জুমবাংলা ডেস্ক : রুপালী ইলিশ, যার স্বাদ, আকৃতি এবং দাম বাংলাদেশে নিয়মিত আলোচনার বিষয়। বিশেষ করে বৃষ্টির মৌসুম এবং দুর্গা পূজার সময়। ক্রেতারা বলছেন, এই প্রিয় মাছটি আগের চেয়ে এবারে বেশ চড়া দামেই কিনতে হচ্ছে।
ঢাকার মিরপুরের বাসিন্দা, একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের রিসেপশনিস্ট মৌসুমি আক্তার বলছেন, “বৃষ্টি হলে ইলিশ খিচুড়ি – এটা আমার বাসায় সবার পছন্দ। কিন্তু গত দুই মাসে সাধের এই জিনিশ রান্না করেছি মাত্র দু’বার। বাজারে এক কেজি ওজনের মাছের যা দাম দেখি তা কেনার সাহস হয় না।”
যেমন দামে বিক্রি হচ্ছে
ইলিশের ভরা মৌসুম জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর মাস। পাঁচশ গ্রাম থেকে এক কেজি ওজনের ইলিশ মাছ এই আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে ৯০০ টাকা থেকে ১,০০০ টাকা দামে বিক্রি হয়েছে।
গত বছর একই সময় একই আকৃতির ইলিশের দাম ছিল সাড়ে ছয়শ থেকে সাড়ে সাতশ টাকা। এমন তথ্য দিচ্ছে ভোক্তাদের অধিকার নিয়ে কাজ করে এমন সংগঠন কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ। বারশ থেকে চোদ্দশ টাকার বেশি পড়ছে এক কেজি বা তার বেশি ওজনের ইলিশের দাম।
অনাবৃষ্টি, সমুদ্রে নিম্নচাপ
এই বছর মৌসুমের শুরুতে বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় জেলেরা ধারণা করেছিলেন এবার তারা খুব একটা মাছ পাবেন না। তবে জুলাইয়ের শেষে ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ার পর গত বছরের একই সময়ের তুলনায় এবছর মৌসুমের শুরুতে অনেক বেশি ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে বলে খবর আসছিল।
কিন্তু পরের দিকে চিত্র কিছুটা বদলে গেছে বলে ধারণা দিয়েছেন চাঁদপুর ভিত্তিক আড়তদারেরা।
জেলার মাছঘাটে একটি আড়তের মালিক মো. গিয়াস উদ্দিন খান বলছেন, “সাধারণত জোয়ারের সময় ইলিশ মাছ বেশি পাওয়া যায়। এই বছর যখনই জোয়ারের সময় এসেছে তখন সমুদ্রে একবার করে নিম্নচাপ হয়েছে। সেসময় সিগনালের কারণে জেলেরা মাছ ধরা ট্রলার নিয়ে যেতে পারেনি।
“মৌসুমের মাঝামাঝি সময় থেকে বেশ কয়েকবার এটা হয়েছে। সেই কারণে যখন মাছ ধরা সম্ভব হয়েছে তখন দাম একটু বেশি হয়েছে।”
তিনি আরও বলছেন, মৌসুমের একটা বড় সময় এবছর কম বৃষ্টি হয়েছে। যে কারণে চাঁদপুর ও তার আশপাশে নদীতে পানির প্রবাহ কম ছিল। যার ফলে প্রজননের জন্য ইলিশ মাছ সমুদ্র থেকে তার বিচরণ ক্ষেত্র পর্যন্ত পর্যাপ্ত সংখ্যায় পৌঁছাতে পারেনি বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ইলিশ মাছ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগে প্রধান অধ্যাপক নিয়ামুল নাসের। তিনি বলছেন, ইলিশ মাছের প্রজননে জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাব রয়েছে।
“আমরা ইলিশ সংরক্ষণে নদীতে নিষেধাজ্ঞা দিচ্ছি, তাতে অনেক লাভও হয়েছে কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ইলিশের জন্য একটা বড় বিষয় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ইলিশ মাছ এখন ভিন্ন রকম পরিবেশ পাচ্ছে যা তারা আগে পেত না। কয়েকদিন পরপর যে নিম্নচাপ হচ্ছে তাতে পানির বিক্রিয়া, মিষ্টি পানির প্রবাহ, পানির তাপমাত্রায় পরিবর্তন, পানিতে তাদের যে খাবার জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এগুলোতে একটু একটু করে পরিবর্তন হচ্ছে। এতে তার প্রজনন প্রভাবিত হচ্ছে।”
ড্রেজিং ও বিচরণ ক্ষেত্রের ক্ষতি
গিয়াস উদ্দিন বলছেন, “চাঁদপুর সদর উপজেলার রাজরাজেশ্বর, শরিয়তপুরের রাতাবুনিয়া থেকে সুরেশ্বর এই জায়গা ইলিশের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সেখানে কিছুদিন যাবত নদীতে বালু উত্তোলনে খুব অপরিকল্পিতভাবে ড্রেজিং চলছে। মাছের জন্য জায়গাটা নিরাপদ নেই। তাই সেখানে মাছ কম।”
এই বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে ইলিশের বিচরণ ক্ষেত্র নিরাপদ করতে চাঁদপুরে মেঘনা নদীতে ড্রেজার দিয়ে অপরিকল্পিত বালু উত্তোলন বন্ধ করতে চিঠি দিয়েছিল বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউট।
সেই চিঠিতে বলা হয়েছিল, মেঘনা নদীতে অনিয়ন্ত্রিত বালু উত্তোলনের কারণে ইলিশের প্রধান প্রজনন মৌসুমে চাঁদপুর অংশে ইলিশের প্রজনন ও বিচরণ কাছাকাছি সময়ে হ্রাস পেয়েছে।
ড্রেজারের ব্যবহৃত মোবিল ও তেলের কারণে এবং প্রপেলারের আঘাতে মাছের খাদ্য নষ্ট হচ্ছে। চাঁদপুর জেলা প্রশাসন থেকে সেসময় ড্রেজিং বন্ধের আদেশ দিয়েছিল।
জ্বালানি তেলের দাম
মুনশিগঞ্জের লৌহজং উপজেলার জেলে মধু মালো জানিয়েছেন, সম্প্রতি জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির কারণে মাছ ধরার খরচ বেশ বেড়েছে।
“আমার ভাইয়ের একটা ট্রলার আছে। আমরা সেটাতে ইলিশ ধরি। নদীর ভেতরে দুই আড়াই মাইল দুরে যেতে হয়। আগে দিনে সর্বোচ্চ এক হাজার টাকার ডিজেল লাগতো। এখন লিটারে চৌত্রিশ টাকা বেশি দিতে হয়। এখন দিনে বারোশ থেকে পনেরশ টাকা পড়ে যাচ্ছে ডিজেলের খরচ।
ইলিশ ধরার মৌসুম শুরুর পরপরই অগাস্ট মাসের শুরুতে জ্বালানি তেলের বর্ধিত দাম কার্যকর হয়েছে। জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে মাছ ধরা ট্রলারের খরচ ছাড়াও বেড়েছে ইলিশ মাছের পরিবহন খরচ। যার প্রভাব পড়েছে ইলিশের দামে।
ফেসবুকে বিক্রি
ফেসবুকে বিক্রির কারণে ইলিশের চাহিদা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে যার ফলে বেড়েছে দাম, বলছিলেন আড়তদার মোঃ গিয়াস উদ্দিন খান।
“এখন ফেসবুকে অনেক ইলিশ বিক্রি হচ্ছে। যে কারণে সারা দেশে সব জায়গায় মাছ পৌঁছে যাচ্ছে। ফেসবুকে বিক্রির জন্য অনেকে আমার কাছ থেকে প্রচুর ইলিশ কেনে। চাহিদা বাড়লে দাম বাড়বেই,” বলছিলেন তিনি।
ফেসবুকে ইলিশ লিখে সার্চ দিতেই এরকম বহু পেজ চলে এলো যার কোন কোনটাতে তিরিশ চল্লিশ হাজার ফলোয়ার রয়েছে। ফেসবুকে ইলিশ বিক্রির কারণে জনপ্রিয় মাছটি ঘরে বসেই পাওয়া গেলেও দাম বাড়িয়ে দিয়েছে এই সহজলভ্যতা।
সূত্র: বিবিসি বাংলা
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।