বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ডেস্ক : বিশেষ আপেক্ষিকতাতত্ত্বে আইনস্টাইন দেখান, গতিশীল অবস্থায় বস্তুর ধর্ম বদলে যায়। কিন্তু সেই গতি ছিল সুষম। একটা বস্তু যদি একই গতিতে চলে, তাহলে বিশেষ আপেক্ষিকতার সূত্রগুলো কাজে লাগে। তা ছাড়া এই সূত্রগুলো গড়ে উঠেছে মৌলিক কোনো বলের অনুপস্থিতিতে।
কিন্তু বস্তুর গতি যদি সুষম না হয়ে ত্বরিত হয়, অর্থাৎ ক্ষণে ক্ষণে বেড়েই চলে, তাহলে কী হবে?
তখন সেই বস্তুর ওপর গতীয় বল কাজ করবে। এই গতীয় বলের জন্ম আবার মহাকর্ষ বলের পেট থেকে। অর্থাৎ ত্বরিত কোনো প্রসঙ্গ কাঠামোতে কিংবা মহাকর্ষ বলের উপস্থিতিতে রিলেটিভিটির সূত্রগুলো কেমন আচরণ করে? ভর কী বাড়বে, কিভাবে বাড়বে? বস্তুর দৈর্ঘ্য কি কমবে, কিংবা ধীর হবে সময়? বিশেষ আপেক্ষিকতায় এসব প্রশ্নের উত্তর ছিল না। তাই আইনস্টাইন রিলেটিভিটিকে সম্প্রসারণ করার কথা ভাবেন।
কিন্তু কাজটা সহজ ছিল না।
আইনস্টাইন সময় নেন, একাধিক থট এক্সপেরিমেন্ট করেন। দশ বছর পর ২০১৫ সালে প্রকাশ করেন জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটি।
মহাকর্ষ বলের সংজ্ঞা-ব্যাখ্যা নতুনভাবে লেখা হয় এই তত্ত্বে।
মহাবিশ্বের অজানা রহস্যের দুয়ার খুলে যায় হাট করে। আগে যেখানে মহাবিশ্বে আমাদের মিল্কিওয়েকেই একমাত্র গ্যালাক্সি মনে করা হতো, এক শতাব্দীর মধ্যে সেটা এখন দুই শ বিলিয়নে রূপ নিয়েছে। এমনকি ব্ল্যাকহোল, নিউট্রন স্টার, কোয়াসার, পালসার, শ্বেত বামন, লাল দানবের মতো মহাজাগতিক বস্তুগুলোর সন্ধান মিলেছে। শুধু উন্নত টেলিস্কোপের সাহায্যে এগুলোর সন্ধান মিলত না, যদি জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটির বিভিন্ন সমাধান থেকে এসবের ভবিষ্যদ্বাণী করা না হতো।
এত বড় প্রভাব যে তত্ত্বের, তা নির্মাণে সময় লাগবে, সেটাই স্বাভাবিক–এই হিসাবে ১০ বছর খুব বেশি সময় নয়।
২.
জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটি তৈরি হয়েছিল তিন শ বছর আগে ইতালিয়ান বিজ্ঞানী গ্যালিলিওর নীতি থেকে। কথিত আছে, গ্যালিলিও পিসার হেলানো মিনার থেকে একটা পাথরের টুকরো আর একটা পালক একসঙ্গে ফেলে দেখেছিলেন, দুটি একই সঙ্গে মাটিতে পড়ে। এ গল্পের সত্যতা নিশ্চিত করার উপায় নেই, তবে নিউটন গ্যালিলিওর এই নীতিটা পরীক্ষা করে দেখেছিলেন একটা বায়ুশূন্য জারে একটা গিনি আর পালক ফেলে। দেখেছিলেন গ্যালিলিওর নীতি ঠিক, পড়ন্ত বস্তুর ক্ষেত্রে ভর কোনো বাধা নয়, ভারী, মধ্যম ভারী, হালকা—সব বস্তু একই ত্বরণে মাটিতে পড়ে।
এখানেও আইনস্টাইন একটা থট এক্সপেরিমেন্ট করেছিলেন–একটা লিফটের ভেতরে একজন লোক ছিলেন। হঠাৎ লিফটের দড়ি ছিঁড়ে যায়, লিফট পড়তে থাকে মুক্তভাবে। আইনস্টাইন তখন মনশ্চোখে দেখতে পাচ্ছিলেন, লোকটার হাতে একটা হাতুড়ি আছে, পকেটে একটা কলম আছে। লোকটা হাত থেকে হাতুড়িটা ছেড়ে দিলেন, পকেট থেকে কলমটা ফেলে দিলেন। হাতুড়ি আর কলম লিফটের মেঝেয় পড়ল না। যেন হাওয়ায় ভেসে রইল। লোকটার বুক সমান উচ্চতায় ভাসতে ভাসতে দড়ি ছেঁড়া লিফটের সঙ্গে মাটির দিকে নামতে থাকল।
এই যে ঘটনা এটা কেন হয়? ভাবেন আইনস্টাইন। তার পূর্বসূরি গ্যালিলিও-নিউটন দুজনেই ভেবেছিলেন। নিউটন দেখিয়েছিলেন, বস্তুর দুই ধরনের ভর সমান হয়। একটা হলো তার জড়তার ভর, যেটা সে কোনো বস্তু আঘাত করলে অনুভব করে, অথবা বস্তু ত্বরিত হলে যে ভর বস্তুটি অনুভব করে। অন্যটা মহাকর্ষীয় ভর, মহাকর্ষীয় টানের কারণে যে ভর অনুভব করে বস্তু। এটা কেন হবে, সেটার ব্যাখ্যা গ্যালিলিও বা নিউটন কেউই করেননি। তাঁরা বের করতে পারেননি এর সুস্পষ্ট কারণ।
আইনস্টাইন অবশ্য অন্য পথে হাঁটেন। বিশেষ আপেক্ষিকতায় যেমন আলোর গতিতে ধ্রুব অর্থাৎ স্বতঃসিদ্ধ ধরে নিয়েছিলেন, সাধারণ আপেক্ষিকতায়ও তেমন এটাকেই ধরে নিলেন স্বতঃসিদ্ধ। অর্থাৎ তিনি জড়তার ভর আর মহাকর্ষীয় ভর সমান হওয়ার ব্যাপারটিকে বলেন প্রাকৃতিক নীতি, যার কোনো পরিবর্তন সম্ভব নয়। এই প্রাকৃতির নীতির নাম দেন ‘সমতুল্যতার নীতি’।
তিনি সময় আর স্থানকে আলাদা করে ভাবাও বন্ধ করেন। বলেন, স্থান আর কাল মিলিয়ে আমাদের এই মহাবিশ্ব। স্থান ছাড়া কাল আর কাল ছাড়া স্থানের কোনো মূল্য নয়।
আমরা যেটাকে মহাবিশ্ব বলছি, এর ভেতর যত স্থান আছে, অর্থাৎ যেখানে ঘটনা ঘটছে, সেখানকার সব ঘটনা শুধু স্থান বা শুধু কালের সাপেক্ষে ব্যাখ্যা করলে হবে না। দুটিকে একত্রিত করে ভাবতে হবে। তিনি দেখান, স্থানকালে মহাকর্ষ হিসেবে যেটা আমরা অনুভব করি, সেটা ত্বরণের অন্য এক রূপ মাত্র।
আইনস্টাইন দেখালেন, মহকর্ষকে আমরা যেভাবে ভাবি, সে রকম আকর্ষী চরিত্রের কোনো বল নয় এটা। বরং ভারি বস্তু যখন স্থানকালের কোনো জায়গায় থাকে, এর চারপাশের স্থানকালকে বাঁকিয়ে দেয়। সুতরাং বস্তুটিকে ঘিরে এর চারপাশের স্থানকালে একটা হোল বা গর্ত তৈরি করে। এখন তুলনামূলক কোনো ছোট বস্তু যদি এই স্থানকালের হোলের আশপাশ দিয়ে যায়, তখন হোলটার দিকে হেলে পড়বে বস্তুটা। কারণ, বস্তুটার গতিপথ স্থানকালের ওপরেই। সেই পথই যদি বেঁকে যায়, তাহলে বস্তু আর সোজা পথে চলতে পারবে না। আগের সেই বড় বস্তুটার দিকে অনেকটাই হেলে পড়বে ছোট বস্তুটা। অর্থাৎ ছোট বস্তুটার ত্বরণ বড় বস্তুটার দিকে। তখন মনে হবে, বড় বস্তুটা ছোট বস্তুটাকে নিজের দিকে আকর্ষণ করছে। যদি বড় বস্তুটা পৃথবী আর ছোট বস্তুটা যদি আপেল হয়, তাহলে আপেলের ত্বরণ হবে পুরোপুরি পৃথিবীর কেন্দ্রের দিকে। তখন আপেল হুমড়ি খেয়ে পড়বে পৃথিবীর কেন্দ্রের দিকে। আমাদের মনে হবে, পৃথিবী আপেলকে তার কেন্দ্রের দিকে আকর্ষণ করছে।
৩.
আগেই বলেছি, বস্তুর ভর স্থানকালকে বাঁকিয়ে দেয়। তার ফলে এই বাঁকানো স্থানকালের মধ্যে অন্য কোনো বস্তু এলেও তার গতিপথ বেঁকে যাবে। ধরা যাক, দূর গ্রহের কোনো এক এলিয়েন স্পেসশিপ আসছে পৃথিবীর দিকে। আসছে সোজা পথে। কিন্তু পৃথিবীর কারণে যেহেতু স্থানকাল বেঁকে গেছে, তাই স্পেসশিপটা পৃথিবীর যত কাছে আসবে, তত অনুভব করবে তার চলার পথ বেঁকে গেছে। সেটা ধীরে ধীরে পৃথিবীর মহাকর্ষীয় বক্রতার কারণে স্পেস ধীরে ধীরে পৃথিবীর দিকে হেলে পড়বে।
ধরা যাক, স্পেসশিপের গতি পৃথিবীর মুক্তিবেগের (পৃথিবীর মুক্তিবেগ ১১.২ কিলোমিটার) চেয়ে বেশি। তাহলে ওটা চাই পৃথিবীর এই মহাকর্ষীয় বক্রতা ডিঙিয়ে চলে যেতে পারবে দূর কোনো মহাকাশে। কিন্তু ওটার বেগ পৃথিবীর মুক্তিবেগের চেয়ে কম হলে, মহকর্ষীয় বক্রতাকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে পারবে না। তখন সেটা পৃথিবীর দিকে নামতে বাধ্য হবে।
ধরা যাক, স্পেসশিপটার গতি পৃথিবীর মুক্তবেগের চেয়ে অনেক বেশি। তাই চাইলেই সেটা পৃথিবীর মহাকর্ষীয় বক্রতা উপেক্ষা করেই চলে যেতে পারবে। কিন্তু তার মানে এই নয়, স্পেসশিপটা নির্বিঘ্নে মহাকর্ষীয় বক্রতা কাটিয়ে চলে যেতে পারবে। যেহেতু পথ বেঁকে গেছে, তাই এই এলাকাটা পার হতে বেশি দূরত্ব পার হতে হবে।
ধরা যাক, একটা মোটরবাইক সোজা পথে চলছে। চালক একটা ফসলের ক্ষেত পার হবে। এর আগেও ওটা এই ক্ষেত পার হয়েছে। ধরা যাক, ক্ষেতের দৈর্ঘ্য ২০০ মিটার। ধরা যাক, মোটরবাইকের গতি ঘণ্টায় ৭২ কিলোমিটার। অর্থাৎ সেকেন্ডে ২০ মিটার। অর্থাৎ ওই ফসল ক্ষেত পার হতে বাইকের সময় লাগবে ১০ সেকেন্ডে।
এমনটাই জানতেন চালক। কিন্তু এবার এসে দেখলেন, ক্ষেতটা আগের মতো সমতল নেই। পুরো ক্ষেত খুঁড়ে মাটি তুলে নেওয়া হয়েছে। ক্ষেতটা পরিণত হয়েছে এবড়ো-খেবড়ো খাদে। অন্য কোনো পথও নেই যে বাইকার সেটা ব্যবহার করবেন। তাকে ওই খাদের মতো ক্ষেতই পার হতে হবে। সেটাই করলেন চালক। ক্ষেত পার হওয়ার পর দেখলেন, এবার তার সময় বেশি লেগেছে। কারণ এবার তার পথ আর মসৃণ ছিল না। আকা-বাঁকা ছোট ছোট খাদে ভরা ক্ষেত পার হতে ৫ সেকেন্ড সময় বেশি লেগেছে।
আইনস্টাইন দেখান, বস্তু স্থানকাল বাঁকিয়ে দেয়, ফলে ভারী বস্তুর আশপাশে অর্থাৎ মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রের একেবারে ভেতরে আলো চলতে গিয়ে বাধা পায়। বেঁকে যায় আলোর গতিপথ। তাই মহাকর্ষ ক্ষেত্র পার হতে গিয়ে আলোর বেশি সময় লাগে। বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে, ভারী বস্তুর মহাকর্ষক্ষেত্র সময়কে ধীর করে দিচ্ছে।
এটাই ছিল আইনস্টাইনের জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটির অন্যতম মূল কথা। অর্থাৎ এখানেও সেই একই ব্যাপার। সময় মোটেও পরম কিছু নয়। পর্যবেক্ষক আর অবস্থানের সময় কারো কাছে ধীর কারো কাছে দ্রুত।
সূত্র : নিউ সায়েন্টিস্ট
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।