উজ্জ্বল সবুজ রঙের সূক্ষ্ম গুঁড়ো চা ম্যাচা শুধু সোশ্যাল মিডিয়ার ছবিকে সুন্দর করছে না, বরং স্বাস্থ্যসচেতনদের কাপে জায়গা করে নিচ্ছে দ্রুত। জাপানের প্রাচীন চা-সংস্কৃতি থেকে শুরু করে আধুনিক কফি শপের মেন্যু, প্রতিটি স্থানে ম্যাচা এখন এক বিশেষ তারকা। এটি কেবল স্বাস্থ্যকর এনার্জি বুস্টার নয়, বরং রান্নাঘরে বহুমুখি ব্যবহার এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় স্টাইলিশ ক্রেজের কারণে আন্তর্জাতিকভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
ম্যাচার সূচনা: ম্যাচার যাত্রা শুরু প্রায় ৮০০ বছর আগে। ধারণা করা হয়, ১২০০ সালের দিকে জেন বৌদ্ধ ভিক্ষু ‘এইসাই’ চীন থেকে পাউডার চা জাপানে নিয়ে আসেন। ধীরে ধীরে এটি ‘চানোয়ু’ বা জাপানি চা অনুষ্ঠানের মূল উপাদান হয়ে ওঠে যেখানে ধ্যান, আতিথেয়তা এবং ‘ওয়াবি-সাবি’ অর্থাৎ সরলতার সৌন্দর্য উদযাপন করা হয়। ১৫০০ সালের দিকে চা গুরু ‘সেন নো রিকিউ’ এর প্রস্তুত প্রক্রিয়াকে আরও নিখুঁত ও সুষম করে তোলেন। আজও ম্যাচার প্রতিটি চুমুক জাপানের ঐতিহ্যের সাথে যুক্ত করে রাখে পানকারীকে।
ম্যাচার স্বাস্থ্যগুণ: সবুজ রঙের জন্যই নয়, স্বাস্থ্যগুণের কারণেও ম্যাচার জনপ্রিয়তা এখন তুঙ্গে। সাধারণ গ্রিন টিতে চা-পাতা ভিজিয়ে রেখে ফেলে দেওয়া হয়, কিন্তু ম্যাচায় মিহি গুঁড়ো করা পুরো পাতা পান করা হয়। তাই প্রতিটি চুমুকেই মেলে বাড়তি উপকারিতা বিশেষ করে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট। গবেষণা বলছে, এক কাপ ম্যাচায় থাকে সাধারণ গ্রিন টির তুলনায় প্রায় তিনগুণ বেশি ক্যাটেচিন যা ক্ষতিকর ‘ফ্রি র্যাডিক্যাল’ নিষ্ক্রিয় করে শরীরকে সুরক্ষা দেয়। এটি হৃদ্স্বাস্থ্য রক্ষা, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ ও ‘খারাপ’ এলডিএল কোলেস্টেরল কমাতেও সহায়ক বলে মনে করা হয়।
ম্যাচা শুধু স্বাস্থ্যকর নয়, এটি এক স্মার্ট এনার্জি বুস্টারও। এতে রয়েছে ক্যাফেইন, তবে আছে এল-থিয়ানিন নামের অ্যামাইনো অ্যাসিড, যা মনোসংযোগ ও শান্ত ভাব জাগায়। ফলে কফির মতো হঠাৎ চনমনে হয়ে আবার ক্লান্তি নেমে আসে না বরং সারা দিন মেলে স্থির ও মসৃণ শক্তি। এ ছাড়া ম্যাচা বিপাকক্রিয়া বাড়াতে ও শরীর থেকে টক্সিন দূর করতেও সাহায্য করে। এর ক্লোরোফিল লিভারের কার্যকারিতা বাড়ায় এবং শরীরকে ভেতর থেকে সতেজ রাখে। তাই অনেকেই বলেন, এক কাপ ম্যাচা যেন দিনের শুরুতে এক টুকরো প্রাণশক্তি ও সতেজতার প্রতিশ্রুতি।
ম্যাচা বনাম সকালের অন্যান্য পানীয়: সবুজ চায়ের তুলনায় পুষ্টিগুণে ম্যাচা এগিয়ে। সাধারণ গ্রিন টি-তে শুধু পাতা ভিজিয়ে তার নির্যাস পান করা হয়, কিন্তু ম্যাচায় পুরো পাতা গুঁড়া করে খাওয়া হয়। তাই এতে মেলে বেশি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও ভিটামিন। গবেষণা বলছে, ম্যাচায় গ্রিন টির তুলনায় তিন গুণ বেশি ‘ক্যাটেচিন’ থাকতে পারে যা শরীরের ক্ষতিকর ফ্রি র্যাডিকেল প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা রাখে।
কফির সঙ্গে তুলনায় ম্যাচার বিশেষত্ব আলাদা। কফি দ্রুত ক্যাফেইনের ধাক্কা দেয়, কিন্তু ম্যাচা দেয় ধীর, দীর্ঘস্থায়ী এনার্জি। অনেকে বলেন, কফির মতো হঠাৎ শক্তি বাড়া-কমার ঝুঁকি নেই ম্যাচায়। তাছাড়া এতে থাকে এল-থিয়ানিন নামের এক ধরনের অ্যামিনো অ্যাসিড, যা মনোযোগ ও শান্তি বাড়ায় যা কফিতে নেই। এজন্যই অনেকে এখন ম্যাচাকে ‘কফির স্বাস্থ্যকর বিকল্প’ হিসেবে দেখছেন।
সোশ্যাল মিডিয়ায় ম্যাচা ক্রেজ: গাঢ় সবুজ রং আর ফেনাযুক্ত টেক্সচারের জন্য ম্যাচা এখন সোশ্যাল মিডিয়ার প্রিয় তারকা। শুধু ইনস্টাগ্রামেই #matcha হ্যাশট্যাগে মিলিয়ন মিলিয়ন পোস্ট। স্টাইলিশ লাটে বা উজ্জ্বল স্মুদি বোল সব জায়গায়ই ম্যাচার উপস্থিতি এখন চোখে পড়ার মতো। ট্রেন্ডি ক্যাফেগুলোতে এখন আলাদা ম্যাচা মেনু। লেয়ারড লাটে, রঙিন ফ্রাপে, আইসড ড্রিঙ্ক সবই যেন ক্যামেরাবন্দি হওয়ার অপেক্ষায়। মৌসুমি ফ্লেভার যেমন স্ট্রবেরি ম্যাচা বা ভ্যানিলা ম্যাচা মুহূর্তেই ভাইরাল হয়ে যায়। এমনকি বড় আন্তর্জাতিক চেইনগুলোও এখন ম্যাচা যোগ করেছে তাদের মেনুতে। ক্রেজ শুধু পানীয়তে সীমাবদ্ধ নয়; ম্যাচা কুকিজ, কেক, আইসক্রিম, প্যানকেক সবই এখন জনপ্রিয় তালিকায়। অনেকেই ঘরে বসে এসব রেসিপি বানিয়ে ছবি শেয়ার করছেন সোশ্যাল মিডিয়ায়।
ম্যাচার জনপ্রিয়তার বড় কারণ এর বহুমুখিতা। ক্লাসিক পদ্ধতিতে এটি খাওয়া হয় ম্যাচা লাটে আকারে গরম বা ঠান্ডা, দুধ কিংবা ডেইরি-ফ্রি বিকল্প দিয়ে। ম্যাচা স্মুদি, কলা ব্লেন্ড, এমনকি আইস ক্যাপুচিনোও সহজেই তৈরি করা যায়। ছবি: এআই দিয়ে তৈরি
রান্নাঘরে ম্যাচা: রেসিপি ও নানা পণ্য
ম্যাচার জনপ্রিয়তার বড় কারণ এর বহুমুখিতা। ক্লাসিক পদ্ধতিতে এটি খাওয়া হয় ম্যাচা লাটে আকারে গরম বা ঠান্ডা, দুধ কিংবা ডেইরি-ফ্রি বিকল্প দিয়ে। ম্যাচা স্মুদি, কলা ব্লেন্ড, এমনকি আইস ক্যাপুচিনোও সহজেই তৈরি করা যায়। অনেকেই আবার এনার্জি বল, প্রোটিন প্যানকেক বা ওটমিলে ম্যাচা মিশিয়ে নেন। ডেসার্টে ম্যাচা যোগ করে রঙ আর স্বাদের এক নতুন মাত্রা। গ্রিন টি চিজকেক, কাপকেক, ম্যাচা মোচি কিংবা ম্যাচা টিরামিসুর মতো পদ এখন ক্যাফে ও অনলাইন রেসিপি ভিডিওতে বেশ জনপ্রিয়। কেউ কেউ আবার ম্যাচা মিশিয়ে তৈরি করছেন মকটেল বা সোডা ড্রিঙ্ক, যা দেয় এক সতেজ স্বাদ।
বাজারে সাধারণত ম্যাচার দুটি ধরন পাওয়া যায় সেরিমোনিয়াল গ্রেড ও কালিনারি গ্রেড। সেরিমোনিয়াল গ্রেড ম্যাচা তৈরি হয় কচি চা পাতার গুঁড়ো থেকে, স্বাদ মিষ্টি ও মসৃণ, যা সরাসরি পান করা বা লাটেতে উপভোগের জন্য আদর্শ। কালিনারি গ্রেড ম্যাচা তৈরি হয় তুলনামূলক পুরোনো পাতা থেকে, স্বাদে কিছুটা তেঁতো, যা রান্না বা বেকিংয়ের জন্য বেশি উপযুক্ত। এ ছাড়া দোকানে এখন নানা ম্যাচা পণ্য মিলছে রেডি-টু-ড্রিঙ্ক ম্যাচা লাটে, ইনস্ট্যান্ট ম্যাচা স্যাশে, ম্যাচা এনার্জি বার, চকলেট, এমনকি স্কিনকেয়ার পণ্যও। যারা খাঁটি স্বাদ পছন্দ করেন, তাঁদের জন্য সেরিমোনিয়াল ম্যাচা; আর যারা রান্না বা নিত্য পানীয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে চান, তাঁদের জন্য কালিনারি ম্যাচা।
এ বছরের সেরা ক্যামেরা ফোন, কোনটি আপনার জন্য পারফেক্ট দেখে নিন
ম্যাচা শুধুই একটি পানীয় নয় এটি ঐতিহ্য, স্বাস্থ্য এবং আধুনিকতার মিশ্রণ। কফির বিকল্প, গ্রিন টির উন্নত সংস্করণ এবং রং, স্বাদ ও উপকারিতার এক অনন্য উৎসব। আজকের দ্রুতগতির জীবনে, ম্যাচার প্রতিটি চুমুক আমাদের ধীর হতে, উপভোগ করতে এবং একইসাথে সুস্থ থাকতে স্মরণ করিয়ে দেয়।
সূত্র: টাইমস অব ইন্ডিয়া
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।