বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ডেস্ক : অনলাইনে হ্যাকিংয়ের মতো ঘটনা সচরাচরই ঘটে। তবে, ইন্টারনেট অপরাধে নতুন এক মাত্রা যোগ করে দিতে পারে যুগান্তকারী কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি।
ভবিষ্যতে এআই’র মাধ্যমে কী ধরনের অপরাধ ঘটতে পারে, সেটি বিশ্লেষণের চেষ্টা করেছে স্কাই নিউজ। ওই নিবন্ধের দ্বিতীয় অংশের আলোচনা অনলাইনে পরিচালিত অপরাধ নিয়ে।
ছদ্মবেশ ও মুক্তিপণ জালিয়াতি
“মা কিছু লোক আমাকে জিম্মি করে রেখেছে। আমাকে বাঁচাও।” –এক অপরিচিত নাম্বার থেকে আসা কল ধরার পর নিজের ১৫ বছর বয়সী মেয়ের কান্নার আওয়াজ শুনতে পান জেনিফার ডিস্টেফানো। এ ছাড়া, ১০ লাখ ডলারের মুক্তিপণও দাবি করেন ওই অপরিচিত লোকটি। পরবর্তীতে, সেটা ৫০ হাজার ডলারে কমিয়ে আনেন ডিস্টেফানো।
তার মেয়ে অবশ্য নিরাপদ ছিলেন, কারণ তার মেয়ে আসলে অপহরণের শিকার হননি। আর সম্প্রতি মানবাধিকার ও আইন বিষয়ক ‘সিনেট জুডিশিয়ারি সাবকমিটি’র কাছে সাক্ষ্য দেন ডিস্টেফানো। এতে তিনি বলেন, ওই কল জালিয়াতিতে এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করে তার মেয়ের কণ্ঠস্বর নকল করা হয়েছে।
সম্প্রতি অনলাইনে এমন এক এআই চ্যাটবটের নমুনা দেখা গেছে, যার মাধ্যমে ‘যে কেউকে যে কোনো উদ্দেশ্যে কল করা’ যায়। এতেও একই ধরনের ফলাফল দেখা গেছে।
“তোমার সন্তান এখন আমার কাছে … তাকে ফিরে পেতে চাইলে ১০ লাখ ডলার পাঠিয়ে দাও। বিষয়টা কি পরিষ্কার করে বোঝানো গেছে?” –শিকার ব্যক্তিকে বলেছে চ্যাটবটটি।
“অবিশ্বাস্য!” –বলেছেন ২০২০ সালে ‘ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন (ইউসিএল)’ – এর ‘ডস সেন্টার ফর ফিউচার ক্রাইম’ বিভাগের অধ্যাপক লুইজ গ্রিফিন। এই বিভাগ থেকেই প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির সম্ভাব্য অপব্যবহারগুলোও তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। অধ্যাপক গ্রিফিন ছিলেন ওই গবেষণার সহ-লেখক।
“আমাদের তালিকায় শীর্ষে ছিল কণ্ঠস্বর বা চেহারা নকল করে করা অপরাধ – যেটি এখন সত্যিসত্যিই ঘটছে।”
তিনি আরও যোগ করেন, তবে, এই ধরনের অপরাধ যতোটা দ্রুত বিস্তার লাভ করবে বলে ধারণা ছিল, এটি ‘তার চেয়ে দ্রুতগতিতে’ বাড়তে দেখা যাচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, ‘কম্পিউটারাইজড’ কণ্ঠস্বর ব্যবহারের নমুনা মিললেও সত্যিকারের কণ্ঠস্বর বা চেহারার নকলের প্রযুক্তি “এখন পর্যন্ত দেখা যায়নি”। তবে, তিনি বলেন, “সেটি বেশি দূরেও নয়”।
গ্রিফিন ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, দুই বছরের মধ্যেই এই ধরনের প্রযুক্তি ‘আর বাক্সে বন্দী থাকবে না’।
“পরিবারের কোনো সদস্যের ছদ্মবেশ ধারণে এটা যথেষ্ট কার্যকর হবে কি না, তা অবশ্য আমি জানি না।” –বলেন তিনি।
তবে, পত্রিকার প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, ২০১৯ সালে এআইয়ের মাধ্যমে তৈরি করা নিজের বসের কণ্ঠস্বর শুনে জালিয়াতদের অ্যাকাউন্টে দুই লাখ ২০ হাজার পাউন্ড পাঠিয়েছিলেন যুক্তরাজ্যভিত্তিক এক এনার্জি কোম্পানির প্রধান নির্বাহী।
গ্রিফিন বলেন, এই ধরনের জালিয়াতির ক্ষেত্রে ভিডিও ব্যবহৃত হলে তা আরও বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে। এমনকি গুপ্তচরবৃত্তির জন্যেও এই প্রযুক্তি ব্যবহৃত হতে পারে। উদাহরণ হিসেবে ধরা যায়, জুম ভিডিও কলে পরিচালিত কোনো মিটিংয়ে তেমন কিছু না বলেই কোম্পানির কর্মীর ছদ্মবেশে তথ্য হাতিয়ে নেওয়া।
তিনি আরও বলেন, পরিকল্পিত কল জালিয়াতির মাত্রা বেড়ে যেতে পারে। আর চ্যাটবটে স্থানীয় ভাষার উচ্চারণ ব্যবহৃত হলে সেটি এখন অন্য দেশ থেকে পরিচালিত কল জালিয়াতির চেয়েও কার্যকরী উপায়ে কাজ করবে।
ডিপফেইক ও ব্ল্যাকমেইল চক্রান্ত
“তারা এখনই এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে কাল্পনিক কোনো শিশুর ওপর নিপীড়ন চালানোর মতো ভয়াবহ দৃশ্য তৈরি করতে পারে।” –কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির মাধ্যমে শিশু নিপীড়করা এরইমধ্যে অনলাইনে ভুয়া ছবি তৈরি করছে।
“এইসব লোকজন এআই প্রযুক্তি থেকে এতটাই উৎসাহ পাচ্ছে যে তারা এর পুরো সুবিধা নিচ্ছে। খুবই অস্বস্তিকর।”
ভবিষ্যতে ডিপফেইক ছবি বা ভিডিও ব্যবহার করে ব্ল্যাকমেইলের মতো ঘটনাও ঘটতে পারে বলে প্রতিবেদনে লিখেছে স্কাই।
“কোনো পর্ন ভিডিওতে ভিন্ন কারও চেহারা বসানোর সক্ষমতা এরইমধ্যে অনেক উন্নত হয়েছে। আগামীতে এটা আরও নিখুঁত হবে।” –বলেন অধ্যাপক গ্রিফিন।
“একবার ভেবে দেখুন, কোনো মা-বাবাকে তার শিশুর আপত্তিকর ভিডিও পাঠিয়ে কেউ যদি বলে, ‘আমার কাছে এই ভিডিও আছে, আমি এটা ফাঁস করে দেব’?”
শিল্প জালিয়াতি ও বিশাল অর্থ চুরি?
গ্রিফিন বলেন, চ্যাটজিপিটির মতো বিভিন্ন লার্জ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেলে এমন টুল আছে, যার মাধ্যমে অপরাধীরা ‘একগাদা নতুন অপরাধ’ ঘটাতে পারে। উদাহরণ হিসেবে ধরা যায়, এর ‘একজন বুদ্ধিমান ব্যক্তির মতো’ বিভিন্ন ওয়েবসাইটে গিয়ে অ্যাকাউন্ট তৈরি, ফর্ম পূরণ ও পণ্য কেনাকাটার সক্ষমতা।
“আপনার ‘সব ফরমায়েশ’ শুনবে, কেউ যদি এমন সিস্টেম পেয়ে যায়, তবে তা প্রতারণার জন্য ব্যবহৃত হতে পারে।” –বলেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, এই প্রযুক্তির মাধ্যমে ঋণ জালিয়াতি, স্বল্পমেয়াদী বিনিয়োগকারীর ছদ্মবেশে পণ্যের দামে হেরফের ঘটানো বা ‘ডিডিওস’ ধরনের সাইবার আক্রমণের ঝুঁকি রয়েছে।
এমনকি চ্যাটবটের সাহায্যে বিভিন্ন প্রযুক্তিগত ব্যবস্থায় হ্যাকিংও চালানো সম্ভব।
“এর মাধ্যমে আপনি অনেক ব্যক্তির ওয়েবক্যাম, বা ডোরবেলে থাকা ক্যামেরায় প্রবেশাধিকার পেয়ে তাদের নিয়ে হাজার হাজার তথ্য সংগ্রহ করতে পারেন। এমনকি তারা কখন বাড়ি থেকে বের হন, সেটাও বলতে পারবেন।”
এআইয়ের মাধ্যমে ভারমির বা রেমব্র্যান্টড ধাঁচের পেইন্টিং তৈরি করা গেলেও এরইমধ্যে এমন দক্ষ মানুষ আছে, যারা এই ধরনের কাজ করে থাকে। গ্রিফিনের মতে, সবচেয়ে জটিল বিষয় হবে, শিল্প জগৎকে বিশ্বাস করানো যে কোন কাজটি আসল।
“এই প্রযুক্তি প্রচলিত অপরাধ বদলে দেবে, তা আমি মনে করি না।”
তিনি আরও যুক্তি দেখান, ২০১৫ সালে পরিচালিত লন্ডনের হাটন গার্ডেনের মতো ‘চোখ ধাধানো’ ডাকাতি ঘটানোর বেলায় এআই প্রযুক্তির তেমন ব্যবহার নাও দেখা যেতে পারে।
“তাদের দক্ষতা প্লামারদের মতো। আর রোবটের মাধ্যমে তাদের কাজ কেড়ে নেওয়ার ঝুঁকিও সবচেয়ে কম। তাই কম্পিউটার প্রোগ্রামার নয়, নিরাপদ একজন ক্র্যাকার হোন।” –রসিকতা করে বলেন তিনি।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।