সাজ্জাদুল ইসলাম নয়ন: পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো থেকে চীনে রপ্তানি হার আশঙ্কাজনকভাবে কমে যাচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে সামনের দিনগুলোতে এই মন্দাভাব অব্যাহত থাকবে। দেশটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার। যে কারণে এশিয়ার অন্য দেশগুলোর অর্থনীতির ওপরও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। চিনে করোনা মহামারির প্রভাবে বেশির ভাগ কলকারখানা বন্ধ থাকায় উৎপাদন চাহিদা কমছে। আর এ কারণে দেশটিতে আমদানি হ্রাস পাচ্ছে। সম্প্রতি বিশ্বখ্যাত ফ্যাশন ব্র্যান্ড বারবেরি জানিয়েছে চীনে তাদের বিক্রি আশঙ্কাজনক হারে কমছে।
চীনের রপ্তানি বাণিজ্যও সংকুচিত হয়েছে। ভারত চীনা পণ্য আমদানি কমিয়ে দিয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে চলছে বাণিজ্য-যুদ্ধ। হংকং নিয়ে যুক্তরাজ্যের সঙ্গেও চীনের সম্পর্ক খারাপ। ফলে দ্রুত আর্থিক অবস্থার উন্নতির সম্ভাবনা সামনে নেই। এরই মাঝে করোনার আবার নতুন ঢেউ । অর্থনীতির নিম্নগতি সত্ত্বেও দেশটি করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে শূন্য কোভিড নীতি অনুসরণ করেছিল। কিন্তু জনরোষের কারণে তার কিছুটা প্রত্যাহার করতে হয়। এখন হিমশিম খেতে হচ্ছে করোনা প্রতিরোধ ও অর্থনীতির সূচককে ঊর্ধ্বমুখী করতে।-খবর জাপানি সংবাদ সংস্থা এনএইচকে ওয়ার্ল্ড-এর।
প্রতিবেদনে থাই বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হচ্ছে দেশটিতে ডিসেম্বর মাসে চীনে রপ্তানি ১৪ দশমিক ছয় শতাংশ কমে প্রায় ২১ দশমিক সাত বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। এটি পতনের টানা তৃতীয় মাস ছিল। এই তিন মাসে চীনে রপ্তানি কমেছে ২০.৮ শতাংশ। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশ সিঙ্গাপুরও একই ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। ডিসেম্বরে চীনে-তেল রপ্তানি ২০ দশমিক ছয় শতাংশ সংকুচিত হয়েছে। গড়ে তিন মাসে চীনে রপ্তানি ৩১ দশমিক আট শতাংশ কমেছে।
যুক্তরাজ্যের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ টমি উ বলেছেন, “মহামারি শুরু হওয়ার পর থেকে গত বছরের চীনের দ্বিতীয় কোয়ার্টারের জিডিপির হিসাব ছিল সবচেয়ে খারাপ। লকডাউনের কারণে, বিশেষ করে সাংহাইতে করোনা বিস্তারের কারণে এই কোয়ার্টারের শুরুতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছে।”
চীন সরকার তার কঠোর সংক্রমণ বিরোধী ব্যবস্থা তুলে নেওয়ার পরও থেকে চীনের অর্থনীতি বিভিন্ন কারণে বাধাগ্রস্ত হয়েছে। বিশ্লেষকেরা বলছেন পশ্চিমা দেশগুলির আর্থিক সংকোচন নীতি, ইউক্রেন যুদ্ধ ও রাশিয়ার ওডর আমেরিকার নিষেধাজ্ঞা এসব কিছু মিলিয়ে চীন থেকে আমদানি রপ্তানি সামনের মাসগুলিতে আরও বাধাগ্রস্ত হবে। ইউরোপভিত্তিক সংবাদ বিশ্লেষক ‘ইনসাইড ওভার’ সম্প্রতি করা এক প্রতিবেদনে বলেছে করোনার প্রাদুর্ভাব বেড়ে যাওয়া আর মন্দা অর্থনীতি এ দুটি বিষয় নিয়ে চীন উভয়সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। চীনের শূন্য কোভিড নীতি হয়তো দেশটির মানুষের প্রাণ বাঁচিয়েছে কিন্তু অর্থনীতির ওপর ফেলেছে বিরূপ প্রভাব।
বলা হয়েছে যে বেইজিং যদি “আসন্ন কোভিড তরঙ্গ দ্বারা ক্ষতি সামাল দিতে জিরো কোভিড নীতি পুনর্বহাল করে, তবে তা অর্থনীতির ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলবে৷ আর যদি তা না করা হয়, তবে মানুষের জীবন ঝুঁকির মধ্যে পড়বে।”
গত ৮ জানুয়ারি শূন্য কোভিড নীতি থেকে সরে আসে দেশটি। ঘোষণা আসার পর থেকে বিভিন্ন দেশে করোনাভাইরাসের নতুন ধরন ছড়ানো নিয়ে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। মালয়েশিয়া ও তাইওয়ানও চীনে নতুন করে সংক্রমণ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তারা কঠোর বিধিনিষেধ জারি করেছে। ভারত ও জাপান সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নিয়েছে। চীন থেকে আসা ব্যক্তিদের ওপর নতুন কোভিড বিধিনিষেধ আরোপ করার কথা বিবেচনা করা হচ্ছে।
যে হারে করোনা ছড়াচ্ছে তাতে ধারণা করা হচ্ছে আগামী দিনে এক মিলিয়নেরও বেশি কোভিড সম্পর্কিত মৃত্যুর সাক্ষী হতে পারে চীন। একই সময়ে, দেশটির অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব কাটাতেও সরকার বিধিনিষেধ আরোপ করতে হিমশিম খাচ্ছে। বিশ্লেষকদের ধারণা চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এই বছর ২ দশমিক আট থেকে-৩ দশমিক দুই শতাংশে নেমে আসতে পারে, যা হবে গত ৫০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন হবে৷ প্রতিবেদন অনুযায়ী গত বছরের শেষের দিকে করোনার কারণে কলকারখানা ও ছোট ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। এত চীনের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
গত নভেম্বরে খুচরা বিক্রি কমেছে ৫ দশমিক নয় শতাংশ। শিল্প ও কলকারখানা থেকে আয় কমেছে ২ দশমিক দুই শতাংশ। আর সম্পদে বিনিয়োগ কমেছে ৫ দশমিক তিন শতাংশ। চীনে বেকারত্বের হার বেড়ে ৫ দশমিক ৭ শতাংশে পৌঁছেছে। যেখানে দেশটির শ্রমের প্রধান শক্তি ১৬ থেকে ২৪ বছর বয়সীদের মধ্যে এটি বেড়ে ১৭ দশমিক এক শতাংশে পৌঁছেছে। এ ছাড়া দেশটির আবাসন খাতেও এখন গভীর মন্দা চলছে এবং সেই সঙ্গে সাম্প্রতিক মাসগুলিতে চীনের সঙ্গে ব্যবসা সম্পর্কযুক্ত দেশগুলোর অর্থনীতির পরিস্থিতিও দুর্বল হয়ে পড়েছে। অন্য দেশগুলোর তুলনায় এসব দেশগুলোতে মূল্যস্ফীতির ঘোড়ায় লাগাম দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে। চোখের সামনেই শ্রীলঙ্কা নেপাল এবং পাকিস্তান এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ। মূল্যস্ফীতির চাপে দেশগুলো দিশেহারা।
বিশ্বব্যাংকের মতে, ২০২৩ সালে জ্বালানি খাত বাদে বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়াবে ৫ শতাংশে। এটি আগের পাঁচ বছরের গড় মূল্যস্ফীতির প্রায় দ্বিগুণ। এ অবস্থায় মূল্যস্ফীতি কমাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর সুদের হার অতিরিক্ত ২ শতাংশ বাড়ানোর প্রয়োজন পড়তে পারে। তবে চলতি বছরেই এরই মধ্যে এ হার গড়ে ২ শতাংশের বেশি বাড়িয়েছে তারা। এর নেতিবাচক প্রভাব সবচেয়ে বেশি ভোগ করছে দ্রুত অর্থনীতি বর্ধনশীল দেশগুলোর জনগণ। যুদ্ধ, বৈরী পররাষ্ট্রনীতি, অন্য দেশগুলোর ওপর প্রভাব বিস্তার; এসব বাদ দিয়ে বিশ্বনেতাদের উচিত বৈশ্বিক মন্দা কাটাতে একযোগে কাজ করা। মন্দার ঝুঁকি এড়াতে ভোগ কমানোর চেয়ে বরং উৎপাদন বাড়ানোর দিকে নজর দেওয়া উচিত রাষ্ট্রপ্রধানদের। এর সঙ্গে বাড়াতে হবে বিনিয়োগও।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।