সকালে আকাশের দিকে তাকালেই আমাদের মনে একটাই প্রশ্ন জাগে—এই বিশাল মহাবিশ্বের কি আদৌ কোনো শেষ আছে? এমন এক কৌতূহল যা যুগে যুগে বিজ্ঞানীদের ভাবিয়েছে, দর্শনের দরবারে আলোচনার জন্ম দিয়েছে, আর সাধারণ মানুষের মনে বিস্ময়ের জন্ম দিয়েছে। মহাবিশ্বের শেষ কোথায়—এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে বিজ্ঞান যেসব তথ্য, তত্ত্ব এবং গবেষণার দিক নির্দেশ করেছে, তাই নিয়ে আজকের বিশ্লেষণ।
মহাবিশ্বের শেষ কোথায়: মহাজাগতিক সীমানা ও বিজ্ঞানীদের মত
মহাবিশ্বের শেষ কোথায়—এই প্রশ্নটির উত্তর দিতে হলে আমাদের বুঝতে হবে মহাবিশ্ব কিভাবে কাজ করে। মহাবিশ্ব একটি নিরন্তর সম্প্রসারণশীল সত্তা, যা বিগ ব্যাং (Big Bang) নামক এক মহা-বিস্ফোরণের মাধ্যমে শুরু হয়েছিল আজ থেকে প্রায় ১৩.৮ বিলিয়ন বছর আগে।
Table of Contents
নাসার (NASA) বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই সম্প্রসারণ এখনও চলছে এবং দ্রুততর হচ্ছে। এর মানে হচ্ছে, গ্যালাক্সিগুলো ক্রমাগত একে অপর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। এই ঘটনাকে বলা হয় ‘Cosmic Expansion’।
তবে এই সম্প্রসারণের কোনো সীমা আছে কি? অনেক বিজ্ঞানী বিশ্বাস করেন, যদি মহাবিশ্ব অনন্তভাবে সম্প্রসারিত হতে থাকে, তবে এটি কখনও ‘শেষ’ হবে না, বরং এক ধরণের অসীমতায় পৌঁছাবে। অন্যদিকে, কিছু তত্ত্ব বলছে ‘Big Freeze’, ‘Big Rip’ বা ‘Big Crunch’ নামক ভিন্নমুখী মহাজাগতিক পরিণতির কথা।
তত্ত্ব অনুযায়ী মহাবিশ্বের ভবিষ্যৎ কী হতে পারে?
বিজ্ঞানীরা কয়েকটি সম্ভাব্য মহাজাগতিক শেষের কথা বলেন।
- Big Freeze: এটি সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য তত্ত্ব, যেখানে মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ চিরকাল চলবে। এক সময় সমস্ত তারা নিভে যাবে, এবং উষ্ণতা প্রায় শূন্যে নেমে আসবে।
- Big Crunch: একে বলা যায় মহাবিশ্বের উল্টো বিগ ব্যাং। যদি মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ থেমে যায় এবং আবার সংকোচন শুরু করে, তবে সবকিছু এক বিন্দুতে ফিরে আসবে।
- Big Rip: যদি ‘Dark Energy’ নামক শক্তির প্রভাব বেশি হয়, তবে এক সময়ে গ্যালাক্সি, তারা, গ্রহ এবং পারমাণবিক কণাও ছিঁড়ে যাবে।
এইসব তত্ত্ব নির্ভর করে মহাবিশ্বের গঠন, ডার্ক ম্যাটার, এবং ডার্ক এনার্জির পরিমাণ ও প্রকৃতির উপর। বর্তমানে Dark Energy মহাবিশ্বের ৭০% এরও বেশি জায়গা জুড়ে আছে বলে মনে করা হয়।
মহাবিশ্বের প্রান্তে কি আছে?
মহাবিশ্বের ‘শেষ’ বলতে যদি আমরা তার প্রান্ত বুঝি, তবে প্রশ্ন আসে—সেখানে কি আছে? বিজ্ঞানীরা বলেন, আমরা ‘Observable Universe’ বা পর্যবেক্ষণযোগ্য মহাবিশ্বের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এর বাইরে কি আছে তা জানা সম্ভব নয় কারণ আলো এখনও সেখানে পৌঁছায়নি।
আমাদের থেকে ৪৬.৫ বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূর পর্যন্ত যা কিছু রয়েছে, আমরা তা দেখতে পারি। এর বাইরে? হয়তো আরো গ্যালাক্সি, অথবা সম্পূর্ণ ভিন্ন কোনো গঠন।
এই সীমা সময় এবং আলোকে কেন্দ্র করে নির্ধারিত। আলোর গতি সীমিত, তাই মহাবিশ্বের প্রান্তে আমরা যা দেখি তা অনেক বছর আগের ছবি মাত্র।
বিজ্ঞান ও দর্শনের সংযোগ
দর্শনের ক্ষেত্রেও মহাবিশ্বের শেষ কোথায় এই প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ। অনেকেই একে ঈশ্বরের অস্তিত্ব, সৃষ্টির উদ্দেশ্য এবং মানবজাতির ভবিষ্যতের সাথে যুক্ত করে থাকেন। তবে বিজ্ঞান একটি নিরপেক্ষ ব্যাখ্যা দেয়, যা পর্যবেক্ষণ, গণনা এবং বিশ্লেষণের উপর ভিত্তি করে।
আধুনিক প্রযুক্তি যেমন James Webb Space Telescope আমাদের মহাবিশ্ব সম্পর্কে নতুন তথ্য দিচ্ছে, যা আমাদের ধারণাকে প্রতিনিয়ত পরিবর্তন করছে।
এখনকার বিজ্ঞান কি বলে?
বর্তমানে বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন মহাবিশ্ব একটি ‘Flat Universe’ — অর্থাৎ এটি প্রসারিত হচ্ছে কিন্তু কোনো বাঁক নেই। এই ধারণাটি মহাবিশ্বের জ্যামিতিক প্রকৃতি ও ডার্ক এনার্জির সাথে যুক্ত।
James Webb ও Hubble টেলিস্কোপের মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা নতুন গ্যালাক্সি আবিষ্কার করছেন, যা বিগ ব্যাং-এর প্রথম কিছুকাল পরে গঠিত হয়েছিল। এ থেকে বোঝা যায় যে মহাবিশ্ব ক্রমাগত আমাদের চোখের সামনে নতুন দিগন্ত খুলে দিচ্ছে।
মহাবিশ্বের ভবিষ্যৎ জানার গুরুত্ব
এই প্রশ্ন—মহাবিশ্বের শেষ কোথায়—শুধু জ্ঞানের জন্যই নয়, আমাদের অস্তিত্ব, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও প্রযুক্তি উন্নয়নের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। যদি মহাবিশ্ব একদিন শেষ হয়ে যায়, তবে মানবজাতির কী হবে? এ প্রশ্ন আমাদের উদ্বুদ্ধ করে গ্রহান্তর বসতি, স্পেস স্টেশন, এবং চিরস্থায়ী জ্ঞান অনুসন্ধানের দিকে।
শেষ পর্যন্ত বলা যায়, মহাবিশ্বের শেষ কোথায় তা হয়তো আমরা কখনোই জানবো না। কিন্তু এই অজানার পথে অনুসন্ধান আমাদের জ্ঞান ও সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
জেনে রাখুন-
- মহাবিশ্বের শেষ কোথায়?
এটি নির্ভর করে মহাবিশ্বের সম্প্রসারণের প্রকৃতি ও ডার্ক এনার্জির আচরণের উপর। বিজ্ঞানীরা এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেননি। - Big Freeze কী?
এটি একটি তত্ত্ব যেখানে মহাবিশ্ব চিরকাল সম্প্রসারিত হবে এবং সবকিছু একদিন জমে যাবে বা শক্তিহীন হয়ে পড়বে। - Observable Universe মানে কী?
আমরা যে মহাবিশ্বের অংশ দেখতে পারি, তা-ই Observable Universe। এর বাইরে কি আছে তা জানা যায় না। - Dark Energy কিভাবে কাজ করে?
এটি মহাবিশ্বের সম্প্রসারণকে ত্বরান্বিত করে। এটি এখনো এক রহস্য, তবে এটি মহাবিশ্বের অধিকাংশ স্থান দখল করে আছে। - মহাবিশ্বের ভবিষ্যৎ কেন গুরুত্বপূর্ণ?
কারণ এটি আমাদের অস্তিত্ব, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা এবং প্রযুক্তিগত অগ্রগতির সাথে সরাসরি সম্পর্কযুক্ত।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।