এমপক্সের দুটি প্রধান ধরন—ক্লেড ১ ও ক্লেড ২। ২০২২ সালে এমপক্স নিয়ে ‘জরুরি স্বাস্থ্য অবস্থা’ ঘোষণা করেছিল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। ক্লেড ২ ধরনের তুলনামূলক মৃদু সংক্রমণে জারি করা হয়েছিল এ জরুরি অবস্থা। তবে এখন আরও বেশি প্রাণঘাতী ক্লেড ১–এর সংক্রমণ দেখা যাচ্ছে। ইতিপূর্বে এ ধরনে সংক্রমিত ব্যক্তিদের মধ্যে মৃত্যুর হার ছিল ১০ শতাংশ পর্যন্ত। এখন তা বাড়ছে।
২০২২ সালের সেপ্টেম্বরের দিকে এমপক্সের ভাইরাসের রূপবদল হয়। এই রূপান্তরে তৈরি হওয়া নতুন ধরনটির নাম ক্লেড ১বি। তখন থেকে এটি দ্রুত ছড়াচ্ছে। এটিকে একজন বিজ্ঞানী ‘এ পর্যন্ত সবচেয়ে বিপজ্জনক’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
আগেই বলেছি, চলতি বছরের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র কঙ্গোতে অন্তত ৪৫০ মানুষ এ রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। মোট আক্রান্তের সংখ্যা ১৩ হাজার ৭০০–এর বেশি। পরে এ রোগ বুরুন্ডি, মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্র, কেনিয়া, রুয়ান্ডাসহ আফ্রিকার আরও কয়েকটি দেশে শনাক্ত হয়েছে।
আক্রান্ত ব্যক্তির নিবিড় সংস্পর্শ, যেমন শারীরিক সম্পর্ক, ত্বকের স্পর্শ, এমনকি খুব কাছে থেকে কথোপকথন বা শ্বাস–প্রশ্বাসের মাধ্যমে ছড়িয়ে থাকে এমপক্স। এ রোগের উপসর্গ ফ্লুর মতো। এতে ত্বকে ক্ষত তৈরি হয় এবং তা প্রাণঘাতী হয়ে উঠতে পারে। আক্রান্ত ১০০ জনের মধ্যে মারা যেতে পারেন চারজন।
এমপক্স, আগে যা মাঙ্কিপক্স নামে পরিচিত ছিল, প্রথম শনাক্ত হয় ১৯৫৮ সালে। বানরের মধ্যে পক্সের মতো একটি রোগ ছড়িয়ে পড়লে প্রথম বিজ্ঞানীরা এটি শনাক্ত করেন। এতদিন বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, আক্রান্ত মানুষগুলো মূলত আক্রান্ত পশুর সংস্পর্শে এসেছেন। এই রোগীদের বেশির ভাগই ছিলেন মধ্য ও পশ্চিম আফ্রিকার।
এটি ‘একেবারে বিরল ও স্বল্প পরিচিত’ রোগ ছিল সে সময়। ইঁদুর ও কাঠবিড়ালির মতো প্রাণীর মাধ্যমে সাধারণত মাঙ্কিপক্স ভাইরাস ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে ভেবেছিলেন বিশেষজ্ঞরা। এটি গুটিবসন্তের মতো ভাইরাল প্রজাতির সদস্য। এই প্রজাতির মধ্যে রয়েছে ভেরিওলা ভাইরাস, ভ্যাক্সিনিয়া ভাইরাস ও কাউপক্স ভাইরাস। তা ছাড়া মানুষ থেকে মানুষেও সংক্রমণ ছড়াতে পারে, এমন একটা ধারণা ছিল। গবেষণা থেকে জানা গিয়েছিল, মাঙ্কিপক্স ভাইরাসটি বায়ুবাহিত এবং প্রায় চার দিন পর্যন্ত বাতাসে টিকে থাকতে পারে। এর অর্থ, এই সময়কালে এটি সংক্রামকও হতে পারে।
এরপর ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রে মাঙ্কিপক্সের প্রাদুর্ভাব ছড়িয়ে পড়ে। আমদানি করা প্রাণীর দেহ থেকে দেশটিতে এই ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। সে সময় দেশটির ছয়টি প্রদেশের ৭১ জনের শরীরে মাঙ্কিপক্স শনাক্ত হয়েছিল। পরে, ২০২২ সালের ৭ মে প্রথম একজন ইউরোপীয় নাগরিকের দেহে মাঙ্কিপক্স শনাক্ত হয়। জানা যায়, এ রোগের ভাইরাস শারীরিক সম্পর্কের মাধ্যমেও ছড়াতে পারে।
এ রোগে আক্রান্তদের দেহে শুরুর দিকে জ্বর, মাথাব্যথা, ঠান্ডা ও শরীরে ব্যথার মতো তুলনামূলক মৃদু সিম্পটম বা উপসর্গ দেখা যেত। তবে মুখ, হাত, বুক ও নিম্নাঙ্গে ফোসকা বা ফুসকুড়ির মতো দেখা যেত সিরিয়াস বা তীব্রভাবে আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রে। ছোট ছোট ক্ষতচিহ্নও দেখা যেতে থাকে ধীরে ধীরে, ফুলে উঠতে দেখা যায় লসিকা গ্রন্থি। তখন প্রথমবারের মতো ৭০টির বেশি দেশে এ রোগের সংক্রমণ দেখা যায়।
পরে জানা গেল, ফাটা বা অমসৃণ খসখসে ত্বক (যদিও তা দেখা যায় না), শ্বাসতন্ত্র অথবা চোখ, নাক ও মুখ, সংক্রমিত প্রাণীর কামড়, আক্রান্ত প্রাণী অথবা মানুষের রক্ত, শরীরের তরল বা পশম স্পর্শ করা, সংক্রমিত প্রাণীর মাংস সঠিকভাবে রান্না ছাড়া খাওয়া হলে, ফুসকুড়ি রয়েছে এমন কারও ব্যবহৃত পোশাক, বিছানা অথবা গামছা স্পর্শ করা, মাঙ্কিপক্সে আক্রান্ত কারও ত্বকের ফোসকা অথবা খোসপাঁচড়া স্পর্শ করা অথবা সংক্রমিত ব্যক্তির কাশি ও হাঁচির খুব কাছাকাছি যাওয়ার মাধ্যমে মাঙ্কিপক্স ভাইরাসটি মানবদেহে প্রবেশ করতে পারে।
বর্তমানে এর নতুন ধরনটি আরও বিবর্তিত হচ্ছে। সমস্যা হলো, এখন পর্যন্ত এটির নির্দিষ্ট কোনো ওষুধ বা টিকা আবিষ্কৃত হয়নি। আগে মাঙ্কিপক্সের সংক্রমণ রোধে গুটিবসন্তের টিকা ব্যবহার করা হতো বলে জানা যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, স্মলপক্স বা গুটিবসন্তের জন্য ব্যবহৃত টিকা মাঙ্কিপক্স প্রতিরোধে শতকরা ৮৫ ভাগ কার্যকর। এই টিকার মাধ্যমে ২০২২ সালে এর সংক্রমণ অনেকখানি নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছিল।
মাঙ্কিপক্সের উল্লিখিত লক্ষণগুলো দেখা দিলে বা শরীরে ফুসকুড়ি–জাতীয় কিছু হলে তাঁকে সঙ্গে সঙ্গে অতিরিক্ত সতর্কতা হিসেবে আইসোলেশনে রাখা উচিত বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। পাশাপাশি সম্প্রতি যাঁদের সংস্পর্শে এসেছেন, তাঁদের জানাতে হবে। প্রাথমিকভাবে ঘরেই আইসোলেশনে বা জনসংস্পর্শ থেকে দূরে যেতে পারে।
‘মাঙ্কিপক্স’ যেহেতু মূলত গুটিবসন্ত বা চিকেনপক্স গোত্রের রোগ, তাই বেশির ভাগ রোগীই সুষম খাবারদাবার গ্রহণসহ পরিমিত বিশ্রাম নিলে চিকিৎসা ছাড়াই দু-এক সপ্তাহের মধ্যে সুস্থ হয়ে উঠতে পারেন। যদিও এটি গুটিবসন্তের চেয়ে কম মারাত্মক, তবু এই রোগ করোনার মতো মহামারি আকারে ছড়ানোর আগেই আতঙ্কিত না হয়ে সবাইকে সচেতন থাকতে হবে। পাশাপাশি মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। অবস্থার অবনতি হলে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে, তবে রোগী যেন কারো সংস্পর্শে না আসেন, সেদিকে লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।