জুমবাংলা ডেস্ক : বাবার হইলো আবার জ্বর, সারিলো ঔষধে (বাবর-হুমায়ুন-আকবর-জাহাঙ্গীর-শাহজাহান-আওরঙ্গজেব), মুঘল সাম্রাজ্যের মূল ধারা মনে রাখতে এই বাক্যটি বেশ প্রচলিত। খবর বিবিসি বাংলা
ভারতীয় উপমহাদেশের বৃহৎ ও জৌলুশময় সাম্রাজ্যের একটি হচ্ছে মুঘল আমল। এর বিস্তৃতি ছিল বর্তমান আফগানিস্তান থেকে শুরু করে পাকিস্তান, ভারত ও বাংলাদেশে।
বাংলাদেশ অংশে এখনও সেই সময়কার বেশ কিছু স্থাপত্যের নিদর্শন রয়ে গেছে, যেগুলো এ অঞ্চলে মুঘল আমল সম্পর্কে ধারণা দেয়।
মুঘল স্থাপত্যের বৈশিষ্ট্য
বাংলায় মুসলিম স্থাপত্যের সূচনা হয়েছিল সুলতানি আমলে ত্রয়োদশ শতাব্দীতে। তবে মুঘল আমলে এসে এর আগেকার বৈশিষ্ট্যে অনেকটাই পরিবর্তন আসে।
যদিও বাংলায় মুঘল স্থাপত্যের মধ্যে একদিকে যেমন দিল্লি, আগ্রার স্থাপত্যের বৈশিষ্ট্য দেখা যায়, একই সাথে দেখা যায় আগেকার সুলতানি আমল এবং এই অঞ্চলের স্থানীয় বৈশিষ্ট্যেরও কিছুটা সংমিশ্রণ।
এসব বৈশিষ্ট্যের মধ্যে রয়েছে আয়তাকার কক্ষ, দেয়ালে প্লাস্টার যেটা সুলতানি আমলে ছিল না। এছাড়া একাধিক গম্বুজের মধ্যে মাঝেরটা বড় আকারের, ধনুকাকৃতির খিলান, জাঁকালো বহির্ভাগ বা আর্চওয়ে, এমনটাই উল্লেখ করছিলেন লেখক ও ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন।
তবে অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, বাংলার স্থাপত্যগুলো আগ্রা, দিল্লি বা ফতেহপুর সিক্রির মতো ততটা মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু না হওয়ায় এগুলোতে একই ধরণের বৈশিষ্ট্য বা সৃজনশীলতার জায়গা একটু কম।
তবে এখানে ভিন্ন ধরণের ‘অদ্ভুত আকর্ষণ’ রয়েছে, যেমনটা বলা হচ্ছে ড. সৈয়দ মাহমুদ হাসানের ‘মুসলিম মনুমেন্টস অফ বাংলাদেশ’ বইটিতে।
বাংলায় যেভাবে এসেছিল মুঘলরা
ভারতীয় উপমহাদেশে মুঘল রাজত্বের সূচনা হয়েছিল জহিরুদ্দিন মুহম্মদ বাবরের হাত ধরে, যিনি মূলত বর্তমান উজবেকিস্তান থেকে আফগানিস্তান, এরপর ভারতবর্ষে আসেন।
তবে বাংলা অঞ্চলে মুঘল রাজ্যের সূচনা হয় মুঘল সম্রাট আকবরের সময়, যার সময়কে মুঘল সাম্রাজ্যের সোনালি সময় হিসেবে দেখা হয়।
বলা হয়, বাংলা অঞ্চল ফসলি ও উর্বর হওয়ায় বিপুল রাজস্ব আদায় সম্ভব, এমন দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই বাংলায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চান সম্রাট আকবর।
বাংলাপিডিয়া বলছে, রাজা মানসিংহকে ১৫৯৪ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে বাংলার সুবাদার হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়, যিনি তিন মেয়াদে সুবাদারের দায়িত্ব পালন করেন। যদিও সেসময় মূল ঘাঁটি ছিল রাজমহলে (বর্তমান ভারত অংশ)।
তবে বাংলার পূর্ণাঙ্গ দখল বা বাংলাদেশের ঢাকা অংশের দিকে নজরটা আসে মূলত সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে।
ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন বলছিলেন “জাহাঙ্গীরের আমলে ইসলাম খাঁকে পাঠানো হয় একটা নতুন রাজধানী করার জন্য। ইসলাম খাঁ রাজমহল থেকে ঘুরে এসে মনে করেন যে রাজধানীর জন্য এটিই হবে গুরুত্বপূর্ণ। আমরা বলি যে ১৬১০ সালে মুঘল আমলে রাজধানী ঢাকার পত্তনটা হলো।”
মুঘল সাম্রাজ্যের প্রদেশকে সুবাহ্ বলা হতো। বিভিন্ন বই ও নিবন্ধে উল্লেখ করা হয় ১৬০৮ সালের দিকে ইসলাম খান চিশতীকে বাংলার সুবাদার নিযুক্ত করার পর তার রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কৌশল বাংলার জন্য বেশ কার্যকরভাবেই লক্ষ্য করা যায়।
তিনি ১৬১০ সালে ঢাকায় এসে এটিকে ‘জাহাঙ্গীরনগর’ নামকরণ করে রাজধানী ঘোষণা করেন।
সেসময় সুবাহ্ বাংলার রাজধানী রাজমহল থেকে ঢাকায় স্থানান্তর করা হয়। এরপর থেকেই বিভিন্ন ধরণের স্থাপত্য গড়ে তোলা হতে থাকে বাংলার এই অংশে।
ঢাকায় টিকে থাকা কিছু মুঘল স্থাপত্য
ঢাকাকে একসময় মসজিদের নগরী বলা হতো। মুঘল আমলেও বেশ অনেকগুলো মসজিদ তৈরি করা হয় বাংলায়। যেমন সাতগম্বুজ মসজিদ, হাজি খাজা শাহবাজ মসজিদ, লালবাগ কেল্লার মসজিদ, খান মোহাম্মদ মৃধা মসজিদ, ইত্যাদি।
আরও অনেক ধরণের মসজিদ থাকলেও নানা কারণে ক্ষতিগ্রস্ত বা বিভিন্নভাবে সংস্কারের ফলে আদি রূপ হারিয়েছে সেগুলো।
যেমন কারওয়ান বাজারে অবস্থিত ১৬৮০ সাল নাগাদ নির্মাণ করা খাজা আম্বর মসজিদ টিকে থাকলেও বিভিন্ন সময়ে সংস্কার ও সম্প্রসারণে এটি আর আগের রূপে নেই। প্রায় সবগুলো মসজিদেই এখনও নামাজ আদায় করেন মুসল্লিরা।
এসব মসজিদের রয়েছে নিজস্ব গল্পও। যেমন, মোটামুটি আদি অবয়ব টিকে থাকা পুরনো ঢাকার আতিশখানার খান মোহাম্মদ মৃধা বা মির্ধা মসজিদকে এলাকার মানুষজন অনেক ক্ষেত্রেই জ্বীনের মসজিদ হিসেবে চেনেন।
সে মসজিদের সহকারী ইমাম ও মুয়াজ্জিন ক্বারী মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলছিলেন “জ্বীন ছাড়া মসজিদ নাই, আমাদের মসজিদেও অনেক জ্বীন আছে, বিভিন্ন সুরতে তারা মানুষের সাক্ষাৎ করে, কিন্তু মানুষ বুঝতে পারে না।”
ধর্মীয় স্থাপনার বাইরে সমাধি, সরাইখানা, সেতু বা দুর্গও তৈরি করা হয়েছিল মুঘল আমলে। যেমন, সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য লালবাগ দুর্গ, যেটির নির্মাণকাজ ১৬৭৮ সালে শুরু করেন সম্রাট আওরঙ্গজেবের পুত্র মোহাম্মদ আজম।
সে সময় এর নাম দেয়া হয়েছিল কিলা আওরঙ্গবাদ। যদিও পিতা আওরঙ্গজেবের ডাকে তাকে দিল্লী ফিরে যেতে হয়। বাকি অংশের কাজ ধরেন তৎকালীন বাংলার সুবাদার শায়েস্তা খান, যার নাম মির্জা আবু তালিব হলেও সম্রাট জাহাঙ্গীর তাকে শায়েস্তা খান বা শায়েস্তা খাঁ উপাধি দেন।তবে দুর্গের কাজ শেষ পর্যন্ত অসম্পূর্ণ থেকে যায়।
দুর্গ সংক্রান্ত লিফলেটসহ বিভিন্ন জায়গায় উল্লেখ করা হয় ১৬৮৪ সালে শায়েস্তা খানের কন্যা পরি বিবির মৃত্যু হওয়ায় এই দুর্গকে অপয়া হিসেবে বিবেচনা করে নির্মাণকাজ বন্ধ করে দেয়া হয়।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আঞ্চলিক পরিচালক আফরোজা খান মিতা বলেন, “পরি বিবির মাজারটিই সম্ভবত সবশেষ সংযোজন লালবাগ কেল্লায়।আগ্রার তাজমহল এবং দিল্লিতে অবস্থিত হুমায়ুনের সমাধি বা মাজারের অনুসরণে শায়েস্তা খাঁ এটি তৈরি করিয়েছিলেন।”
পরীবিবির মাজারের যে স্থাপনাটি রয়েছে, তার আরেকটি কক্ষের কবর শায়েস্তা খাঁর আরেক কন্যা শমশদ বেগমের বলে উল্লেখ করা হয়। মাজার ছাড়াও তখন নির্মিত স্থাপত্যের মধ্যে রয়েছে দুর্গের অসমাপ্ত দক্ষিণপূর্ব তোরণ। এই তোরণের সাথে লাগোয়া রয়েছে কথিত গুপ্তপথ।
বাস্তব ভিত্তি না পাওয়া গেলেও জনশ্রুতি রয়েছে যে গুপ্তপথের মাধ্যমে বুড়িগঙ্গা নদীর তল দিয়ে নারায়ণগঞ্জে আরেক মুঘল স্থাপত্য সোনাকান্দা দুর্গের সাথে যোগাযোগ করা হতো।
সময়ের সাথে সাথে টিকে থাকা বিভিন্ন স্থাপত্য যেমন ক্ষয় বা পরিবর্তন হয়ে গেছে, কিছু ক্ষেত্রে অবশিষ্ট অংশও বিলীন হওয়ার পথে। এদের মধ্যে অন্যতম দুই সরাইখানা বড় কাটরা ও ছোট কাটরা।
বড় কাটরার দুটি শিলালিপি অনুযায়ী ১৬৪৩ থেকে ১৬৪৬ সালের মধ্যে নির্মাণকাজ শুরুর ধারণা পাওয়া যায়। যেটি ‘প্রকৃত ও যোগ্য কোনও ব্যক্তির কাছ থেকে ভাড়া নেয়া হবে না’ এমন শর্তে দফতর হিসেবে ব্যবহারের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল।
এখন এর অনেকটাই বিলীন হয়ে গেছে দখলদারদের কারণে। ভেতরটা ব্যবহার হচ্ছে মাদ্রাসা হিসেবে। আদি অবয়ব প্রায় বিলুপ্ত হওয়া ছোট কাটরার ভেতরে গেলেও দেখা যায়, সেখানে চলে খেলার সামগ্রী বানানোর কাজ। বিভিন্নভাবে চেষ্টা করেও এই স্থাপনাগুলো সংরক্ষণের জন্য নিতে পারেনি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর।
মুঘল সাম্রাজ্যের জৌলুসময় সময়
বাংলাদেশ অংশে মুঘল আমলের জৌলুশময় সময়টা ঠিক কেন্দ্রীয় শাসনের সাথে নির্ধারণ করা যায় না। মূলত ঢাকা রাজধানী হওয়ার সাথে সাথেই স্থাপত্যের বিকাশ নির্ভর করেছে।
“মুঘল আমলে যেটা হয়েছিল, একটা জাঁকালো শহর ছিল এতে কোনও সন্দেহ নেই। বাগান, নতুন স্থাপত্য, সবকিছু মিলে,” বলছিলেন মুনতাসীর মামুন।
তিনি আরও উল্লেখ করেন যে মুঘলরা মোটামুটি একটা শৃঙ্খলাপূর্ণ অবস্থায় এখানে বসবাস করে গেছেন এবং তখন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে মানুষ ভাগ্যান্বেষণে ঢাকায় এসেছে। এর মাঝে সবচেয়ে ঐশ্বর্যময় সময় হিসেবে সুবাদার শায়েস্তা খা’র আমলকেই উল্লেখ করেন আফরোজা খান মিতা।
মূলত চট্টগ্রাম জয়, পাহাড়ি রাজ্যের বিদ্রোহ দমন, ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নয়ন, বিভিন্ন স্থাপত্য নির্মাণ, ন্যায়বিচার, জনকল্যাণ, শস্যের কম মূল্য, এমন নানা কারণে প্রসিদ্ধ ছিলেন শায়েস্তা খাঁ।
তিনি ১৬৬৪ থেকে ১৬৮৮ সালের মধ্যে এক বছরের একটু বেশি সময় বিরতিসহ দীর্ঘ ২৪ বছর সুবাদার ছিলেন। তবে মুঘল সাম্রাজ্যের স্থায়িত্বকাল ২০০ বছরের মতো হলেও ঢাকার সেই সমৃদ্ধির সময়টা ১০০ বছরেরও কম সময়। কারণ ১৭১৭ সালের পর ঢাকা থেকে রাজধানী সরিয়ে মুর্শিদাবাদে নিয়ে যাওয়া হয়।
আর এর সাথেই ঢাকার দিক থেকে নজর সরে যেতে থাকে মুঘলদের। আর এভাবেই এই অংশে একরকম সমাপ্তি ঘটে মুঘল রাজত্বের। বর্তমানে যেসব নিদর্শন অবশিষ্ট রয়েছে সেগুলো সংরক্ষণের ক্ষেত্রেও কিছুটা ক্ষোভ প্রকাশ করেন মুনতাসীর মামুন।
“প্রতিটি শহরে আমরা যাই সংস্কৃতির নিদর্শনের জন্য, সংস্কৃতির খোঁজে যেটার খুব অভাব,” বলছিলেন তিনি। তার মতে, নতুন নতুন স্থাপনার চেয়ে পুরনো সব স্থাপত্য বা সংস্কৃতিই হতে পারতো ঢাকায় পর্যটন আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।