জুমবাংলা ডেস্ক : পাবনার ঈশ্বরদী বেনারসি তাঁত শিল্পের ইতিহাস প্রায় শত বছরের। ব্রিটিশ শাসনামলে ঈশ্বরদী পৌর শহরের ফতেহ মোহাম্মদপুর এলাকায় বসতি গড়ে তোলেন ভারতের উত্তর প্রদেশের বেনারসি কারিগররা।
বসতি স্থাপনের পর কারিগররা ফতেহ মোহাম্মদপুর এলাকায় বেনারসি-কাতানসহ অভিজাত শাড়ি বুননের কাজ শুরু করেন। নানা সংকট ও সমস্যার মধ্যেও বর্তমানে প্রায় দুই শতাধিক বেনারসি তাঁতি তাদের পূর্বপুরুষদের এ পেশা ধরে রেখেছেন। ঈশ্বরদীর বেনারসি তাঁত শিল্পকে আরও আধুনিক ও যুগোপযোগী করে গড়ে তুলতে সরকারি বরাদ্দে ফতেহ মোহাম্মদপুর এলাকায় গড়ে তোলেন বেনারসি পল্লী। তবে সেটিও এখন বন্ধের পথে।
সুতা, চুমকিসহ তাঁত সামগ্রীর দাম বৃদ্ধি ও ভারতীয় বেনারসিতে দেশীয় বাজার সয়লাবসহ নানা প্রতিবন্ধকতায় প্রতিষ্ঠার ২০ বছরেও পূর্ণতা পায়নি এ বেনারসি পল্লী। পল্লীর বিশাল এলাকা কেবল ঝোপঝাড় ও জঙ্গলে ভরে উঠেছে। পেশা বদলেছেন পল্লীর কারখানায় কর্মরত অনেক তাঁত শ্রমিক।
জানা গেছে, ২০০৪ সালে ২ কোটি ১৫ লাখ টাকা ব্যয়ে বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড ফতেহ মোহাম্মদপুর এলাকায় সাড়ে ৫ একর জমির ওপর গড়ে তোলে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বেনারসি পল্লী। ২০ বছরে প্লটের কিস্তি পরিশোধের সুবিধার্থে ৯০ তাঁতিকে ৯০টি প্লট বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৭০টি ৩ শতাংশের ও ২০টি ৫ শতাংশের প্লট। ৯০টি প্লটের মধ্যে মাত্র সাতটি প্লটে কারখানা স্থাপন করা হলেও এখন চালু রয়েছে তিনটি।
সরেজমিনে দেখা গেছে, কারখানা স্থাপনের জন্য ইটের দেয়াল গাঁথুনি দেখা গেলেও সেগুলোর নির্মাণ কাজ শেষ হয়নি। বেশিরভাগ প্লটে কারখানা গড়ে না উঠায় পুরো পল্লী এখন ঝোপঝাড় ও জঙ্গলে পরিণত হয়েছে। বেনারসি পল্লীর দেখভালের জন্য শুধুমাত্র একজন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ছাড়া আর কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারী নেই। একজন মাত্র কর্মকর্তা পুরো বেনারসি পল্লীর দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি আটঘরিয়া উপজেলার তাঁতিদের ঋণ বিতরণ ও আদায়ের কার্যক্রম দেখভালের বাড়তি দায়িত্বও পালন করছেন।
ফতেমহাম্মাদপুর বেনারসি পল্লীতে বরাদ্দকৃত প্লটের কয়েকজন তাঁত মালিক জানান, কিস্তিতে প্লট বরাদ্দ নিলেও বেনারসি পল্লীতে কারখানা নির্মাণের মতো পুঁজি আমাদের নেই। বেনারসি পল্লীর আশপাশে রেলের পরিত্যক্ত জায়গায় বাপ দাদার আমল থেকেই কারখানা নির্মাণ করে ব্যবসা করে আসছি। এখন ব্যবসার অবস্থা খুব একটা ভালো না। সুতার দাম বৃদ্ধি, শ্রমিক সংকটসহ নানা প্রতিবন্ধকতায় বেনারসি তাঁতের ব্যবসা এখন মন্দা।
তারা আরও জানান, সরকারি বরাদ্দের আগেও পাকিস্তান আমলে এখানে প্রায় ৪৫০টি বেনারসি তাঁত কারখানা ছিল। এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত ছিলেন এ অঞ্চলের প্রায় সাত হাজার মানুষ। ভারতীয় নিম্নমানের শাড়িতে দেশি বাজার সয়লাব ও দফায় দফায় সুতা, চুমকিসহ সব তাঁত সামগ্রীর দাম বাড়ায় লোকসানে পড়ে বেনারসি তাঁত শিল্প থেকে ধীরে ধীরে অনেকেই নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন।
পল্লীতে সিরাজগঞ্জের বেলকুচি উপজেলার কাপড়ের কারখানা জামান টেক্সটাইলের দুইটি ও স্থানীয় এক তাঁত মালিকের শানজিদা শাড়ি কারখানা নামে তিনটি কারখানা চালু রয়েছে।
সেখানে কর্মরত কারিগররা বলেন, এক সময় আমাদের হাতে তৈরি এখানকার বেনারসি-কাতান জনপ্রিয় ছিল। ১০ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকা দামের শাড়ি এখানে তৈরি করা হয়। ‘হাতে দিয়ে চালানো তাঁতে তৈরি বেনারসি-কাতান বুননে শ্রমিকদের মজুরি খরচ দিতে হয় ৩ থেকে ৮ হাজার টাকা পর্যন্ত। ভারতীয় কম দামি শাড়ি বাজারে আসায় এসব শাড়ির আর ক্রেতা পাওয়া যায় না। এ বেনারসি পল্লীর সরকারিভাবে সুতা প্রোসেসিং কারখানা স্থাপনের কথা থাকলেও তা হয়নি। শাড়ি প্রতি প্রায় এক হাজার টাকা করে ঢাকার মিরপুর থেকে সুতা প্রসেস করে আনতে হয়।
সানজিদা শাড়ি কারখানার স্বত্বাধিকারী মো. নাসিম উদ্দিন টুটুল বলেন, ৩০ বছর এ পেশায় আছি। বেনারসি তাঁতিতে এমন দুঃসময় আগে কখনও দেখিনি। ২০২০ সালের শুরুতে শাড়ি তৈরির সুতা ছিল ২ হাজার টাকা বান্ডিল (সাড়ে চার কেজি)। আর এখন হয়েছে ৪ হাজার টাকা। মাত্র দুই বছরের ব্যবধানে সুতার দাম দ্বিগুণ। কিন্তু শাড়ির সাম এক টাকাও বাড়েনি। একটি সাধারণ জামদানি শাড়ি তৈরিতে এখন খরচ হয় ২৭০০ টাকা আর ২০২০ সালে খরচ হতো ১৯০০ টাকা। মাত্র দুই বছরে একটি শাড়ি তৈরিতে খরচ বেড়েছে ৮০০ টাকা। কিন্তু সেই শাড়ি এখনও ২৯০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এমনিতেই আমরা চলতে পারছি না। বেনারসি পল্লিতে কারখানা নির্মাণের পুঁজি কোথায় পাবো। বরাদ্দ পাওয়া প্লটে কারখানা নির্মাণ করে অতিরিক্ত কোনো সুযোগ- সুবিধাও পাওয়া যাবে না। তাই তাঁতিরা বেনারসি পল্লীতে কারখানা স্থাপনের আগ্রহ দেখাচ্ছে না।
ফতেমহাম্মদপুর বাজারের গুড্ডু বেনারসি বিতানের স্বত্বাধিকারী আলী আজগর গুড্ডু বলেন, দীর্ঘ সময় ধরে এই বেনারসি পল্লীর তৈরি শাড়ি দিয়ে ব্যবসা করেছি। কিন্তু ভারতীয় শাড়ি বাজারে আসার পর দেশীয় এই বেনারসির চাহিদা কমে গেছে। দোকানে রাখলে দেশীয় এই বেনারসি -কাতান শাড়ি কেনার জন্য ক্রেতা পাওয়া যাই না। এসব কারণেই মূলত এই ঐতিহ্যবাহী বেনারসি পল্লী আজ বিলুপ্তির পথে।
ঈশ্বরদী বেনারসি পল্লীর ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শাহ জামাল বলেন, ঈশ্বরদীর বেনারসি শিল্প এক সময় ব্যাপক সমৃদ্ধ ছিল। কালের পরিক্রমায় বেনারসির চাহিদা কমে যাওয়া ও ভারতীয় কম দামি শাড়ি আসার কারণে এ শিল্পটি বর্তমানে ধ্বংসের পথে। সরকারি সহায়তার মাধ্যমে আধুনিক পাওয়ারলুমে শাড়ি তৈরি ও দেশীয় বাজারে ভারতের শাড়ি বন্ধ করে আমাদের এই বেনারসির মার্কেটিং পর্যাপ্ত করতে পারলেই মূলত এই ঐতিহ্যবাহী বেনারসি পল্লী পুনরায় পুনরুজ্জীবিত হতে পারে।
অফিসের লোকবল সংকট প্রসঙ্গে তিনি জানান, অফিসে পিয়ন, নৈশপ্রহরী এমনকি একজন ঝাড়ুদার পর্যন্ত নেই। তিনি একাই এ প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব পালন করছেন। পাশাপাশি আটঘরিয়া উপজেলায় তাঁতিদের ঋণ দেয়াসহ তাঁত বোর্ডের কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। সূত্র : সময় সংবাদ
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।