নক্ষত্রের কাজকারবার ছিল অনেকটা রান্নাঘরের প্রেশার কুকারের মতো। এরা অতিক্ষুদ্র কণাগুলোকে একত্র করে বড় থেকে আরও বড় মৌল গঠন করতে বাধ্য করছিল। বড় নক্ষত্রগুলো উৎপাদন করছিল অনেক বেশি তাপ ও চাপ। সে কারণে সেখানে গঠিত হতে পেরেছিল লোহার মতো ভারী মৌল।
দানবীয় এসব নক্ষত্রের ভেতরে তৈরি হওয়া মৌলগুলো সেখানেই থেকে গেলে, তা আসলে অনর্থক হতো। কিন্তু এই নক্ষত্রগুলো ছিল অস্থিতিশীল। তাই তারা একসময় বিস্ফোরিত হয়ে তাদের ভেতরের মৌলগুলোকে ছায়াপথের চারদিকে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে দেয়।
মহাবিশ্বের সূচনা হওয়ার ৯ বিলিয়ন বছর পর, মহাবিশ্বের গড়পড়তা একটা অংশে, একটা গড়পড়তা ছায়াপথে জন্ম নেয় একটা গড়পড়তা সাধারণ নক্ষত্র। সেটা ছিল আমাদের সূর্য। কিন্তু সেটা গঠিত হলো কীভাবে? কণা আর ভারী মৌল দিয়ে ঠাসাঠাসি বিপুল পরিমাণ গ্যাসীয় মেঘ মহাকর্ষের টানে ধীরে ধীরে পুঞ্জীভূত হতে থাকে।
ওই সব কণা ও ভারী মৌলের মধ্যে ছিল অতিরিক্ত প্রোটন ও নিউট্রনও। সেগুলো একে অপরকে কেন্দ্র করে ঘুরতে শুরু করলে মহাকর্ষ তাদের পরস্পরের আরও কাছে আসতে বাধ্য করে। এভাবে তারা পরস্পরের সংঘর্ষের মুখে পড়ে এবং জোড়া লেগে একত্র হয়।
একবার সূর্য জন্ম নেওয়ার পরও এই গ্যাসীয় মেঘের ভেতর অবশিষ্ট ছিল প্রচুর পরিমাণে মহাজাগতিক উপাদান। এই গ্যাসীয় মেঘ থেকে বেশ কয়েকটি গ্রহ এবং উল্কা নামের হাজার হাজার মহাকাশীয় পাথর আর কোটি কোটি ধূমকেতু তৈরি হওয়ার মতো যথেষ্ট পদার্থ ছিল। এগুলো তৈরি হওয়ার পরও আরও পদার্থ অবশিষ্ট ছিল সেখানে। অন্য সব মহাজাগতিক বস্তুর দিকে সজোরে ছুটে গেল এই পথভ্রষ্ট আবর্জনা। এই সংঘর্ষ এতই শক্তিশালী ছিল যে তাদের কারণে পাথুরে গ্রহগুলোর পৃষ্ঠতল গলে গিয়েছিল।
সৌরজগতের চারপাশে এসব আবর্জনার পরিমাণ কমে যাওয়ার কারণে এসব প্রভাবও কমে গেল। তাতে গ্রহদের পৃষ্ঠতলও শীতল হতে শুরু করে। পৃথিবী এমন জায়গায় গড়ে ওঠে, যাকে সূর্যের চারপাশে আমরা একধরনের গোল্ডিলকস জোন বলি। তোমার হয়তো মনে আছে, গোল্ডিলকস কখনো খুব বেশি গরম বা খুব বেশি ঠান্ডা পরিজ খেতে পছন্দ করত না। একইভাবে পৃথিবীও সৌরজগতের এমন এক জায়গায় অবস্থিত, যাকে বলা হয় সূর্য থেকে একেবারে যথার্থ দূরত্ব।
পৃথিবী যদি সূর্যের খুব কাছে হতো, তাহলে সাগর-মহাসাগরের সব পানি বাষ্পীভূত হয়ে উবে যেত। আবার সূর্য থেকে বেশি দূরে থাকলেও জমে বরফ হয়ে যেত সাগর-মহাসাগরের সব পানি। সেটি হলে পৃথিবীতে আমাদের চেনাজানা জীবনের উদ্ভব কখনো হতো না। তাহলে বইটি পড়ার জন্য তুমিও কখনো এখানে থাকতে না। মহাবিশ্ব শুরুর পর এতক্ষণে ৯ বিলিয়ন বছর পেরিয়ে গেছে।
এ সময় আমাদের তরুণ ও উত্তপ্ত গ্রহের পাথরগুলোর ভেতরে আটকে পড়া পানি বাষ্পীভূত হয়ে আকাশে উঠে গেল। পৃথিবী ক্রমেই শীতল হচ্ছিল। ফলে ঘনীভূত হয়ে উঠল এই পানি। তারপর বৃষ্টি হয়ে নিচে নেমে এল। এভাবেই একসময় গড়ে উঠল সাগর-মহাসাগর। এই মহাসাগরেই কোনো এক কারণে সরল অণুগুলো একত্র হয়ে প্রাণে রূপ নিল। সেই কারণ আমাদের কাছে এখনো অজানা।
মানুষ বায়ুজীবী প্রাণী। আমাদের বেঁচে থাকার জন্য অক্সিজেনসমৃদ্ধ বাতাস দরকার। কিন্তু আদিম মহাসাগরের আধিপত্য বিস্তার করেছিল অবায়ুজীবী ব্যাকটেরিয়া। এই আণুবীক্ষণিক গঠনের প্রাণের বেঁচে থাকার জন্য কোনো অক্সিজেনের দরকার হয়নি। সৌভাগ্য যে এসব অবায়ুজীবী ব্যাকটেরিয়া অক্সিজেন নিঃসরণ করেছিল। বাতাসে মানুষের বেঁচে থাকার উপযোগী উপাদানের জোগান দিয়েছিল আসলে এরাই। অক্সিজেনসমৃদ্ধ এই নতুন বায়ুমণ্ডল আরও জটিল থেকে জটিলতর প্রাণের উদ্ভবের সুযোগ করে দিল।
কিন্তু জীবন নিতান্তই পলকা। মাঝেমধ্যে মহাকাশ থেকে বড় ধরনের ধূমকেতু ও গ্রহাণু আছড়ে পড়ত আমাদের গ্রহে। তাতে নিমেষেই বড় ধরনের ওলট-পালট হয়ে যেত। ৬৫ মিলিয়ন বছর আগে, ১০ ট্রিলিয়ন টন ওজনের একটা গ্রহাণু পৃথিবীতে আঘাত হেনেছিল। জায়গাটি মেক্সিকোর ইউকাটান উপদ্বীপে অবস্থিত। মহাকাশ থেকে আসা ওই পাথরটা ভূপৃষ্ঠে যে খাদের সৃষ্টি করেছিল, তা প্রায় ১১০ মাইল প্রশস্ত এবং ১২ মাইল গভীর।
এই গ্রহাণুর আঘাতের ফলে ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রচুর ধুলা ও ধ্বংসাবশেষ বায়ুমণ্ডলে মিশে গিয়েছিল। এতে স্রেফ বিলুপ্ত হয়ে গেল পৃথিবীর বেশির ভাগ প্রাণী। এর মধ্যে রয়েছে বিখ্যাত বিশালদেহী ডাইনোসরের বিলুপ্তি। জীবজন্তু বা প্রাণের কোনো রূপের অস্তিত্বের চরম সমাপ্তি।
এই বিপর্যয় আমাদের স্তন্যপায়ী আদিপুরুষকে সমৃদ্ধ করেছিল। তখন আর তাদের টি–রেক্সের সকালের নাশতা হলো না। এসব স্তন্যপায়ী দলের মধ্যে বড় মস্তিষ্কধারী একটা দলকে বলা হয় প্রাইমেট। তাদের থেকেই একসময় হোমো সেপিয়েন্স নামের প্রজাতির উদ্ভব হয়। তারা নতুন কৌশল উদ্ভাবন ও বিজ্ঞানের যন্ত্রপাতি বানাতে যথেষ্ট চৌকস। আবার মহাবিশ্বের জন্ম ও বিবর্তন সম্পর্কেও আবিষ্কার করতে পেরেছে তারা।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।