জুমবাংলা ডেস্ক : বেইলি রোডে ‘গ্রিন কোজি কটেজ’ শপিংমলে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় সংবাদ সম্মেলন করেছে বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউট।
বুধবার (৬ মার্চ) দুপুরে বাস্থই প্রাঙ্গণে এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে ‘অগ্নি নিরাপত্তা ও জীবনের সুরক্ষা’ নিয়ে নানা পদক্ষেপের কথা তুলে ধরেন বক্তারা।
সংবাদ সম্মেলনে বক্তারা বলেন, গত ২৯ ফেব্রুয়ারি বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজ শপিংমলে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে নিহতদের শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউটের গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি এবং দুর্ঘটনায় আহতদের দ্রুত আরোগ্যলাভ কামনা করছি। এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত হবে এবং সংশ্লিষ্ট সকল দায়ী ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
তারা বলেন, এই অগ্নিকাণ্ডের পরের দিন সকালেই বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউটের একটি প্রতিনিধিদল ঘটনাস্থল সরেজমিনে পরিদর্শন করে। পরিদর্শনকালে উপস্থিত ছিলেন বাস্থই সভাপতি, সহ-সভাপতি (জাতীয় বিষয়াদি), সাধারণ সম্পাদক, সহ-সাধারণ সম্পাদক ও সম্পাদকগণ (সদস্যপদ)। জননিরাপত্তার স্বার্থে এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাটির গুরুত্ব বিবেচনা করে সরকার ইতোমধ্যেই একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউট ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত একটি জাতীয় সংগঠন যা দেশের পেশাজীবী স্থপতিদের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করছে। এর পাশাপাশি বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন নীতিনির্ধারণে প্রয়োজনীয় সহায়তাও প্রদান করছে। বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউট, এই দুর্ঘটনার বিষয়ে পর্যবেক্ষণ এবং ভবনে অগ্নিনিরাপত্তা বৃদ্ধির উপায় সম্পর্কে জনসাধারণের অবগতি ও প্রয়োজনীয় পরামর্শ সেবা প্রদানের লক্ষ্যে আজকের এই সংবাদ সম্মেলনটির আয়োজন করেছে।
সংবাদ সম্মেলনে বাস্তুই’র পক্ষ হতে উপস্থিত ছিলেন- বাস্থই সভাপতি স্থপতি প্রফেসর ড. খন্দকার সাব্বির আহমেদ, সহ-সভাপতি (জাতীয় বিষয়াদি) স্থপতি প্রফেসর মুহাম্মদ আলী নকী, সহ-সভাপতি (আন্তর্জাতিক সম্পর্ক) স্থপতি খান মোঃ মাহফুজুল হক সাধারণ সম্পাদক স্থপতি নবী নেওয়াজ খান, সম্পাদক (পেশা) স্থপতি মোঃ নাজমুল হক বুলবুল এবং সম্পাদক (পরিবেশ ও নগরায়ন) স্থপতি সুজাউল ইসলাম খান সহ অন্যান্য নির্বাহী পরিষদের সদস্যগণ।
বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজ শপিংমলে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে প্রাথমিকভাবে নিম্নের পর্যবেক্ষণগুলো বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউট জনসাধারণের কাছে উপস্থাপন করেন-
১. অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত ভবনটির নির্গমন পথ বাধা মুক্ত ছিল না বলে প্রতীয়মান হয়। বিশেষ করে সিঁড়িগুলোতে গ্যাস সিলিন্ডার এবং অন্যান্য মালামাল সংরক্ষিত ছিল।
২. ভবনটির সিঁড়ির ফায়ার রেটেড ডোর পরিলক্ষিত হয়নি। এর ফলে অগ্নিকাণ্ডের ধোঁয়া অতি দ্রুত এক ফ্লোর থেকে পুরো ভবনে ছড়িয়ে পড়ে।
৩. প্রাথমিকভাবে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত ঘটে ভবনের নিচতলার পশ্চাত অংশে, যেখানে দমকল বাহিনীর কর্মীরা সহসা পৌঁছাতে পারেননি এবং দ্রুত সময়ের মধ্যে অগ্নিনির্বাপন করতে সক্ষম হননি। উল্লেখ্য, ভবনের নিচতলার পশ্চাত অংশে কোনো নির্গমন পথ ছিল না।
৪. ভবনটিতে অগ্নিপ্রতিরোধের জন্য প্রয়োজনীয় শনাক্তকরণ এবং অগ্নিনির্বাপনের ব্যবস্থা ছিল খুবই অপ্রতুল।
৫. ভবনটিতে গ্যাস সিলিন্ডারের ব্যবস্থাপনা যথাযথ ছিল না।
৬. ভবনটি রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) অনুমোদিত নকশা অনুযায়ী নির্মিত হয়েছিল কিনা কিংবা অকুপেন্সি সার্টিফিকেট নেওয়া হয়েছিল কিনা তা তদন্তের দাবি রাখে।
এই মর্মান্তিক ভয়াবহতার পুনরাবৃত্তি রোধকল্পে করণীয় বিষয়সমূহ তুলে ধরেছেন প্রতিনিধিদল-
১. আইনি কাঠামো এবং আইনের প্রয়োগ : বাংলাদেশ স্থপতি ইনসটিটিউট, অগ্নিনিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়ে, ইমারত নির্মাণ বিধিমালা ২০০৮, বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড ২০২০ এবং বাংলাদেশ অগ্নিনিরাপত্তা আইন ২০১৪ তে দেওয়া আইনগুলো পর্যবেক্ষণ করে এই অভিমত দেয় যে, এই তিন সূত্রে উল্লিখিত আইনসমূহ জননিরাপত্তার ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত। তবে আইনের সঠিক প্রয়োগ এবং বাস্তবায়নের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাব সুস্পষ্ট। এ বিষয়ে দ্রুত কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা একান্ত প্রয়োজন।
২. ভবনের ব্যবহার পরিবর্তন বিষয়ে : একটি ভবনের আয়ু সাধারণত ৫০ বছর পর্যন্ত ধরা হয়। ভবনের আয়ুষ্কালে শহর ও সমাজের পরিবর্তন অতি স্বাভাবিক, তাই ভবনের অনুমোদিত ব্যবহারও বদলাতে পারে। অতি দ্রুত বর্ধনশীল, ঘনবসতিপূর্ণ এই নগরে প্রয়োজনীয় সামাজিক পরিসর এবং চিত্তবিনোদনের সুযোগ অতি সীমিত যা ভবনগুলোর ব্যবহারের উপর প্রভাব ফেলে। এই পরিস্থিতিতে ভবনের ব্যবহার পরিবর্তনের সুযোগ রয়েছে। বিদ্যমান আইনের সঙ্গে সমন্বয় করে যথাযথ প্রক্রিয়ায় এ পরিবর্তন করা প্রয়োজন। ঢাকায় কোন ভবনের ব্যবহার পরিবর্তন করার জন্য বিভিন্ন সরকারি সংস্থার অনুমতি প্রয়োজন হয়, যার মধ্যে রাজউক, সিটি করপোরেশন, ফায়ার সার্ভিস, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ইত্যাদি রয়েছে। প্রয়োজনে ভবন ব্যবহার পরিবর্তন করার পদ্ধতিটি ডিজিটাল করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে।
৩. ভবনের অগ্নিপ্রতিরোধ ব্যবস্থাপনায় আধুনিক অগ্নিনিরাপত্তা কৌশলের ব্যবহার : বর্তমানে অগ্নিনিরাপত্তা কৌশল নির্ধারণ একটি অত্যন্ত পরিশীলিত বিজ্ঞান। একটি ভবনে ব্যবহৃত নির্মাণ উপকরনের দাহ্যতা সম্পর্কে তথ্যাদি Material Safety Data Sheet এর মাধ্যমে স্থপতি, প্রকৌশলী এবং সকল অংশীজন অবগত থাকেন। প্রতিটি ভবনের ধারণ ক্ষমতা অনুযায়ী Life Safety Plan বা জীবন রক্ষা নকশাও করা হয়। অগ্নি নিরাপত্তার জন্য ভবনের ধারণ ক্ষমতা, ব্যবহারের প্রকৃতি অনুযায়ী পৃথকীকরণের জন্য ভবনে ব্যবহৃত নির্মাণ উপকরণের দাহ্যতা বিবেচনা করা হয়। তবে আমাদের দেশে এসবের অনেক কিছুই বেশ ব্যয়বহুল। কিছু নির্মাণ উপকরণের Material Safety Data Sheet ও অনুপস্থিত। অতি ঘনবসতিপূর্ণ এই নগরের সু-উচ্চ ভবনগুলোতে অগ্নিনিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য এসব উপকরণের সাশ্রয়ী মূল্য ও মান নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন। ফায়ার সার্ভিসসহ সংশ্লিষ্ট সকল সংস্থাগুলোর দক্ষতা ও সক্ষমতা এবং সমন্বিত ব্যবস্থাপনা এখন অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
৪. NFPA এর সূত্রমতে পৃথিবীর ৫০% অগ্নিকাণ্ডের সূচনা রান্নাঘর থেকেই হয়। একে বিশেষ বিবেচনায় নিতে হবে। রান্নাঘরের ব্যবহারগুলোকে কম্পার্টমেন্টালাইজড করে ধোঁয়া, আগুন ও ক্ষতিকর গ্যাসকে সীমাবদ্ধ করা যায়। এ ছাড়া কমার্শিয়াল কিচেনের জন্য আলাদা অনুমোদন প্রক্রিয়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
৫. অগ্নি নিরাপত্তা বিষয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধি, বছরে একাধিক নির্দিষ্ট দিনে শহরের সকল ভবনে ফায়ার ড্রিল করা, অগ্নিদুর্যোগ মোকাবিলার জন্য প্রতিটি ওয়ার্ডে প্রয়োজনীয় সংখ্যক কমিউনিটি ভিত্তিক স্বেচ্ছাসেবক দল গঠন এবং মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যক্রমে এ সম্পর্কিত অধ্যায় সংযোজন করা যেতে পারে।
৬. অগ্নিনিরাপত্তায় ব্যবহৃত আমদানিকৃত উপকরণের শুল্ক ও কর সর্বক্ষেত্রে কমানো, মূল্য নির্ধারণ করা এবং দেশি শিল্প খাতকে তা উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনে প্রনোদণা দেওয়া যেতে পারে। ভবনে ইন্টেরিয়র ডিজাইনে যে সকল নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার করা হয় তা কতটুকু ফায়ার রেটিং সম্পন্ন তার বিস্তারিত তথ্য ওই নির্মাণ সামগ্রীসমূহে উল্লেখ করার জন্য নির্মাতা প্রতিষ্ঠান এবং আমদানিকারকদের নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
৭. বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউট মনে করছে যে, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নেতৃত্বে সংশ্লিষ্ট সংস্থা এবং পেশাজীবী ইনস্টিটিউটের অংশীজনদের সমন্বয়ে ভবনের অগ্নি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য একটি জাতীয় টাস্ক ফোর্স গঠন করার এখনই উপযুক্ত ও সঠিক সময়।
৮. রাজউক এলাকাসহ সারা দেশে স্থপতিদের স্বাক্ষর জাল করে নকশা অনুমোদন করার বিষয়টি মহামারি আকার ধারণ করেছে। নকশা প্রণয়নের ন্যূনতম যোগ্যতা নেই এমন অসাধু চক্র এই কাজে জড়িত। ফলস্বরূপ বিপুল, মতান্তরে অধিকাংশ ভবন অনুমোদিত হচ্ছে যার নকশা প্রকৃতপক্ষে এমন ব্যক্তির দ্বারা প্রণীত, যার অগ্নি নিরাপত্তা ও জীবন সুরক্ষা বিষয়ে ন্যূনতম কোনো জ্ঞান নেই। অতিসত্বর এই অসাধু চক্রকে প্রতিহত করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এ ছাড়া স্থপতি আইন প্রণয়ন করতে হবে।
৯. বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউট সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থা এবং জনগণের সঙ্গে যুগপৎভাবে কাজ করতে আগ্রহী যেন এই মর্মান্তিক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পুনরাবৃত্তি না ঘটে। এ লক্ষ্যে ইনস্টিটিউট যে কোনো ধরনের ভবনের অগ্নিনিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে জনসেবামূলক পরামর্শ প্রদানের জন্য একটি হেল্পডেস্ক খোলার উদ্যোগ নিয়েছে। ভবনের মালিকগণ এই হেল্পডেস্ক থেকে ইনস্টিটিউটের কাছ থেকে প্রাথমিক পরামর্শ গ্রহণ করতে পারবেন।
সংবাদ সম্মেলনে তারা সকলের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, যথাযথ নিয়মানুযায়ী ভবন নির্মাণ ও ব্যবস্থাপনা করে ভবিষ্যতে এই জাতীয় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা রোধে সকলে সচেষ্ট থাকবেন।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউট পূর্বে পুরান ঢাকার চুড়িহাট্টা ও বনানী এফ আর টাওয়ারের অগ্নিকাণ্ড নিয়েও প্রতিক্রিয়া জানাতে অনুরূপ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেছিল। বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউট ভবন নির্মাণের জন্য প্রণীত ‘ইমারত নির্মাণ বিধিমালা ২০০৮’ ও ‘বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড ২০২০’ প্রণয়নের কার্যক্রমের অন্যতম সক্রিয় অংশীজন এবং বর্তমান ‘ড্যাপ ২২-৩৫’ এর প্রয়োজনীয় সংস্কারে সচেষ্ট।
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্তির মহাকাব্য : রাষ্ট্রপতি
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।