বিনোদন ডেস্ক : সিনেমার একটি স্ক্রিপ্ট লিখতে লেগে যেতে পারে কয়েক সপ্তাহ, মাস এমনকি বছরও। অথচ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই সে কাজ করে দিচ্ছে মাত্র কয়েক সেকেন্ডে। ইতোমধ্যে হলিউড দেখেছে এআইয়ের ঝলক। আর এ কারণে নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কায় পড়ে হলিউডের লেখকরা বাধ্য হয়েছেন ধর্মঘটে যেতে। তবে ভারতীয় চলচ্চিত্র শিল্পে এআই-এর প্রভাব নিয়ে তেমন আলোচনা নেই।
চলচ্চিত্র নির্মাতাদের একটি পক্ষ মনে করছেন, এআই নিয়ে আপাতত শঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। আরেক পক্ষের মতে, বিষয়টি এখন থেকেই গুরুত্ব সহকারে নেয়া দরকার।
পরিচালক শেখর কাপুরের প্রথম চলচ্চিত্র ‘মাসুম’ মুক্তি পায় ১৯৮৩ সালে। সিনেমার কাহিনি আবর্তিত হয় স্বামীর বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের ফলে জন্ম নেয়া সন্তানকে গ্রহণ করা এক নারীকে ঘিরে। এই আবেগপ্রবণ চলচ্চিত্রটিতে পরকীয়া প্রেমের সম্পর্ক আর সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির জটিল বিষয়গুলোকে নিখুঁতভাবে সামাল দেয়া হয়।
পার হয়েছে বহু বছর। শেখর কাপুর সিদ্ধান্ত নিলেন চিত্রনাট্য লিখতে এআই টুল চ্যাটজিপিটি ব্যবহার করবেন। তিনি নির্দেশনা দেয়ার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই স্ক্রিপ্ট লিখে দেয় চ্যাটজিপিটি। পুরস্কারজয়ী নির্মাতা রীতিমতো অবাক হয়ে যান।
এআই তার স্ক্রিপ্টে দেখায়, মাসুম সিনেমার শিশুটি তার বাবার প্রতি ঘৃণা নিয়ে বেড়ে উঠছে। নতুন এই গল্প সিনেমার সম্পর্ককে প্রভাবিত করেছে। এমন উপলব্ধির পর শেখর কাপুর বলেন, ভবিষ্যতে বিশৃঙ্খলা নিয়ে আসছে এআই। একদল স্ক্রিপ্টরাইটারের কাজ কয়েক সেকেন্ডেই করে দিচ্ছে।
২০১৯ সালে ডেলয়েটের প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুসারে, ভারত হলো বিশ্বের বৃহত্তম চলচ্চিত্র শিল্পের আবাসস্থল। প্রতিবছর বিশ্বের সর্বাধিক চলচ্চিত্র নির্মিত হয় দেশটিতে। ভারতের চলচ্চিত্র শিল্প প্রায় ৮ লক্ষাধিক মানুষের কর্মস্থল।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এআই টুলগুলো আরও তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠছে। ভারতীয় চলচ্চিত্র শিল্পে এর ব্যবহার ব্যাপক হারে না হলেও, ইতোমধ্যে প্রভাব পড়তে শুরু করছে। ইন্টারনেট জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে রাশমিকা মান্দানা, আলিয়া ভাটের মতো তারকাদের ‘ডিপফেক’ ভিডিও বা ছবি। এগুলো বানানো হচ্ছে এআই এর মাধ্যমে। এমন অবস্থায় এআই এর ব্যবহার নৈতিক এবং অর্থনৈতিক উভয় দিকেই উদ্বেগ বাড়াচ্ছে।
গত বছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভিনয় শিল্পী এবং চিত্রনাট্য লেখকদের ধর্মঘট হলিউডকে কয়েক মাস স্থবির করে দিয়েছিল। তাদের দাবি ছিল, টিভি অনুষ্ঠান ও চলচ্চিত্র নির্মাণে এআই ব্যবহার করা যাবে না।
ভারতের প্রযোজক সমিতির সাবেক সভাপতি সিদ্ধার্থ রায় কাপুর বলেন, ‘ভারতের চলচ্চিত্র শিল্পে এআই এর ব্যবহার নিয়ে কাঠামোগত আলোচনা হয়নি। তবে সেই আলোচনা করার সময় হয়ে গেছে। কেননা, এইআই টুলগুলো আক্ষরিক অর্থেই প্রতি মুহূর্তে স্মার্ট হয়ে ওঠছে। ফলে আমরা আজ যেখানে আছি, তিন থেকে ছয় মাস পর পরিস্থিতি পুরোপুরি ভিন্ন হবে।’
এআই প্রযুক্তি ব্যবহারে ভারতীয় চলচ্চিত্র শিল্প এখন কোথায়?
ভিজ্যুয়াল ইফেক্ট স্টুডিও রেডচিলিস ডট ভিএফএক্সের শীর্ষ কর্মকর্তা কেইতান যাদব এবং হ্যারি হিঙ্গরানি জানান, সবকিছুই হবে একটা বোতামের চাপে। তবে এজন্য এআইকে এখনও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। বলিউড সুপারস্টার শাহরুখ খান প্রায় দুই দশক আগে স্টুডিওটি প্রতিষ্ঠা করেন। গত বছর শাহরুখ খানের সাড়া জাগানো সিনেমা ‘পাঠান’ ও ‘জওয়ান’ এর ভিজ্যুয়াল ইফেক্টসের কাজ এখান থেকেই করা হয়।
যাদব এবং হিঙ্গোরানি জানান, ধারণা নিতে তারা এইআই এর সহায়তা নিয়েছেন। তবে তারা মনে করেন, এটি মোশন পিকচারের ফোরকে রেজোল্যুশনের মান ধরে রাখতে পারেনি।
অন্যদিকে তামিল সিনেমার পরিচালক গুহান সেনিয়াপ্পান সেটি করে দেখানোর চ্যালেঞ্জ নিয়ে কাজ করছেন। তিনি সম্প্রতি একটি সিনেমা নিয়ে কাজ করছেন। এটিই হবে প্রথম ভারতীয় ফিচার ফিল্ম, যার আড়াই মিনিটের একটি সিকোয়েন্স পুরোপুরি এআই দিয়ে তৈরি করা।
তিনি বলেন, ‘আমরা অতিমানবীয় কাহিনি নিয়ে কাজ করছি। তবে সেখানে প্রচুর অ্যাকশন সিকোয়েন্স থাকছে। আমি গল্পটিকে একটি নতুন উপায়ে জানাতে চেয়েছি।’
এ সিনেমার প্রধান চরিত্রে অভিনয় করা সত্যরাজের ছবি সংস্করণে এআই টুল ব্যবহার করা হয়েছে। এআই এর ব্যবহারে সত্যরাজকে আরও কম বয়সে ফিরিয়ে নেয়া হয়। গুহান বলেন, ‘এআই এর এমন ব্যবহার খরচ কমিয়ে দিয়েছে।’
২০২১ সালে ডিপফেক প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিজ্ঞাপনের জন্য শাহরুখ খানের চেহারা এবং কণ্ঠস্বর ব্যবহার করা হয়। ক্যাডবেরির ওই বিজ্ঞাপনটি মহামারি চলাকালীন বিক্রি বাড়াতে পাড়া-মহল্লার দোকানিদের শাহরুখ খানের চেহারা এবং কণ্ঠস্বর ব্যবহারের অনুমতি দেয়া হয়।
প্রচারণার দায়িত্বে থাকা বিজ্ঞাপনী সংস্থা ওগিলভি ইন্ডিয়ার সুকেশ নায়ক জানান, সারাদেশে তিন লাখ বিজ্ঞাপন তৈরি হয়েছিল। এজেন্সি শাহরুখ খানের দলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছে। কেবল নিবন্ধিত নির্দিষ্ট দোকানই যুক্ত হতে পেরেছে। তবে ভারতে এআই নিয়ে নির্দিষ্ট কোনো নীতিমালা নেই। ফলে সমালোচকরা দাবি করেন, এটি অপব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত।
এআই টুল দিয়ে কেউ যাতে বিনা অনুমতিতে বলিউড অভিনেতা অনিল কাপুরের কণ্ঠ বা ছবি ব্যবহার করতে না পারে, সেজন্য তিনি গত বছর আদালতের দারস্থ হন। আদালত তার পক্ষেই রায় দেন।
এ বিষয়ে অনিল কাপুর জানান, এই রায় অন্যান্য অভিনেতাদের জন্যও ইতিবাচক হতে পারে।
এছাড়াও ভ্যারাইটি ম্যাগাজিনকে তিনি বলেন, ‘কেউ আমার ছবি, কণ্ঠ, জিআইএফ কিংবা ডিপফেক ব্যবহার করলে, আমি আইন অনুযায়ী আদালতের নোটিশ পাঠাতে পারব। পরে সেগুলো তাদের নামিয়ে ফেলতে হবে।’
তবে বিশেষজ্ঞের মতে, এআই এর ইতিবাচক দিকও আছে। তারা মনে করেন, এআই চলচ্চিত্র নির্মাণের কিছু কাজকে সহজ এবং দ্রুততর করতে পারে।
রেডচিলিস ডট ভিএফএক্স এর শিল্পা হিঙ্গোরানি জানান, ‘ফ্রেম ধরে ধরে তাদের কাজ করতে হয়। ক্লায়েন্টকে নমুনা দেখাতেও দীর্ঘ সময় লেগে যায়।’ যাদব বলেন, ‘সময় কমিয়ে আনতে পারলে যেকোনো কাজ সহজ হয়ে যায়।’
কে ভালো কাজ করে, মানুষ নাকি এআই?
উইপন সিনেমার পরিচালক গুহান সেন্নিয়াপ্পান জানান, পর্যাপ্ত বাজেট এবং সময় থাকলে এআই এর পরিবর্তে লাইভ অ্যাকশন শুট করতেন। কেননা, এআই চমৎকার হলেও লাইভ অ্যাকশন কিংবা অ্যানিমের মতো জীবন্ত নয়।
চ্যাটজিপিটির কর্মকাণ্ডে শেখর কাপুর প্রাথমিকভাবে মুগ্ধ হলেও, সেন্নিয়াপ্পানের সঙ্গে একমত প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ‘আমি নিজেকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কে বেশি বুদ্ধিমান, এআই না আমি? উত্তর ছিল আমি। কেননা এআই এর নিজস্ব কোনো ভাবনা নেই। তথ্য ভাণ্ডারে যা থাকে, তার ওপর ভিত্তি করেই কাজ করে। এটি রহস্য তৈরি করতে পারে না। এছাড়াও ভয় কিংবা ভালবাসা অনুভব করতে পারে না। তবে এআই চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রক্রিয়াকে আরও গণতান্ত্রিক করতে পারবে।’
তিনি আরও বলেন, প্রত্যেকে একই প্রযুক্তি ব্যবহার করলে প্রাতিষ্ঠানিক পদবিন্যাস কাজ করবে না। তবে প্রত্যেকের কাছে গল্প বলার ক্ষমতা থাকবে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।