আকাশে প্রচুর নক্ষত্র থাকলেও মহাশূন্য ঘুটঘুটে অন্ধকার। নক্ষত্র বিপুল পরিমাণ আলো বিকিরণ করে। তাই মহাকাশ হওয়ার কথা আলোকিত। তাহলে মহাকাশ আলোকিত নয় কেন? নক্ষত্রের আলোকে আমরা সাদা হিসেবে দেখি। ভিন্নভাবে বলা যায়, মহাকাশ সাদা হলো না কেন? আরেকটু এগিয়ে যদি বলি, কখনো কি ভেবেছেন, মহাকাশ সাদা হলে কী হতো? কিংবা সাদা মহাকাশে অনন্ত নক্ষত্রবীথিই-বা কেমন দেখাত? ব্ল্যাকহোলগুলো কি দৃশ্যমান হতো? সাদা মহাকাশে কি আমরা আদৌ নক্ষত্র দেখতে পেতাম?
এসব প্রশ্নের উত্তরে যাওয়ার আগে একটা বিষয় পরিষ্কার হওয়া দরকার। আমরা এখনো যতটা পদার্থবিজ্ঞান জানি, সে হিসাবে কালো আসলে কোনো রং নয়। রং বলতে বোঝায় দৃশ্যমান আলোকতরঙ্গের নানা তরঙ্গদৈর্ঘ্য বা বর্ণালি। কালো বস্তু এই বর্ণালির সব আলো শুষে নেয়। এককথায় বলা যায়, আলোর অনুপস্থিতিই মূলত কালো। অন্যদিকে সাদা হলো সব রঙের মিশ্রণ। দৃশ্যমান আলোতে যতরকম তরঙ্গদৈর্ঘ্য বা আলো হওয়া সম্ভব, সবগুলো একসঙ্গে মেলালে তৈরি হয় সাদা। অর্থাৎ এই মিশ্রণকে আমরা সাদা হিসেবে দেখি।
সুতরাং রং আমাদের একান্ত নিজস্ব সংবেদনশীলতা। কিন্তু আমরা যদি মহাবিশ্বের পটভূমিতে ফিরে যাই, তাহলে দেখব সবকিছু নিখাদ সাদা। বিগ ব্যাংয়ের মাধ্যমে মহাবিশ্ব তৈরি হওয়ার পর আলো বিকিরণ করার মতো কোনো নক্ষত্র ছিল না। পুরোটাজুড়ে ছিল অস্বচ্ছ উত্তপ্ত প্রোটন, ইলেকট্রন ও নিউট্রনের মহাসমুদ্র।
প্রায় ৩ লাখ বছর পর স্পেস বা স্থান কিছুটা ঠান্ডা হয়। এসব মৌলিক কণা একে অন্যের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গঠন করে অণু-পরমাণু। মহাবিশ্ব ধীরে ধীরে স্বচ্ছ হতে থাকে। কিন্তু আপনার-আমার দৃষ্টিতে এই স্বচ্ছতাই কালো হয়ে ধরা দেবে। কারণ তখনও আলো বিকিরণ করার মতো কোনো উৎস তৈরি হয়নি। এ সময়কালকে বলে অন্ধকার মহাযুগ। হাইড্রোজেন থেকে হিলিয়াম গঠনের প্রক্রিয়ায় প্রথম নক্ষত্র জন্মের পর শেষ হয় এ মহাযুগের।
প্রথম যুগের এসব নক্ষত্র ছিল সূর্যের চেয়ে প্রায় ৩০০ গুণ বেশি ভারী ও কয়েক লাখ গুণ উজ্জ্বল। লাখ লাখ বছর ধরে আলো উত্তাপ ছড়ানোর পর সুপারনোভা বিস্ফোরণের মাধ্যমে শেষ হয় এই নক্ষত্রগুলোর যাত্রা।
প্রথম এই নক্ষত্রগুলোর আয়নিত হাইড্রোজেন পরমাণু থেকে বিকিরণ নিঃসৃত হতে থাকে। অর্থাৎ হাইড্রোজেন পরমাণু আবার প্রোটন ও ইলেকট্রনে রূপান্তরিত হয়। ফলে মহাবিশ্ব আলোকিত হয়ে ওঠে। কিন্তু সেই আলো পরে কোথায় চলে গেল? কেন এত নতুন নক্ষত্র, গ্যালাক্সি থাকা সত্ত্বেও রাতের আকাশ অন্ধকার?
কারণটা অতিসরলীকরণ করে যদি বলি, তাহলে বলতে হয়: মহাবিশ্ব যদি কালো বা অন্ধকারের বদলে সাদা আলোয় ভরা থাকত, তাহলে মহাবিশ্বের বয়স ও আকার হতো অসীম। তখন আমাদের এই চিরচেনা মহাবিশ্ব আর থাকত না। এখনকার পদার্থবিজ্ঞানের হিসেব-নিকেশ কিছুই হয়তো মিলত না সেখানে। এমন মহাবিশ্ব কল্পনা করাই আমাদের জন্য কঠিন।
বর্তমানে মহাবিশ্বের বয়স প্রায় ১৩.৮ বিলিয়ন বা ১ হাজার ৩৮০ কোটি বছর। আমাদের হিসেবে এটা অনেক বড় সময়। কিন্তু মনে রাখতে হবে, আলোর গতিও সীমাবদ্ধ। তাই আমরা শুধু প্রায় ১ হাজার ৩৮০ কোটি আলোকবর্ষ দূরের নক্ষত্র দেখতে পাই। এর চেয়ে দূরের নক্ষত্রের আলো এখনও এসে পৌঁছায়নি পৃথিবীতে।
মহাবিশ্ব প্রতিনিয়ত প্রসারিত হচ্ছে। ফলে দূরের নক্ষত্র সরে যাচ্ছে আরও দূরে। নক্ষত্র দূরে সরে গেলে নক্ষত্র থেকে আসা আলোয় রেড শিফট বা লাল সরণ নামের এক বিশেষ ঘটনা ঘটে। ফলে আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য ক্রমাগত বেড়ে লাল কিংবা অবলাল আলোয় পরিণত হয়। তা ছাড়া তরঙ্গদৈর্ঘ্য খুব বড় হলে তা আর আমাদের চোখে ধরা পড়ে না। অন্ধকার দেখি।
এ ছাড়াও মহাবিশ্ব অন্ধকার হওয়ার আরেকটা কারণ আছে। মহাবিশ্ব সব ধরনের বিকিরণে পরিপূর্ণ। কিন্তু আমাদের চোখে তা ধরা পড়ে না। যেহেতু আমরা দেখতে পাই না সব বিকিরণ, তাই কালো বা অন্ধকার শুধু আমাদের জন্য সত্যি। কিন্তু সব বিকিরণ দেখতে পায়, এমন যন্ত্র বা প্রাণির কাছে মহাবিশ্ব আলোকিত। হয়তো সাদা কিংবা ভীষণ রঙিন।
সব বিকিরণ দেখতে পেলে হয়তো ব্ল্যাকহোলও দেখতে পেতাম আমরা। কারণ, সব শুষে নিলেও ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণগহ্বর থেকে হকিং রেডিয়েশন নির্গত হয়। দানবীয় মহাকর্ষ শক্তি সমৃদ্ধ ব্ল্যাকহোল দেখতে ঠিক কেমন হতো, তা জানার কোনো সুযোগ আপাতত নেই। অদ্ভুত সেই মহাবিশ্বের রূপ চাইলে আপনি কল্পনা করতে পারেন। কল্পনার ক্যানভাসে ফুটিয়ে তুললে পারেন ধবধবে সাদা মহাবিশ্বের প্রতিরূপ।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।