অর্থোপক্স ভাইরাস গোত্রের একটি সদস্য এই মাঙ্কিপক্স ভাইরাস। নামে মিল থাকলেও আমাদের পরিচিত জলবসন্ত বা চিকেনপক্সের সঙ্গে এর আত্মীয়তা নেই; বরং স্মলপক্স বা গুটিবসন্তের সঙ্গেই এর বেশি মিল। পক্সভেরিডি ফ্যামিলির অন্তর্গত এই ভাইরাসের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় হলো ভ্যারিওলা (যা দিয়ে গুটিবসন্ত হতো), কাউপক্স ইত্যাদি। দুটি ক্লেইড আছে মাঙ্কিপক্সের—ক্লেইড১ ও ক্লেইড২।
এ দুটির আবার ১এ ও বি, ২এ ও বি নামে দুটি সাবক্লেইড আছে। ২০২২ সালে যে আউটব্রেক হয়, তা সাবক্লেইড ২বি দিয়ে হয়েছিল। ২০২৪ সালে আফ্রিকার বাইরে যেগুলো শনাক্ত হয়েছে, তা মূলত সাবক্লেইড ১বি ধরনের। এটি জুনোটিক ডিজিজ, মানে প্রাণী থেকে মানুষের শরীরে এসেছে।
বানর, খরগোশ, কাঠবিড়ালি, ইঁদুর ইত্যাদি প্রাণী এই ভাইরাসের রিজার্ভার। প্রাণী থেকে মানুষে সংক্রমণ ঘটার কারণ হিসেবে কামড়, খামচি ছাড়াও প্রাণী শিকার, চামড়া ছেলার সময় সংস্পর্শ, প্রাণীর সঙ্গে খেলাধুলার সময় ঘনিষ্ঠতা, কখনো প্রাণী খাওয়াকে দায়ী করা হয়। মানুষে মানুষে এটা কীভাবে ছড়ায়? বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে, অন্যের ব্যবহৃত ব্যক্তিগত জিনিসপত্র ব্যবহার ও যৌন সংসর্গের মাধ্যমে। অন্তঃসত্ত্বা মায়ের কাছ থেকে গর্ভস্থ সন্তানও আক্রান্ত হতে পারে।
মাঙ্কিপক্স ভাইরাসে আক্রান্ত হলে যে রোগ হয়, তার নাম মাঙ্কিপক্স। সাধারণ পক্স থেকে এটি একটু আলাদা। সাধারণত ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করার সপ্তাহখানেকের মধ্যেই কিছু উপসর্গ প্রকাশ পায়। এগুলো হলো জ্বর, মাথাব্যথা, সারা শরীরে ত্বকে দানা, গলাব্যথা, পেশিতে ব্যথা, ব্যাকপেইন বা মেরুদণ্ডে ব্যথা, ক্লান্তি, অবসাদ। এর সঙ্গে একটি উল্লেখযোগ্য উপসর্গ হচ্ছে শরীরের নানা জায়গায় লিম্ফ নোড বা লসিকা গ্রন্থি ফুলে যাওয়া।
কখনো জ্বর আগে হয়, কখনো দানা। দানা বা র্যাশগুলো প্রথমে মুখমণ্ডলে শুরু হয়। তারপর সারা দেহে ছড়িয়ে পড়ে, এমনকি হতে পারে হাত ও পায়ের তালুতেও। প্রথমে সাধারণ দানার মতো দেখালেও ক্রমে এর ভেতরে পানি জমে বা ফোসকার মতো হয়ে ওঠে। তারপর ধীরে ধীরে শুকিয়ে পড়ে যায়। চুলকানি বা জ্বলুনি থাকতে পারে। দানাগুলো যত দিন থাকে, তত দিনই একজন আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তিতে রোগটি সংক্রমিত হতে পারে।
প্রশ্ন হলো, মাঙ্কিপক্স কি প্রাণসংহারী বা বিপজ্জনক? এ প্রশ্নের উত্তর এখনই দেওয়া কঠিন। কারণ, সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল বলছে, প্রতিবছরই জেনেটিক মিউটেশন ঘটছে ভাইরাসের, পরিবর্তিত হচ্ছে এর চরিত্র। এই মুহূর্তে তত প্রাণঘাতী না হলেও অদূর ভবিষ্যতে কী হবে, এখনই বলা যাচ্ছে না। তা ছাড়া ডেমাক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গো ও আফ্রিকার কিছু দেশে, যেখানে মাঙ্কিপক্সের প্রাদুর্ভাব বেশি, সেখানে দেখা গেছে, এইচআইভি আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে মৃত্যুহার প্রায় দ্বিগুণ। আর অপুষ্টির শিকার শিশুরাও মৃত্যুঝুঁকিতে রয়েছে।
যাঁদের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কম, যেমন বৃদ্ধ, শিশু বা অন্তঃসত্ত্বা নারী ও দীর্ঘমেয়াদি রোগে ভোগা ব্যক্তি, তাঁদের জন্য মাঙ্কিপক্স বিপদ ডেকে আনতে পারে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আর দশটা ভাইরাসজনিত রোগের মতো নিজে নিজে সেরে গেলেও কারও কারও ক্ষেত্রে জটিলতা দেখা দিতে পারে। যেমন ত্বকের ফুসকুড়ি থেকে ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ ও ফোঁড়া, কর্নিয়ায় সংক্রমণ হলে দৃষ্টিশক্তি হ্রাস, নিউমোনিয়া, সেপসিস, এনকেফালাইটিস, বমি, ডায়রিয়া এবং তা থেকে পানিশূন্যতা, মায়োকার্ডাইটিস বা হৃদ্যন্ত্রের প্রদাহ, প্রকটাইটিস বা বৃহদন্ত্রের প্রদাহ, মূত্রতন্ত্রের প্রদাহ ইত্যাদি।
মূলত উপসর্গ দেখেই মাঙ্কিপক্স শনাক্ত করা হয়। এই রোগের উপসর্গের সঙ্গে মিল পাওয়া যেতে পারে চিকেনপক্স, হারপিস, স্ক্যাবিস, হাম, অ্যালার্জিজনিত রোগ ইত্যাদির। ইতিহাস শুনে সতর্কভাবে ফুসকুড়িগুলো লক্ষ করলে রোগ শনাক্ত করা সম্ভব। চিকেনপক্সের সঙ্গে এর অন্যতম পার্থক্য হলো মাঙ্কিপক্সে লসিকা গ্রন্থি ফোলে এবং ত্বকের ফুসকুড়িগুলো আরও গভীর ও তীব্রতর হয়। পিসিআর বা পলিমারেজ চেইন রিঅ্যাকশনের মাধ্যমে ভাইরাল ডিএনএ শনাক্ত করা সম্ভব। যদিও এই টেস্টের ব্যবহার ব্যাপকভাবে প্রচলিত হয়নি এখনো। ত্বকের ফুসকুড়ির তরল থেকে নমুনা নিয়ে এই টেস্ট করতে হবে।
তবে উপসর্গভিত্তিক চিকিৎসার বাইরে এই রোগের তেমন কোনো চিকিৎসা নেই। জ্বর ও চুলকানির জন্য ওষুধ, ত্বকের যত্ন এবং জটিলতা এড়াতে পরিচর্যাই মূল চিকিৎসা। বেশির ভাগ রোগী দুই থেকে চার সপ্তাহের মধ্যে সেরে ওঠেন। এ সময় যা করবেন—
- আইসোলেশন বা আলাদা থাকা জরুরি। কারণ, ত্বকের র্যাশ পুরোপুরি সেরে না ওঠা পর্যন্ত ভাইরাস ছড়াতে থাকে। শিশুদের স্কুলে দেওয়া উচিত নয় এ সময়।
- ত্বকে হাত না দেওয়াই উচিত। হাত লেগে গেলে অবশ্যই সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলতে হবে বা স্যানিটাইজার দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে। কারণ, হাতের সংস্পর্শে কাপড়চোপড়, তোয়ালে, চাদর, দরজার নব বা অন্যান্য জিনিসে ছড়ানোর মাধ্যমে ভাইরাস অন্যদের মধ্যে সংক্রমিত হবে।
- অন্য ব্যক্তির কাছাকাছি গেলে মাস্ক পরা উচিত।
- ত্বক শুষ্ক রাখতে হবে। উন্মুক্ত রাখাই ভালো। আলো–বাতাস চলাচল করে—এমন ঘরে থাকতে হবে।
- মুখে ঘা বা ফুসকুড়ি হলে ঈষদুষ্ণ লবণপানিতে কুলকুচি করতে হবে। বেকিং সোডা বা এপসম সল্ট দিয়ে হালকা গরম পানিতে রোজ গোসল করা ভালো। এতে আরাম মিলবে এবং ঘা দ্রুত শুকাবে।
- ফুসকুড়ি বা ঘা নখ দিয়ে চুলকানো যাবে না, এতে ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়বে।
- পুষ্টিকর সুষম খাবার খেতে হবে।
মাঙ্কিপক্সের এখনো সর্বজন ব্যবহারোপযোগী টিকা নেই। চিকেনপক্সের টিকা এই ভাইরাসের বিপরীতে কাজ করে না। গুটিবসন্ত বা স্মলপক্সের টিকার সঙ্গে এর টিকার মিল বেশি। কিন্তু পৃথিবী থেকে স্মলপক্স নির্মূল হয়ে যাওয়ার পর এই টিকাও এখন আর সহজলভ্য নয়। তবে উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তিদের জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা টিকার নির্দেশনা দিয়েছে। এসব ব্যক্তি হলেন মাঙ্কিপক্সে আক্রান্ত রোগীর সংস্পর্শে আসা চিকিৎসক বা নার্স, আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসা স্বজন, বিশেষ করে শিশু, যৌনকর্মী বা একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে যৌন সংসর্গ আছে, এমন ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তি।
এটি আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসার চার দিনের মধ্যে নিতে বলা হয়েছে। আপাতত উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ আফ্রিকার কিছু দেশ ছাড়া এই টিকা কার্যক্রম সম্প্রসারিত নয়। তাই আমাদের মতো দেশে বিমানবন্দর ও অন্যান্য বন্দরে সতর্কতা বৃদ্ধি, সন্দেহ হলে আক্রান্ত ব্যক্তিকে সঙ্গনিরোধ করা এবং ব্যক্তিগত সতর্কতার দিকে মনোযোগ দিতে হবে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।