতে চলাচল সহজ করে তোলে। মিজ ফক, যিনি মন্ট্রিয়ল, ক্যালগারি ও টরন্টোতেও বসবাস করেছেন। তিনি ২৪ বছর বয়স পর্যন্ত তার ড্রাইভিং লাইসেন্স পাননি। তার একজন বন্ধু অবশেষে ৫৩ বছর বয়সে ড্রাইভিং লাইসেন্স পাচ্ছেন, কারণ তাদের কাছাকাছি যাওয়ার জন্য গাড়ির প্রয়োজন নেই।
এখানকার বাসিন্দারা যা সবচেয়ে বেশি পছন্দ যেটা করে তা হল দেশের বাইরের সাথে শক্তিশালী সংযোগ। মিজ ফক বলেন, ‘তিনটি (সবচেয়ে বসবাসযোগ্য) শহর-কানাডার অনেকগুলো শহরের মতোই প্রকৃতির কাছাকাছি অবস্থিত।’
তিনি আরো বলেন, ‘টরন্টোতে উপত্যকা প্রণালী ও সমুদ্র সৈকত রয়েছে; মন্ট্রিয়ালের মন্ট রয়্যাল ও সারিবদ্ধ গাছের রাস্তা; এবং ভ্যাঙ্কুভারে রয়েছে স্ট্যানলি পার্ক, বিশ্বের শহুরে প্রকৃতির অন্যতম সেরা উদাহরণ।’ তবে বড় শহরগুলোর বাইরেও প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য আছে, যা বাসিন্দাদের কাছে বন্য প্রকৃতির গুরুত্বকে তুলে ধরে।
বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ (স্থলভাগের দিক থেকে) জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে তিনটি শহর, যেগুলোর প্রতিটিরই নিজস্ব ও অনন্য আবেদন রয়েছে।
ভ্যাঙ্কুভার
দেশের নৈসর্গিক পশ্চিম উপকূলে অবস্থিত, ভ্যাঙ্কুভার কানাডার সবচেয়ে বাসযোগ্য শহর হিসেবে স্থান করে নিয়েছে সংস্কৃতি ও পরিবেশ-বিষয়ক সাব-ইনডেক্সে। এখানকার বাসিন্দারা শহরটির প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মোহিত।
মিজ ফক বলেন, ‘ভ্যাঙ্কুভারের পাহাড় ও সমুদ্রের অনন্য সংমিশ্রণ এটিকে অপ্রতিরোধ্য করে তোলে।’ যিনি শহরের অদূরে তার যোগাযোগ সংস্থা পরিচালনা করেন।
তিনি বলেন, ‘শহর থেকে সবচেয়ে বেশি সুবিধা পেতে আপনাকে অবশ্যই বাইরে যেতে হবে। বিশেষ করে যখন বৃষ্টি হচ্ছে। এর জন্য একটি সহজ জায়গা হল স্ট্যানলি পার্ক, শহরের কেন্দ্রস্থলে একটি ৪০৫ হেক্টরের পার্ক যেখানে বহু শতাব্দী পুরানো গাছসহ একটি উপকূলীয় রেইনফরেস্ট রয়েছে, যার মধ্যে ‘হলো ট্রি’ নামক একটি ৭০০-৮০০ বছর বয়সী লাল সিডার গাছ রয়েছে।
এর বাসিন্দা স্টোলার বলেন,‘অভিনব রেস্তোরাঁ থেকে শুরু করে মজাদার খাবারের ট্রাক ও কৃষকদের বাজার, আপনার কখনই সুস্বাদু খাবারের অভাব হবে না। শহরটি একটি উদ্যোক্তা ও সহযোগিতামূলক মানসিকতাও গড়ে তোলে বাসিন্দাদের মাঝে। ভ্যাঙ্কুভারের লোকেরা খোলা মনের, বৈচিত্র্যময় এবং শিল্প, প্রযুক্তি বা পরিবেশগত উদ্যোগের জন্য একত্রিত হওয়া পছন্দ করে।’
ক্যালগারি
পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশ আলবার্টার রকি মাউনটেন্স পর্বতমালার কাছে অবস্থিত ক্যালগারি কানাডার অন্য দু’টি শহরকে স্থিতিশীলতার সূচকে (নাগরিক অস্থিরতা ও সরকারি দুর্নীতির একটি পরিমাপ) ছাড়িয়ে গেছে। শহরটির বাসিন্দাদের বর্ণনায়, বড়-শহরের সব সুযোগ-সুবিধাসহ একটি ছোট শহরে থাকার অনুভূতি দেয় ক্যালগারি, যেখানে কানাডার অন্য শহরগুলোর তুলনায় জীবনযাত্রার খরচও কম।
এর বাসিন্দা ভ্রমণ বিষয়ক ব্লগার লোরা পোপ বলেন, ‘কানাডার বড় শহরগুলোর একটি হওয়া সত্ত্বেও, ক্যালগারি একটি অনন্য আকর্ষণ বজায় রাখে, যা এখানে বসবাসকারীদের বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাব, সম্প্রদায়-ভিত্তিক মানসিকতা ও প্রতিবেশী-কেন্দ্রিক কৃষকদের বাজার থেকে আসে।’
তিনি বলেন, ‘রেস্তোরাঁ, সাংস্কৃতিক উৎসব ও চমৎকার নাইট-লাইফ কাটানোর ব্যবস্থার কোনো অভাব নেই এখানে।’ শহরটিও বৈচিত্র্যময়-২৪০টিরও বেশি জাতি ও ১৬৫টি ভাষা চর্চার স্থান ক্যালগারি হচ্ছে কানাডার বৈচিত্র্যময় শহরগুলোর মধ্যে তৃতীয়।
শহরটিতে একটি লাভজনক তেল ও গ্যাস শিল্পের পাশাপাশি বড় একটি ব্যবসায়ী সম্প্রদায়সহ সাশ্রয়ী মূল্যের জীবনযাত্রা রয়েছে। তিন বছর আগে এডমন্টন থেকে এই শহরে চলে আসা যোগাযোগ বিষয়ক পেশায় নিয়োজিত জেসি পি কায়াবো, ‘ক্যালগেরিয়ানদের কাছে অর্থ আছে এবং তারা সেটা ব্যয় করতে ভালোবাসে।’
ক্যালগারি-ভিত্তিক উপদেষ্টা সংস্থা ক্যাপটিভেট বেনিফিটসের মালিক শ্যানন হিউজ বলেন, ‘মানুষ বাইরে যাচ্ছে, রেস্তোরাঁগুলো ব্যস্ত।’
মিজ পোপ বলেন, ‘কানাডার অনেক স্থানের মতোই প্রকৃতির সহজলভ্যতা ক্যালগারিতে জীবনযাত্রার মান উন্নত করে। উত্তর আমেরিকার সবচেয়ে বিস্তৃত পথ ও বাইকওয়ে নেটওয়ার্ক রয়েছে ক্যালগারিতে, যেখানে হাঁটার ও সাইকেল চালনার জন্য এক হাজার কিলোমিটারের বেশি পথ রয়েছে। এই পথে সাইকেল চালানো আমাকে শহরের কিছু লুকানো রত্ন আবিষ্কার করতে সাহায্য করেছে, দর্শনীয় দৃশ্যগুলো দেখিয়ে আমার প্রতিদিনের চাহিদা পূরণে একটি ডেইলি ডোজ দিয়েছে।’
টরন্টো
কানাডার সবচেয়ে জনবহুল শহর হিসাবে টরন্টো এক হাজার ৫০০টিরও বেশি পার্কের সাথে বড়-শহরের আবহকে একত্রিত করে যা এখানকার বাসিন্দাদেরকে বাইরের জগতের সাথে সংযুক্ত রাখে। স্থিতিশীলতার র্যাংকিং-এ নিখুঁত স্কোরসহ টরন্টো একটা নিরাপত্তার বোধ বজায় রাখে যা বাসিন্দাদের হাঁটা, গণ পরিবহন ব্যবহার করা কিংবা সাইকেল চালানোর সময় স্বাচ্ছন্দ্য দেয়।
বিশেষ করে, ‘পাথ’ বা পথচারীদের জন্য তৈরি ভূগর্ভস্থ হাঁটার পথ কানাডার শীতকে বেশ সহনীয় করে তোলে। “আমার অফিস থেকে এয়ারপোর্ট (ট্রেন), খাবারের দোকান, কেনাকাটার জায়গা, এমনকি ডাক্তারের এ্যাপয়েন্টমেন্ট—সব কাজ শীতের কাপড় পরা ছাড়াই করা সম্ভব,” বলেন টরন্টোর বাসিন্দা হোয়াং আন লে, যিনি পেশায় একজন ব্লগার।
শহরটি বৈচিত্র্যের জন্যও পরিচিত। এর ৫১ শতাংশেরও বেশি বসবাসকারীর জন্ম কানাডার বাইরে।
সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠান হোস্টওয়ের নির্বাহী প্রধান ও সহ-প্রতিষ্ঠাতা মার্কাস রেডার বলেন, ‘এটি একমাত্র পশ্চিমা শহর যেখানে অশ্বেতাঙ্গ সংখ্যালঘুরাই আসলে সংখ্যাগরিষ্ঠ। এখানে প্রচুর সংস্কৃতি ও ভাষা চর্চার সুযোগ রয়েছে এবং কানাডা আত্মীকরণের চাপ দেয়ার বদলে বহু-সংস্কৃতিকে উৎসাহিত করে।’
সংস্কৃতির এই বৈচিত্র্য বিভিন্ন উৎসব, নানারকম রন্ধনপ্রণালী, ইত্যাদির মধ্য দিয়ে নতুন ধারণা ও জীবনযাপনের পদ্ধতির সাথে পরিচিত করে সম্মানের সাথে সম্প্রদায়গুলোকে সমৃদ্ধ করে।
একটি উদ্যোক্তা মনোভাবও টরন্টোকে প্রভাবিত করে–বড় ব্যবসা (উবার, গুগল ও ফেসবুকের অফিস আছে এখানে) থেকে শুরু করে নুতন স্টার্টআপ পর্যন্ত। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, শহরটি উত্তর আমেরিকার তৃতীয় বৃহত্তম প্রযুক্তি কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।
ক্রীড়া-বিষয়ক অ্যাপ ক্যাচকর্নারের প্রধান নির্বাহী ও সহ-প্রতিষ্ঠাতা জনাথন আজৌরি বলেন, ‘মানুষের কাজ ও ব্যক্তিগত জীবনের সাথে সাংস্কৃতিক নানা প্রচলন ও চর্চা শিখতে পারাও বেশ আকর্ষণীয় ব্যাপার। ব্যাপারটা অনেকটা এমন যে আপনি এই শহর ছেড়ে না গিয়েও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের কর্মজীবনের অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারছেন।’
সূত্র : বিবিসি
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।