জুমবাংলা ডেস্ক : বিশ্ব শিক্ষক দিবস উপলক্ষে, ইউনেস্কো প্রতি বছর একটি স্লোগান প্রকাশ করে। ২০২২ সালের স্লোগান ছিল-‘ শিক্ষকরাই শিক্ষা পুনরুদ্ধারের কেন্দ্রবিন্দু’। বরাবরই শিক্ষক দিবসে শিক্ষকরাই কেন্দ্রবিন্দু হয়ে থাকে যা হওয়াটাও স্বাভাবিক। ২০২৩ সালের বিশ্ব শিক্ষক দিবসের প্রতিপাদ্য ” The transformation of Education begins with teacher ” অর্থাৎ “শিক্ষার পরিবর্তন শিক্ষক দিয়ে শুরু হয় “। ২০২৪ সালের প্রতিপাদ্য “ শিক্ষকের কন্ঠস্বর : শিক্ষায় একটি নতুন সামাজিক অঙ্গীকার। তবে এবার অন্য বারের চেয়ে বেশ জাঁকজমকপূর্ণভাবেই সরকারিভাবে বাংলাদেশে এ দিবসটি পালিত হবে। যা ইতিমধ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করেছে যা নি:সন্দেহে ধন্যবাদ পাবার যোগ্য। এই নীতিমালা “বিশ্ব শিক্ষক দিবস উদযাপন ২০২৪” নামে অভিহিত হবে।
তবে বিশ্বে অনেক দেশ আছে আলাদা আলাদাভাবে তাদের দেশে শিক্ষক দিবস পালন করে থাকে। যেমন ভারতের শিক্ষক দিবস হচ্ছে ৫ সেপ্টেম্বর। কারণ ভারতের প্রথম সহ – রাষ্ট্রপতি এবং দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি ড. সর্বপল্লি রাধাকৃষ্ণনের জন্মদিন ঐ তারিখ। তাই একজন প্রখ্যাত পণ্ডিত, দার্শনিক, এবং ভারতরত্ন প্রাপক, ডঃ রাধাকৃষ্ণান ৫ সেপ্টেম্বর, ১৮৮৮ সালে জন্মগ্রহণ করেন। রাধাকৃষ্ণান চেন্নাইয়ের প্রেসিডেন্সি কলেজ এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সহ বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন। তিনি অন্ধ্র প্রদেশ বিশ্ববিদ্যালয়, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় এবং বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৫২ সালে ভারতের প্রথম সহ-রাষ্ট্রপতি হিসেবে নিযুক্ত হন এবং ১০ বছর পর,১৯৬২ সালে ভারতের দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি হন রাধাকৃষ্ণান।
আবার ১১ সেপ্টেম্বর ডোমিনো ফসটিনো সার্মেন্তোর মৃত্যু দিবসকে কেন্দ্র করে আর্জেন্টিনা এ দিনটিকে শিক্ষক দিবস হিসেবে পালন করে। অনুরুপভাবে বেলারুশ ১৪ আগষ্ট, ব্রুনাই ২৩ সেপ্টেম্বর তারিখে শিক্ষক দিবস পালন করে থাকে।
ইউনেস্কোর মতে, বিশ্ব শিক্ষক দিবস শিক্ষা ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে শিক্ষকদের অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ পালন করা হয়।
তবে এবার বাংলাদেশের জন্য আশার বিষয় হচ্ছে যে, প্রতি বছর ৫ অক্টোবরকে ‘জাতীয় শিক্ষক দিবস’ এর পরিবর্তে ‘বিশ্ব শিক্ষক দিবস’ হিসেবে উদযাপনের অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। দীর্ঘদিন একটানা শিক্ষকদের আন্দোলন ও তাঁদের বিভিন্ন দাবিদাবা আদায়ের জন্য আন্দোলনের একটা বিশেষ প্রভাবের ফলই এ অনুমোদন। এ ব্যাপারে শিক্ষামন্ত্রী ডা: দীপু মনি বলেন,” শিক্ষাবান্ধব শেখ হাসিনার বর্তমান সরকার শিক্ষকের অধিকার ও মর্যাদা রক্ষায় বদ্ধ পরিকর”। মঙ্গলবার(৬ আগস্ট ২৩) রাজধানীর হেয়ার রোডে শিক্ষা মন্ত্রীর সরকারি বাসভবনে স্বাধীনতা শিক্ষক পরিষদের (স্বাশিপ) নেতৃবৃন্দের সঙ্গে এক সৌজন্য বৈঠকে এ কথা বলেন তিনি। শিক্ষামন্ত্রী বলেন, “দেশের বিভিন্ন শিক্ষক সংগঠন দীর্ঘদিন যাবৎ রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে বিশ্ব শিক্ষক দিবস পালনের দাবি জানিয়ে আসছিল কিন্তু কোন সরকারই এই দিবসটি পালনের উদ্যোগ নেয়নি। শিক্ষকদের মর্যাদার কথা বিবেচনা করে প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রী পরিষদের সভায় এবার ৫ অক্টোবর থেকে সারা বিশ্বের সাথে একই দিনে বিশ্ব শিক্ষক দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে।” এবার শিক্ষক দিবসে শিক্ষকদের জন্য বিশেষ সারপ্রাইজ ঘোষণা হবে বলে শিক্ষক সমাজে বেশ একটা গুঞ্জন শুনা যাচ্ছে। তবে তার জন্য ৫ অক্টোবর পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। কেননা দীর্ঘদিনের বৈষম্য, শিক্ষকদের তীব্র আন্দোলন ও সামনে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিশেষ কিছু আশা করা বেশ যৌক্তিক ও প্রাসঙ্গিক।
বিশ্বের প্রায় ১০০টি দেশে দিবসটি পালিত হয়ে থাকে। এ দিবস পালনে এডুকেশন ইন্টারন্যাশনাল (ইআই) ও তার সহযোগী ৪০১টি সদস্য সংগঠন মূল ভূমিকা রাখে। ইআই প্রতি বছরই একটি প্রতিপাদ্য বিষয় নির্ধারণ করে থাকে যা জনসচেতনতা বৃদ্ধির সাথে সাথে শিক্ষকতা পেশার অবদানকেও স্মরণ করিয়ে দেয়। যাতে সমাজে তথা রাষ্ট্রে একজন শিক্ষক তার শিক্ষা দানের মাধ্যমে রাষ্ট্রকে আরো সামনে এগিয়ে নিয়ে যায়। শিক্ষকের সম্মান বৃদ্ধি ও শিক্ষকের অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে ও এ দিবসটি বেশ জোরালো ভূমিকা রাখে। এক সময় শিক্ষক মানেই মনে করা হতো চোখে কালো মোটা ফ্রেমের চশমা আর হাতের বগলের নিচে ছাতা। মান্ধাতার আমলের এ ধ্যান ধারণা এখন আর নেই। পূর্বের চেয়ে শিক্ষকের সম্মান ও সম্মানী যথেষ্ট বৃদ্ধি করছে এ সরকার যদিও বর্তমান দ্রব্যমূল্যের উর্ধগতির সাথে এ বেতন শিক্ষকদের বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। আমরা আশাবাদী নতুন পে- স্কেল ঘোষণার মাধ্যমে এটাও দূরীভূত হবে শীগ্রই। স্কুল বা কলেজ জীবনে “তোমার জীবনের লক্ষ্য” রচনা লেখার সময় খুব অল্প সংখ্যক ছাত্রই আমি শিক্ষক হব এ কথাটি লিখত। বর্তমান সময়ে মেধাবীরা শিক্ষকতা পেশাকে মহান পেশা হিসেবে বেছে নিচ্ছে।
তবে একজন শিক্ষক হিসেবে আমার ব্যক্তিগত কিছু অভিমত রয়েছে। বিশেষ করে এমপিওভূক্ত শিক্ষকদের ক্ষেত্রে সেটা বিশেষভাবে পরিলক্ষিত। যেমন ২৫% উৎসব বোনাস, নামেমাত্র চিকিৎসাভাতা ও ঘরভাড়া, অবসর পরবর্তী সময়ে পেনশন না থাকা ইত্যাদি প্রধান অন্তরায়। বর্তমান দেশের প্রেক্ষাপটে শিক্ষকদের বইপত্রে মহৎ পেশা হিসেবে উল্লেখ করা হলেও বাস্তবিক পক্ষে তাদের যথাযথ সম্মান করা হয় না। অথচ ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের ২১ দফা দাবির অন্যতম দফা ছিল ” শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার সাধন করে সরকারি ও বেসরকারী বিদ্যালয়গুলোর মধ্যকার ব্যবধান দূর করা হবে এবং শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলা ভাষাকে চালু করা হবে”। ২১ দাবির অনেক দাবিই সম্পন্ন হলেও এ দাবির আংশিক উন্নতি হয়েছে মাত্র। উদাহরণ স্বরুপ বলা যায়, যে কোন সামাজিক অনুষ্ঠানে একজন শিক্ষকের চেয়ে ছোটখাট রাজনৈতিক পদের ব্যক্তির কদর অনেক বেশি করা হয়।
একজন শিক্ষক কোন অনুষ্ঠানে প্রধান বা বিশেষ অতিথি হওয়া যেন স্বপ্নের মত। তাছাড়া একজন শিক্ষকে স্কুল বা কলেজের বাহিরে তাদের পূর্বের ন্যায় সম্মান করা হয় না। মুঘল বাদশা আলমগীরের শিক্ষকদের প্রতি সম্মান প্রদশর্ন স্বরুপ ‘শিক্ষাগুরুর মর্যাদা ‘ কবিতাটি অনেকটাই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘কেউ কথা রাখেনি ‘ কবিতার মতই শুধু আক্ষেপ। তাছাড়া শিক্ষকদের হাতের শাসনদন্ড তাদের মধ্যে আর নেই ফলে শিক্ষক নিরবে একজন ছাত্রছাত্রীদের বেয়াদবি করা সত্বেও কিছু করার থাকেনা।ফলে সমাজে নৈতিক মূল্যবোধের অভাব থেকেই যাচ্ছে। কেননা একজন ছাত্র বা ছাত্রীকে বেত্রাগাত বা মানসিক আঘাত করার বিধান আমাদের নেই। যদিও যারা এ বিধান চালু করেছেন তাঁরাও কোন না কোন শিক্ষকের ছাত্র বটে। ছোটকালে আঞ্চলিক ভাষায় একটা প্রবাদ শুনেছিলাম ” মা জন্ম দেয় ভূত, শিক্ষকরা বানায় পুত”। আশাবাদী মানুষ হিসেবে আমিও আশা করছি বাংলাদেশেও বাদশা আলমগীরের যোগ্য উত্তরসূরী হবেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা। ২০২৩ সালের নতুন শিক্ষাক্রমের মতই নতুন একটি শিক্ষক সম্মানী নীতিমালা প্রণয়ন হবে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। ১০০০ টাকা বাড়ি ভাড়া, ৫০০ টাকা চিকিৎসা ভাতা ও মূল বেতনের ২৫% উৎসব বোনাসের মত এত নিম্ন ও শিক্ষক সমাজের জন্য লজ্জাজনক ভাতা আর পরবর্তীতে নিশ্চয়ই পরিবর্তন করা হবে। এবারের শিক্ষক দিবস হবে শিক্ষকদের স্বপ্ন পূরণের দিবস। স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মানে সরকার শিক্ষকদের একটা স্মার্ট বেতন কাঠামোসহ শিক্ষকদের স্মার্ট জীবন ব্যবস্থার ঘোষণা দিবে এই বিশ্ব শিক্ষক দিবসে। পাশাপাশি আমরাও আমাদের অবস্থান থেকে শিক্ষনীয় গবেষণা, শিক্ষকের পেশাগত মূলবোধ ও দায়বদ্ধতায় অটুট থাকতে হবে। শিক্ষকের সম্মান, সামাজিক মর্যাদাবৃদ্ধি, ছাত্র ও শিক্ষকের সু সম্পর্কসহ সকল প্রকার অসঙ্গতি দূর হোক এটাই একমাত্র কাম্য।
লেখক : প্রভাষক, ভাওয়াল মির্জাপুর কলেজ, গাজীপুর সদর, গাজীপুর।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।